আবুল মনসুর আহমদ: প্রিয় পূর্বসুরী

মারুফ ইসলাম

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২০

নিদানের কালে পূর্বসুরীদের পদাঙ্ক তালাশ করতে হয়, তাতে কখনো কখনো সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা এমনই এক নিদানের কালের নাদান বাচ্চা যে, কত অনায়াসে প্রিয় পূর্বসুরীদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছি! একজন আবুল মনসুর আহমদ, আমাদের সেরকমই এক প্রিয় পূর্বসুরী— যাঁকে আমরা স্রেফ বিসিএস পরীক্ষার্থীদের ঠোঁটের আগায় বন্দি করে ফেলেছি। আমাদের প্রজন্মের প্রায় প্রতিটি ‘বিসিএস-তরুণ’ তাঁর নাম ও ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ের নাম মুখস্ত করে ফেলেছে শুধু বিসিএস পরীক্ষায় একটি নম্বর পাবার আশায়। এর বাইরে আবুল মনসুর আহমদ সম্পর্কে তারা আর কিছুই জানে না! কী দুর্দৈব্য! কত হতভাগ্য এ প্রজন্ম!

আবুল মনসুর আহমদের নানা পরিচয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, বুদ্বিজীবী এবং সমাজ সংস্কারক। কোনো পরিচয়ের চেয়ে কোনো পরিচয়ই ছোট নয়। প্রতিটি পরিচয় স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি জ্বলজ্বলে তারকা। তবু কবুল করতেই হয়, এসকল পরিচয়ের মধ্যে তাঁর সাহিত্যিক পরিচয়ই সব থেকে উজ্বল। এবং অতি অবশ্যই আরো একবার স্বীকার করে নিতে হবে যে, সাহিত্যিক পরিচয়ের মধ্যে তিনি আবার ‘ব্যঙ্গ সাহিত্যিক’ হিসেবে বিরল, ব্যতিক্রম।

বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম ব্যঙ্গ সাহিত্যের সূত্রপাত বোধকরি বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে। তিনি তাঁর কালোতীর্ণ চরিত্র কমলাকান্তকে তৈরি করেছিলেন বিদেশি স্যাটায়ার সাহিত্যের আদলে। কমলাকান্ত প্রভূত রস বিলিয়েছে বাঙালি পাঠক মনে, সন্দেহ নেই। এরপর যদ্দূর জানা যায়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য মহোদয় ও বীরবল নামে খ্যাত সুসাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যভুবনে রম্য লেখক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনিও সাহিত্যের এ ধারায় বেশ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। প্রমথ চৌধুরীর পর বাংলা রম্যসাহিত্যে আলোচিত হয়ে ওঠেন রাজশেখর বসু, যিনি পরশুরাম নামেই সমধিক পরিচিত। এরপর অবধারিতভাবে নাম চলে আসে ‘প্রণাবি’র অর্থাৎ প্রমথনাথ বিশীর নাম। ধারণা করা হয়, ইংরেজি সাহিত্যের স্যাটায়ার গুরু জর্জ বার্নার্ড শ যেহেতু সংক্ষেপে নিজের নাম ‘জিবিএস’ লিখতেন, সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রমথনাথ বিশীও লিখতে শুরু করেন প্রণাবি।

সে যাই হোক, রম্যসাহিত্যে এরপর যিনি চিরস্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি আবুল মনসুর আহমদ। তাঁর রচিত ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক রচনা ‘আয়না ও ফুড করফারেন্স’ তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের এক অসামান্য দলিল হয়ে রয়েছে। সন্দেহ নেই, একটি সোনার দোয়াত-কলম ছিল আবুল মনসুর আহমদের হাতে।

আবুল মনসুর আহমদের সেই সোনার দোয়াত কলম থেকে যেসব অনবদ্য রচনার জন্ম হতো, সেসব রচনার শৈলী সম্পর্কে বন্ধুবর কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলা ভাষার ব্যঙ্গ সাহিত্য খুব উন্নত হয়নি। তার কারণ, ব্যঙ্গ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অসাধারণ মেধার প্রয়োজন। এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা। সুরও বেরুবে, তারও ছিঁড়বে না। আমি একবার এক ওস্তাদকে লাঠি দিয়ে স্বরোদ বাজাতে দেখেছিলুম। সেবার সেই ওস্তাদের হাত সাফাই দেখে আশ্চর্য হয়েছিলুম। আর আজ বন্ধু মনসুরের হাত সাফাই দেখে বিস্মিত হলুম। ভাষার কান মলে রস সৃষ্টির ক্ষমতা মনসুরের অসাধারণ। এ যেন পাকা ওস্তাদি হাত। আবুল মনসুরের ব্যঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, সে ব্যঙ্গ যখন হাসায় তখন সে হয় ব্যঙ্গ কিন্তু কামড়ায় যখন তখন সে হয় সাপ। আর সে কামড় গিয়ে যার গায়ে বাজে তার ভাব হয় সাপের মুখের ব্যাঙের মতোই করুণ।`

