আমরা কবিতার জন্য ইম্ফল গিয়েছিলাম

পর্ব ২৫

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৫, ২০১৯

ইন্ডিগোতে উঠেই যে মন এত দ্রুত ভালো হয়ে যাবে, কে জানতো! এটা কি অভ্যস্ত মাটির পৃথিবীর জীবন থেকে হঠাৎ অনভ্যস্ত আকাশজীবনে ক্ষণকালের জন্য ভেসে বেড়াবো— সে-উত্তেজনাজনিত প্রদাহ নাকি উড়োজাহাজে উঠতে না উঠতেই চোখের সামনে জলজ্যান্ত সব সুন্দরী আকাশবালিকাদের ডানাহীন ওড়াওড়ি দেখার মিথস্ক্রিয়া— আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না! উড়োজাহাজে ওঠবার সিঁড়ি পেরিয়ে দরোজা দিয়ে ঢোকার মুখেই আকাশবালিকাদের একজন আমাকে দেখেই এমন এক স্মিত হাসি হেসে বিমানে স্বাগত জানাল যে, মনে হলো— এ-হাসি শুধু আমারই জন্য, আমারই জন্য স্পেশাল এ-হাসি সে বহু বছর ধরে নিজের ভেতর সঞ্চিত করে রেখেছে। আমাকে ছাড়া আর কোনো যাত্রীর দিকে এমন অকৃত্রিম হৃদয়-উৎসারিত হাসি সে ছুঁড়ে দেয়নি, দেবেও না কখনো! এ-হাসির সর্বস্বত্ত্ব শুধু আমারই জন্য সংরক্ষিত! সেই থেকে আমার মন ভালো লাগার অদ্ভুত এক আনন্দে ছেয়ে আছে।

সিটে আসন নেয়ার পর থেকে দেখলাম আরো বেশ ক-জন আকাশবালিকা। পুরো বিমানজুড়ে ওরা পাঁচ ছ-জন হবে, পাখা ঝাপটিয়ে ঝাপটিয়ে ওড়াওড়ি করতে লাগল। আমি নিবিষ্ট মনে ওদের পাখার রঙিন মখমল দেখতে লাগলাম। এ-ছাড়া আর উপায়ই বা কী। হিসেব অনুযায়ী আমার জানালার পাশে বসার কথা ছিল। ওটাই আমার সিট নাম্বার। কিন্তু আমাদের দলনেতা এ কে শেরামও কবি বলে কথা। তিনি আকাশের চূড়ায় উঠে মেঘের ঠিকানা পেলে তার সান্নিধ্য সহজে ছাড়তে চাইবেন কেন? তাই প্রথমেই ঢুকে পড়লেন ওখানে। মাঝখানে কবি নিতাই সেন, তারপর একেবারে সাইডে আমি। অসুবিধা নেই। কোনো অসুবিধা নেই। জানালার পাশে বসে না হয় মেঘের সান্নিধ্য নাই-ই পেলাম, মিড-সাইডে বসার ফলে তো একটু না একটু হলেও ছোঁয়া মিলবে আকাশবালিকার! তার মূল্যও বা কম কি?

সন্দেহ নেই, ইন্ডিগোর আকাশবালিকারা সবাই সুন্দরী। উঁচু লম্বা অটুট স্বাস্থ্য। কিন্তু পোশাকে যেন কোথায় ওদের খামতি আছে। না, রঙে নয়, গাঢ় নীল রংটা ওদের প্লেনের রঙের সঙ্গে মিলেমিশে আকাশের সীমানার সঙ্গেও একাত্ম হয়ে উঠেছে, কিন্তু ড্রেসের সাইজটাই জানি কেমন বেঢপ— নিতম্বের দিকটায় বিদঘুটে রকমের টাইট। মোটেও মানানসই নয়। হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট। তারপর পায়ে অতি পাতলা কাপড়ের কালো রঙের লেগিংস। সার্কাসের মেয়েদের যেমন থাকে। ওটা না থাকলেই বোধ করি সুন্দর লাগতো, এখনই বরঞ্চ অশ্লীল লাগছে।