নজরুল প্রদত্ত এই সনদকে অবিশ্বাস্য মনে হলে বারবার ফিরে যেতে হবে আবুল মনসুর আহমদের রঙ্গ-ব্যঙ্গ রচনাগুলোর কাছে। অন্তরদৃষ্টি উন্মীলন করে পাঠ করতে হবে আয়না ও ফুড কনফারেন্স বই দুখানি। তাহলেই উপলব্ধি করা যাবে ভাষার কান মলে কী সুর তিনি সৃষ্টি করেছেন। আয়না গল্পগ্রন্থে রয়েছে মোটে সাতটি গল্প। গল্পগুলো হচ্ছে: হুজুর কেবলা, গো দেওতা কা দেশ, নায়েবে নবী, লিডারে কওম, মুজাহেদীন, বিদ্রোহী সংঘ ও ধর্মরাজ্য। প্রতিটি গল্পেই ধরা আছে সমাজবাস্তবতা। পাঠককে কখনো হাসিয়ে কখনো চাবুকপেটা করে দেখিয়েছেন সমাজের নানা অসংগতি।

প্রসঙ্গত আলোচনা করা যেতে পারে হুজুর কেবলা গল্পের সারসংক্ষেপ। গল্পটি অতিবিখ্যাত। বিশ্বসাহিত্যের অংশ হওয়ার দাবিদার। এই গল্পে রয়েছে একজন ভণ্ডপির। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জঘন্য ভণ্ডামির আশ্রয় নেয় সে। গ্রামের শিক্ষার আলোবঞ্চিত অসহায় সহজ-সরল মানুষগুলোকে বোকা বানিয়ে সে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের খাস মহলে পৌঁছে যায়। গল্পের ঘটনা এমন: এই ভণ্ডপির তারই এক বিশ্বস্ত মুরিদের যুবতী স্ত্রীর রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাকে কাছে পাবার লালসায় বহুবিধ ফন্দি আঁটতে থাকে। ছলনার আশ্রয় নিয়ে মুরিদ ও তার স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করে। এবং একসময় সম্পর্ক ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। অতঃপর ভণ্ডপির ওই সুন্দরী যুবতী নারীকে বিয়ে করে। অথচ ইতিপূর্বে এই ভণ্ডের আরো তিন-তিনটি স্ত্রী বহাল তবিয়তেই রয়েছে।

এই গল্প মোড় নেয় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এমদাদের মাধ্যমে। এমদাদ একদা পির মহাশয়ের ভণ্ডামি ধরে ফেলে। সে প্রবল উত্তেজিত হয়ে পিরকে শারীরিক আক্রমণ করে বসে। এই আক্রমণের সুযোগ কাজে লাগায় ভণ্ডপির। সে এমদাদকে পাগল আখ্যা দেয়। এভাবে লেখক আবুল মনসুর আহমদ হুজুর কেবলার চরিত্রের কলুষতা আয়নার মতো করেই পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেন।

এই হুজুর কেবলারা এখনো আমাদের সমাজে রয়ে গেছে। নানাভাবে ভোল পাল্টে তারা তাদের কৃতকার্য এখনো সম্পাদন করে যাচ্ছে। কিন্তু সমাজে নেই কোনো আবুল মনসুর আহমদ যিনি কলমের আঁচড়ে আঁকবেন তাদের বিভৎস মুখ। তাই তো ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘পরশুরাম হিন্দু দেবতাদের নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায় তা সহ্য করেছে। আবুল মনসুর আহমদের দুঃসাহসও সেদিন সমাজ সহ্য করেছিল। কিন্তু আজ কোনো সম্পাদক এমন গল্প ছাপতে সাহস করবেন কিনা এবং সমাজ তা সহ্য করবে কিনা, সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে।’

এই সন্দেহ থেকেই কী বাংলার বর্তমান লেখককুল কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অসঙ্গতি নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ করেন না? প্রশ্ন সহজ, উত্তর কঠিন। তারচেয়ে আবার আবুল মনসুর আহমদের গল্পের দিকে নজর ফেরানো যাক। হুজুর কেবলা যেমন ইসলাম ধর্মের অপব্যবহারকেন্দ্রিক অন্ধকার নিয়ে লেখা গল্প, তেমনি ‘গো দেওতা কা দেশ’ গল্পটি হিন্দু ধর্মের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে লেখা। হিন্দু সমাজে গো হত্য নিয়ে যে প্রথা প্রচলিত রয়েছে তার গোড়া ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ। এছাড়া হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াতে ইংরেজরা যে কৌশল অবলম্বন করেছিল তারও যৎসামান্য নমুনা পাওয়া যায় এ গল্পে। বলার অপেক্ষা রাখে না, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাই এ গল্পের প্রধান উপজীব্য।

শুধু ধর্মের এসব অসঙ্গতিই নয়, সমাজপতি, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী যেখানেই তিনি কোনো অন্যায় অসঙ্গতির দেখা পেয়েছেন সেখানেই তাঁর কলমকে চাবুক বানিয়ে শপাৎ শপাৎ আওয়াজ তুলেছেন। তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের রসাঘাত ও কশাঘাত মূলত ছাকনি হয়ে সমাজকে পরিশোধিত করত। আবুল মনসুর আহমদের লেখনির আঘাত শুধু ক্ষয়প্রবণ সমাজের মুমূর্ষু মূল্যবোধ ও লৌকিক আচারকেই আক্রমণ করেনি, অধিকন্তু যারা এসব অনুসঙ্গ নিয়ে মিথ্যার ফুলঝুড়ি সাজাতেন, তাদেরকে তিনি নাকানি চুবানি খাইয়েছেন।

তো, অস্বীকার করার আর উপায় কী যে তিনি সমকাল, সমাজ, মানুষ ও রাজনীতি সচেতন সাহিত্যিক ছিলেন? তাঁর আরেক অমরকীর্তি ‘ফুড কনফারেন্স’এ কী অসম্ভব দ্যুতি নিয়ে জ্বলজ্বল করছে বাংলার সমাজ-সংসার। এ বই যখন আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, তখন বইটি পড়ে কালজয়ী লেখক অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, ‘আয়না লিখিয়া আবুল মনসুর আহমদ প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন। ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।’

সত্যিই আবুল মনসুর আহমদ অমর হয়েছেন। বাংলা রম্য সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গেলে তাঁর নাম এবং ফুড কনফারেন্সের নাম বাদ দেয়া সত্যিই অসম্ভব। বাংলা ভাষার সাহিত্য যারা এখনো টুকটাক পড়ে তাদের বইয়ের শেলফে অবধারিতভাবে নাক উঁচু করে রয়েছে ফুড কনফারেন্স। ফুড কনফারেন্সের এক একটি গল্প যেন এক একটি সময়ের খতিয়ান। এই গল্পগন্থের রিলিফ ওয়ার্ক গল্পের শেষাংশে একটু চোখ বুলানো যাক:

‘সূর্যদোয়ের পূর্বেই মধুপুর গ্রামের শতাধিক ছেলেবুড়োকে হাতকড়া পরা অবস্থায় রিলিফ কমিটির তাম্বুর সম্মুখে জড়ো করা হইল। দারোগা সাহেব সাড়ম্বরে হামিদদের সকলের জবানবন্দি গ্রহণ করিলেন। জবানবন্দি শেষ করিয়া একপাল অভুক্ত অর্ধনগ্ন নরকঙ্কালকে ভেড়ার পালের মতো খেদাইয়া থানায় লইয়া গেলেন।’

কী নির্মম দৃশ্যকল্প! অথচ কী বাস্তব। আবুল মনসুর আহমদের আরেকটি জনপ্রিয় রম্যগল্পের নাম গালিভারের সফরনামা। এই গল্পে তিনি নীতিকথার দিকগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন অম্ল-মধুর ব্যঙ্গের মাধ্যমে। এই গল্পের একটি অংশ এরকম:

‘আলিম: শরিয়ত-বিরোধী বিজ্ঞান-দর্শন ও ভূগোল পড়ান হৈব না।
ডি.পি.আই: আচ্ছা, তারপর?
আলিম: মেয়েদের স্কুল কলেজে পড়ান হৈব না।
সেক্রেটারি: কিন্তু ডাক্তারি ও নার্সিং না শিখালে হাসপাতাল চলবে কেমনে? আওরতদের চিকিৎসা করবে কে?
আলিম: আওরতদের আবরু-ইজ্জত নষ্ট কৈরা ডাক্তারি ও নার্সিং শিক্ষা দিতে হৈব? চিকিৎসার জন্য। শুইনা হাসি পায়। হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত এই চারটি চিজ আল্লা নিজের হাতে রাখছেন। চিকিৎসকেরা কেউ কারো হায়াত দিছেন, একথা আপনারা কোনো দিন শুনছেন?’

বিষয়বস্তু তো বটেই ভাষাতেই তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। তাঁর আরেকটি বৈশিষ্ট হচ্ছে, তিনি ময়মনসিংহের কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দিতে চেয়েছেন। এটা তাঁর জাতীয়তাবাদেরই বহিঃপ্রকাশ তাতে সন্দেহ নেই এ প্রসঙ্গে ড. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, `একুশে ফেব্রুয়ারিকে আবুল মনসুর আহমদ একুশ দফাতে পরিণত করেছিলেন। আমরা জাতিয়তাবোধের একটা মহান চেতনা তাঁর মধ্যে পেয়েছি।’

আজ, এই নিদানের কালে আবুল মনসুর আহমদের মতো জাতীয়তাবোধে জাগ্রত হয়ে কলম ধরার মতো কেউ নেই। তাঁর মতো ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে সমাজের নিদ্রাভঙ্গ করার মতোও কেউ নেই। তাই এই দুর্দিনে আপনাকে বড্ড বেশি দরকার, প্রিয় পূর্বসূরী আবুল মনসুর আহমদ।