অনেক অনেকদিন পর আমি মেঘের সঙ্গে ভাসবো। এটা আমার দ্বিতীয় উড়ান! প্রথম বিমানে চড়েছিলাম আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ-পনেরো বছর আগে থাই এয়ারওয়েজে! তার সোয়াদ এবং স্মৃতি-তন্ময়তা তো এতদিনে মরে ভূত হয়ে যাওয়ার কথা। স্বভাবতই আমার ভেতরে সে-কারণে সামান্য হলেও একটু উত্তেজনার ঢেউ থাকতেই পারে! তবে এই আকাশবালিকাদের কারণেও যে খানিকটা হলেও চিত্তবিভ্রম ঘটেনি— সে-কথা বলি কী করে! কেননা, আমি তো আমাকে চিনি। বেড়ে ওঠার ধাপে ধাপে কখন কী কল্পনা করতাম, কী হওয়ার কথা ভাবতাম, তা কি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছি? হ্যাঁ, আজ আর লজ্জায় লুকাব না যে বিনে পয়সায় প্রতিটি সিনেমার প্রতিটি শো দেখার সুবর্ণ সুযোগের হাতছানিতে, আমি বেশ ক’বছর সিনেমা হলের লাইটম্যান হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থেকেছি। তেমনি বিনে পয়সায় প্রচুর পরিমাণ রসগোল্লা খাওয়ার লোভে এক সময় আমার নানাবাড়ির এক মিষ্টিওয়ালার মেয়েকে বিয়ের কল্পনাতেও বুঁদ ছিলাম! শ্বশুরবাড়ি গেলেই রসগোল্লা। আর ঘরজামাই থাকলে তো কথাই নেই, উঠতে বসতে মোহনভোগ আর চমচম! তারই ক্রমবিকশিত ধারায় যখন কৈশোর পক্কতা পেতে শুরু করলো, আমার মনে পাইলট হওয়ার একটা দুর্মর বাসনা বহুদিন অবধি সক্রিয় ছিল। সেটা যত না ফাইটিং স্পিরিট বা দুঃসাহসিকতা দেখানোর অভীপ্সায়, তারচেয়ে বোধ হয় বেশি ছিল বিমানবালিকাদের নৈকট্যে পৌঁছানোর অভিলাষে। একে তো বেছে বেছে সুন্দরী মেয়েদের নেয়া হয় আকাশবালিকা পদটিতে, তারপর আবার ওদের সাজসজ্জা আর অ্যাপিয়ারেন্সে কী যেন একটা ড্যামস্মার্ট ব্যাপার থাকে, যা ওদের ব্যক্তিত্বকে অতীব আকর্ষণীয় করে তোলে।

কিন্তু হায়! বিধাতা যেমন আমার জন্য সিনেমাহলের লাইটম্যান হওয়ার কোনো চান্সই রাখেনি, উলটো ধীরে ধীরে সিনেমা-হলের অস্তিত্বই বিলীনতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে; তেমনি পাইলট হওয়ার প্রেক্ষাপট তো দিলেনই-নি, বিপরীতে আকাশবালিকাদের ধারেকাছে ঘেষবারও কোনো অবকাশ রাখেননি। তা না হলে, অর্ধশতক জীবনে আমি কেন আজ মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো বিমানে চড়ার সুযোগ পেলাম! সংখ্যাটা কি আরো একটু বেশি হতে পারতো না?

তবে বিধাতা আমাকে যতই আকাশবালিকার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করুন না কেন, আমি কিন্তু তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঠিকই নানা উছিলায় বারবারই এয়ারপোর্টে ছুটে গিয়েছি। কখনো বিদেশ থেকে কোনো হজযাত্রীর ফেরা উপলক্ষ ঘিরে, কখনো-বা ইউরোপ বা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়াগামী কোনো আত্মীয় বা বন্ধুকে বিদায় জানাতে। আগে তো এটা প্রচলিতই ছিল, কেউ এয়ারপোর্টগামী হলেই হলো, সেখানে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের ঢল নেমে যেতো! তারও আগে যেমন বিদেশযাত্রার প্রাক্কালে রেওয়াজ ছিল, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দোয়া চাওয়ার! সময়াভাবে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে পারিলাম না। সবার দোয়াপ্রার্থী।

সে যাই হোক, কোনো একটা উপলক্ষ পেলেই হলো আমি এয়ারপোর্ট যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। যাত্রী লাউঞ্জে সবাই যখন অধীর হয়ে থাকতো কখন তার কাঙ্ক্ষিত জনকে দেখবে বেরিয়ে আসতে, আমি তখন তীব্র অস্থিরতায ভুগতাম কখন অন্তত একজন আকাশবালিকা হলেও ময়ূরের মতো ছন্দ তুলে তুলে হেঁটে আসবে, আর আমি তাকে দেখে নয়নমন সার্থক করবো! আমার চোখ তখন নুলো ভিখেরির মতো কাতর হয়ে থাকতো, আহা রে লোকটা কবি ছিল কাঙালও ছিল খুব! পরিরা প্রতিমা আর স্বর্গ হলো প্রতিমামন্দির!

প্রায়শই হৃৎকম্পন সহযোগে কোনো না কোনো পরি-সদৃশ আকাশবালিকাকে দেখার সুযোগ মিলতো, কখনো বা হতাশ হতে হতো চরমভাবে আকাশবালিকাদের দেখা না পেয়ে। তবে বেশির ভাগ সময়ই মিলতো দেখা। যেমন প্রতিদিন রৌদ্ররেখার দেখা পায় পৃথিবী, তেমনই ব্যাপারটা হতো মখমল রঙিন! আমার এমনতরো কথাবার্তা শুনে কেউ আবার ভাববেন না যেন, আকাশবালিকাদের দেখার জন্য আমি শুধু বেহায়ার মতো বারবার এয়ারপোর্টেই ছুটে গিয়েছি! এত বেরসিক কি আমি হতে পারি? একবার সৌন্দর্যময়ী আকাশবালিকা দেখার টানে তাদের বসতবাটিতেও পৌঁছে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, সে এক ঘটনা বটে। তবে সেদিনও বিধাতা আমার মন নিয়ে খুবই খেলা খেলেছিল আর রচনা করেছিল অপূর্ব সুন্দর এক চিত্রনাট্যের। যা নাটকীয়তায় ভরপুর তো বটেই, খানিকতা নৈরাশ্যজনকও!

তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। বোধ হয় থার্ড ইয়ার। সচিত্র সন্ধানী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রথম চাকরির পাট চুকেবুকে গেছে, দ্বিতীয়বারের মতো পার্টটাইমার হিসেবে জয়েন করেছি একটা এনজিও থেকে প্রকাশিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকায়। তার নির্বাহী সম্পাদক একজন কবি। কবি মানে সুরসিক কবি। কাজের অবসরে আড্ডা দিতে দিতে তার সঙ্গে আমার এবং আমার এক সহকর্মী সেও কবি, তিনজনের মধ্যে একটা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তো একদিন কাজ-শেষে সেই নির্বাহী সম্পাদক বড়ভাই সন্ধ্যাবেলায় বললেন যে, আজ আমার হাতে একটু পরেই দুর্ধষ একটা ফিল্মের ভিডিও ক্যাসেট আসবে।

তাই নাকি? কি ফিল্ম? আমরা দুজনই ঔৎসুক হয়ে উঠেছিলাম।
ডক্টর জিভাগো, বরিস পাস্তেরনাকের!
ফিল্মটির কথা শুনে আমরা দুজনই রোমাঞ্চিত বোধ করি। দি ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই তখন কীভাবে কীভাবে দেখা হয়ে গিয়েছে। সে ফিল্মটিরই নির্মাতা ডেভিড লিনের ছবি ডক্টর জিভাগো এটা জানতাম। তখন ঢাকায় রমরমা ভিডিও ক্যাসেটের যুগ। তবে শুধু হিন্দি ছবির জয়জয়কার। ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিক ফিল্মগুলো কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যায় না। সঙ্গতভাবেই ডক্টর জিভাগোর কথা শুনে আমাদের শিহরিত হওয়া।
ভিডিওটা আনতে যাচ্ছি। যাবে নাকি আমার সাথে? একা যেতে ইচ্ছে করছে না। বড়ভাইয়ের কণ্ঠে সকাতর অনুরোধ।

আমরা দুজনের কেউই বিশেষ উৎসাহ দেখাই না। কাজ শেষ, এখন বাসে চেপে হলে যাব, বিছানায় অলস শরীর ঢেলে দিয়ে রেস্ট নেব! ভিডিও আনতে গিয়ে আবার কোথাকার কোন চক্করে পড়তে হবে, কে জানে!

নির্বাহী সম্পাদক তখন তার ব্রক্ষ্মঅস্ত্রটি ছুঁড়লেন। এসব ফিল্মের ভিডিও কি সবাই আনতে পারে। দুবাই থেকে একজন এয়ারহোস্টেস নিয়ে এসেছে, বুঝেছো। তার কাছ থেকেই আনতে যাচ্ছি।

আমি তখনই বরিস পাস্তেরনাক, ডেভিড লিন বা ডক্টর জিভাগোর প্রতি অসীম এক টানে উঠে দাঁড়াই, মুখের অভিব্যক্তিতে অসহায় এক আর্তিভাব ফুটিয়ে তুলে বলি যে, এত সকাল সকাল হলে ফিরতে ভালো লাগে না। রুমের লাইটগুলো এতো নিভু নিভু, মন কেমন ডাউন হয়ে থাকে!

নির্বাহী সম্পাদকের কন্ঠে সমবেদনা ঝরে পড়ে, আহা রে! চলো আমার সঙ্গে। তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।
আমি নির্দ্বিধায় সায় দিই, আচ্ছা।
আমার সেই সহকর্মী কবি এবং নির্বাহী সম্পাদক কবি দুজনই হো হো করে হেসে উঠলেন উচ্চস্বরে। নির্বাহী সম্পাদক বড়ভাই হাসি সামলিয়ে বলে ওঠলেন, তুমি তো আসলে কথাশিল্পী নও, তুমি হলে কবি, আসলেই কবি, তুমি সুন্দরের পুজারী! চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক