সরকার আবদুল মান্নান

সরকার আবদুল মান্নান

আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল

আত্মজীবনী ১

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশিত : জুলাই ০৯, ২০২০

দৈবকে আমি কখনোই বিশ্বাস করি না। অপ্রাকৃতিক বা অতিপ্রাকৃতিক বলে কিছু আছে কিনা জানি না। কিন্তু মানুষের জীবনে এইসব ঘটে। সেইসব ঘটনা কেউ কেউ অনুভব করতে পারে, আবার অনেকে পারে না। বিশেষ করে মানুষের রিজিক নাকি খুবই অনিশ্চিত। কে কখন কোথায় খাবে, কোথা থেকে রুটিরুজির আয়োজন হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম নয়। তবে আপনাদের বিশ্বাস হবে কিনা জানি না, এই রিজিক আমার জন্য কোথায় নির্ধারিত আছে, তা হয়তো কোনো দিনই বলতে পারব না। কিন্তু কোথাও থেকে যখন রিজিক ওঠে যাবে, তখন তার একটা আগাম বার্তা আমি পেয়ে যাই। আরবি “রিজক” থেকে আসা কৃতঋণ এই শব্দটি দিয়ে মানুষের আহার্য সংক্রান্ত পরিস্থিতি যত ভালোভাবে ব্যক্ত হয় অন্য কোনো শব্দ দিয়ে তা বোঝানো সহজ নয়। তাই সচেতনভাবেই আমি এই শব্দটির আশ্রয় নিয়েছি। আমার এই ব্যক্তিগত রিজিক সম্পর্কে কীভাবে আমি অবহিত হই? চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং আমার মনোদৈহিক অবস্থার গোপন এক অব্যাখ্যাত সংযোগ আমাকে এই সংবাদ দিয়ে দেয় যে, এখানে তোমার রিজিক আর বেশি দিন নেই। কিংবা কখনো কখনো রিজিক পরিবর্তনের জন্য নিরন্তর চেষ্টার কারণেও অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে আমাকে।

শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমার চলে যাওয়ার পেছনে এই দুটি বিষয়ই কাজ করেছিল। প্রথমত, এক-দেড় হাজার টাকা বেতন পেয়ে খুশি থাকার কোনো কারণ নেই। এই টাকায় কিছুতেই একজনেরও চলে না, সংসারে দেওয়া তো দূরের কথা। এবং দ্বিতীয়ত, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা মানবেতর। এবং সর্বোপরি মেঘনার ভাঙনে সর্বস্বান্ত আমার পরিবারটি অন্যের বাড়িতে অমানবিক জীবনযাপন করছে। এই পরিস্থিতি থেকে পরিবারটিকে উদ্ধার করা জরুরি। সুতরাং একটি ভালো চাকরির জন্য আমি নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সময়ে, আশি-নব্বইয়ের দশকে চাকরিবাকরির বিজ্ঞানের জন্য খুব ভালো পত্রিকাটি ছিল দৈনিক ইত্তেফাক। আমরা যারা বেকার, প্রায় বেকার অথবা অর্ধ-বেকার, তারা দিনের কোনো একটা সময়ে ইত্তেফাক না দেখলে পেটের ভাত হজম হতো না। অনেক সময় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হতো এই পত্রিকাটি জন্য। অনেক কষ্ট করে নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে হতো পত্রিকাটির পুরনো কপি।

৮৯-র শেষের দিকে এই পত্রিকার ভেতরের পাতায় একটি বিজ্ঞাপন দেখে কোথাও যেন একটি সুসংবাদ ও সৌভাগ্যের ইঙ্গিত পেলাম। ঢাকা উত্তরের একটি প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাপাসিয়া ডিগ্রী কলেজ। এই কলেজে বাংলা, গণিত ও হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে এবং অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের বিজ্ঞান দেওয়া হয়েছে। হাতে লেখা দরখাস্ত এবং অন্যান্য কাগজপত্র ডাকে পাঠিয়ে দিয়ে চিঠির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর উড়ো খবর পেতে লাগলাম, ‘আরে, ওখানে চাকরি হবে না। দেখ গিয়ে, আগেই লোক নিয়ে বসে আছে। তোমাদের ডাকবে ওদেরকে জায়েজ করার জন্য।’ কিংবা ‘কাপাসিয়া কলেজে চাকরি এত সহজ না। দেখ কে কত টাকা দিয়ে রেখেছে?’ ইত্যাদি। এমন সব উড়ো কথা শুনে শুনে আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম আর ভাবছিলাম, চাকরি যাকেই দিক, পরীক্ষা তো নিতে হবে। বিশেষ করে যারা দরখাস্ত করেছেন তাদের তো ডাকতে হবে। সুতরাং ভেতরে ভেতরে অপেক্ষা করছিলাম পরীক্ষার চিঠি পাওয়ার জন্য।

বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না। চিঠি পেলাম এবং সেই অনুযায়ী আগের দিন সন্ধ্যায় কাপাসিয়া গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন বঙ্গবাজার মসজিদের পাশ থেকে কাপাসিয়ার বাসগুলো ছাড়ত। প্রায় লোকাল। কখনো কখনো বাসওয়ালাদের সুবিধামতো ডাইরেক্ট। আমি টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে কাপাসিয়ার বাসে উঠলাম। কাপাসিয়া কখনো যাইনি। কোথায়, কত দূরে- জানি না। গাজীপুর চৌরাস্তা পার হওয়ার পর বাসটি ক্রমেই প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর এক লীলাভূমির দিকে ধাবিত হচ্ছিল। চিরকাল প্রকৃতিমুগ্ধ আমার সকল সত্তায় বিস্ময়কর আনন্দের অনুভব বিস্তার লাভ করছিল। বিশেষ করে রাজেন্দ্রপুর মোড় থেকে গাড়িটি যখন পুবদিকে যেতে শুরু করল তখন লোকালয়ের জীবন ও সেই জীবনের কোলাহল ছাড়িয়ে এই জনপদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমার মধ্যে মুখর হয়ে উঠল। রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বৃক্ষরাজি, মাঝেমধ্যে টিলা, জলাশয় আর জলাশয়জুড়ে পদ্মফুল। একটি ছোট ব্রিজের ডান পাশের জলাশয়ে দেখলাম লালপদ্ম। একটি-দুটি নয়- অসংখ্য। সেই লালপদ্মে বিকেলের অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা পড়ে চারদিকে হোলিখেলার আনন্দ তৈরি করেছে। আর সেই আনন্দে শরিক হয়েছে জলজ ভাসমান লতাগুল্মে হেঁটে বেড়ানো একটি ডাহুক। মুহূর্তমাত্র আমি তাকে দেখলাম। তারপর নিরুদ্দেশ।

লালপদ্ম আর স্নিগ্ধ বিকেলের রক্তিম আভা কালচে রঙের ডাহুকটিকে কি যে অপরূপ করে তুলেছিল, এক জীবনে বহুবার তা দেখা যায় না। গাছের সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে বাসটি চলছিল যেন স্বপ্নে দেখা কোনো রাজকন্যার রাজ্যাভিমুখে। বিকেলে আমি গিয়ে নামলাম কাপাসিয়া বাস স্টেশনে। একজন লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, কাপাসিয়া কলেজে কীভাবে যাব। তিনি আমাকে বললেন, রিকশা নেন। রিকশাওয়ালাই আপনেরে নিয়ে যাইবে।

কথায় কথায় রিকশা নেওয়ার মতো বিলাসিতা করার সামর্থ্য আমার ছিল না। সেই বিলাসিতা আজও করি না। ওই লোকটিকে আমি আর কিছু বললাম না। অন্য একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, কাপাসিয়া কলজেটা কোন দিকে? তিনি আমাকে পথ বাতলে দিলেন। শুনেছি কলেজের পাশেই মোতাহার ভাইয়ের বাসা। মোতাহার হোসেন মোল্লা। ছাত্রলীগ প্যানেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি ছিলেন। তিনি কাপাসিয়া ডিগ্রী কলেজের গভার্নিং বডির সভাপতি। পায়ে হেঁটে তার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাস স্ট্যান্ড থেকে দুই কিলোমিটারের বেশি নয়। অনেকটা অংশ বাজার তারপর সামান্য কলেজ রোড। বাসায় এসে শুনলাম মোতাহার ভাই ঢাকা থেকে আসবেন। রাত হবে। বাসায় লোকজন তেমন নেই। যে মহিলার সঙ্গে কথা হলো, তিনি মোতাহার ভাইয়ের বোন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুনেই তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। বৈকালিন নাস্তার আয়োজন করলেন। সেটাকে নাস্তা না বলে ভুড়িভোজ বললে ত্যুক্তি হবে না। পেট ভরে মুড়ি পিঠা পায়েস খেলাম। এখন কী করি? মোতাহার ভাইয়ের বোনের নাম মনে নেই। তার আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। তিনি বললেন, বসো, কথা বলি। ভাই চলে আসবে। আমি বললাম, আপা, আমি বরং কলেজটা দেখে আসি। পায়ে হেঁটে কাপাসিয়া শহরটাও ঘুরে আসি। ১০টার মধ্যে ফিরব।

মোল্লাবাড়ি লাগোয়া কলেজ। কলেজ ক্যাম্পাসে দীর্ঘ দ্বিতল একাডেমিক ভবন। তার সামনে একটি লম্বা টিনের ঘর। এই দুইটিতে ক্লাস হয়, পরীক্ষা হয়। এছাড়া দিঘি, মাঠ, মসজিদ, মন্দির, বাগান ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ প্রশস্ত জায়গা নিয়ে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত। দিঘিতে শান বাবাঁধানো ঘাট। মনে পড়ে গেল নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়া আমাদের বাড়িটির কথা। বাড়ির দক্ষিণে পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে বিশাল প্রশস্ত জায়গায় উন্মুক্ত স্থান, বাগান আর মসজিদ। পুকুরের ওই পাড়টিতে ছিল শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের উপরে বসার জন্য পাথরের বেঞ্চ। আমরা সেই শান বাধাঁনো ঘাটে বসে আড্ডা দিয়ে শৈশব ও যৌবনের অনেকটা সময় পার করেছি। কলেজে সেই প্রায় একই রকম শান বাঁধানো ঘাট দেখে মনে হলো, এ যেন হারিয়ে যাওয়া আত্মার আত্মীয়কে ফিরে পাওয়া। আমি কলেজেটির ওই শান বাঁধানো ঘাটে অফুরন্ত স্মৃতিকাতরতা নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কতক্ষণ যে বসেছিলাম এখন আর তা মনে নেই। এই ঘাটের সামনেই প্রাচীন জমিদার বাড়িটিতে অধ্যক্ষের দপ্তর, বাসভবন এবং কয়েকটি বিজ্ঞান ল্যাব। তার বাঁ দিকে স্টাফদের বসার জন্য উঁচু ভিটিতে আলাদা একটি ঘর। আর ঐতিহ্যবাহী ওই স্থাপনার পূর্ব দিকে কলা বাগান পেড়িয়ে ব্যাচেলর শিক্ষকদের মেচ। আর অধ্যক্ষের দপ্তরের সামনে বাঁদিকে মসজিদ-মন্দির লাগোয়া। একটি কলেজে পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দির আর কোথায়ও আছে কি না আমার জানা নেই। বাংলাদেশ যে চিরকাল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির তীর্থস্থান-কাপাসিয়া কলেজে পাশাপাশি অবস্থিত এই মসজিদ ও মন্দির তার প্রতীকী নিদর্শন। আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাপাসিয়ার অনেক ছাত্র। বাজারে তাদের কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তাই বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। গন্তব্যহীন হাঁটাহাটির এক পর্যায়ে দেখা হয়ে গেল আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে। আমরা আলবেরুনী হলের ছাত্র ছিলাম। তিনি গণিতের। আমার এক বছরের সিনিয়র। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, কাপাসিয়া কলেজে গণিতের প্রভাষক পদে তিনি দরখাস্ত করেছেন। স্বস্তির বিষয় হলো, একই প্রতিষ্ঠানে দুইজনই চাকরি প্রার্থী, কিন্তু কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নই। আমজাদ ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক খবর জানতে পারলাম। আগে থেকেই কাউকে নিয়ে নেয়নি, পার্ট টাইমার কেউ নেই, টাকাপয়সা লেনদেনের কোনো রিউমারও নেই। খুবই আশ্বস্ত হলাম। আমজাদ ভায়ের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা শেষ করে দুজনই গেলাম মোতাহার ভাইয়ের বাড়িতে। গিয়ে দেখি তিনি এসেছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাকে নিয়ে রাতের খাবার খাবেন। বোঝা গেল এর মধ্যেই তিনি আমার খোঁজখবর নিয়েছেন। আমার পড়াশুনা, রেজাল্ট, মানুষ হিসেবে কেমন ইত্যাদি। আর আমজাদ ভাই তো তাদের আত্মীয়। খাওয়া শেষে মোতাহার ভাই বললেন, এখানে তোমার থাকা হবে না। তুমি থাকবে আমজাদের বাসায়। কালকে দেখা হবে।

কলেজের সভাপতির বাসায় রাত্রিযাপন যে ঠিক হবে না, সেটা আমিও বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু থাকব কোথায়? আমজাদ ভাইকে পেয়ে ওই দুশ্চিন্তা শেষ হয়েছে আগেই। কাছেই আমজাদ ভাইয়ের বাড়ি। রাস্তার পাশে বিপুল বৃক্ষরাজির মধ্যে এই মনোরম বাড়িটি। বাড়িটিতে তিন-চারটি ঘর। মাটির দেয়াল। মাটির ঘরে এই আমার প্রথম রাত্রিযাপন। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে আমজাদ ভাই চলে গেলেন অন্য ঘরে। দক্ষিণের এই ঘরটিতে আমি একা। মাটির ঘর এত আরামদায়ক, আগে জানতাম না। বলা যায়, শতভাগ সবাস্থ্যকর এই ঘরে আমি পরে বহু রাত কাটিয়েছি। শীতের সময় ঘরের ভেতর বিরাজ করে মিষ্টি উষ্ণতা আর গ্রীষ্মে আরামদায়ক ঠাণ্ডা। সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু হবে। আমজাদ ভাই এবং আমি ১০টার আগেই উপজেলা কমপ্লেক্সে উপস্থিত হলাম। ইউএনও সাহেবের দপ্তরে মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি বরাবরই মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করতাম। বিশেষ করে মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি সবাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। এবং উত্তরের ভেতরে সচেতনভাবেই এমন কিছু ক্লু রেখে দিতাম, যাতে পরের প্রশ্ন ওর বাইরে করতে না পারে। এর মানে পুরো ভাইভা বোর্ড আমার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্ট করতাম। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, আমাকে যদি মুদ্রার নাম, রাজধানীর নাম, জন্মতারিখ জিজ্ঞাসা করে তবে সব শেষ। মুখস্থ রাখার দক্ষতা কোনো কালেই আমার ছিল না। সুতরাং ভয়ের কারণ যে নেই, তা নয়।

একসময় আমার ডাক পড়ল। মোতাহার ভাই ছাড়া বোর্ডের আর কাউকেই চিনি না। কুশলাদি নামধাম জিজ্ঞাসার পরেই জানতে চাইলেন কী করছি এখন। বললাম, জগদীশ গুপ্তের কথাসাহিত্য নিয়ে এমফিল করছি। এরপরই জগদীশ গুপ্তকে নিয়ে তাদের কৌতূহলের আর শেষ নেই এবং আমি সহজাত বাকচাতুর্য ও সবভাবসুলভ সবাচ্ছন্দ্যে তাদের কৌতূহল শতভাগ সন্তুষ্টির সঙ্গে মেটাতে পারলাম বলে মনে হচ্ছিল। আমার প্রিয় কবি কে, জানতে চাইলেন একজন সদস্য। কোনো কিছু না ভেবে আমি বললাম জীবনানন্দ দাশ। আমার প্রিয় কবি অনেকে। চণ্ডী দাশ থেকে শুরু করে এই সময়ের অনেক কবিই আমার প্রিয়। কিন্তু আমি কিছু না ভেবে সোজা বলে দিলাম জীবনানন্দ দাশ। কেননা জীবনানন্দের অনেক কবিতা আমার মুখস্থ আছে এবং আমি আন্দাজ করতে পারি যে, তার পরের প্রশ্ন হবে জীবনানন্দের একটি কবিতা শুনান। ঠিকই তিনি বললেন, জীবনানন্দ দাশ আপনার প্রিয় কবি। তাঁর কবিতা মুখস্থ আছে নিশ্চয়ই। আমি বললাম, জি, অনেক কবিতা মুখস্থ আছে। তিনি একটি কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি ‘আকাশলীনা’ কবিতাটি শুনালাম। এবং তার পরের প্রশ্ন, আকাশের আড়ালে আকাশে/মৃত্তিকার মতো তুমি আজ/তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে... কী বুঝলেন?

আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, “স্যার, একটি কবিতা বহু অর্থময়তার শিল্প। স্থানকালপাত্র ভেদে এর অর্থময়তা ভিন্নতর হতে বাধ্য। আর এখানেই কবিতার মাহাত্ম্য। শত শত বছর ধরে কবিতা বেঁচে থাকে কবিতার এই অনন্য শক্তির জন্য। তাই স্যার আমার কাছে এই কবিতাটি এই মুহূর্তে যে অর্থময়তায় ধরা দিচ্ছে, পরে হয়তো আমার কাছেই সেটা সঠিক বলে মনে হবে না। সুতরাং এই কবিতাটি নিয়ে আপনার ভাবনার সঙ্গে আমার ভাবনার অভিন্নতা প্রায় অসম্ভব। তবুও এই কবিতাটি সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে পারি।

আমার এই নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার পর একজন সদস্য বললেন, বুঝেছি। আপনার মনে হয় আর না বললেও চলবে। যথেষ্ট হয়েছে।
ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বিদায় নিলাম।

ভাইভা বোর্ড থেকে বের হয়ে মনে হলো, চাকরি হবে কি না জানি না, তবে খুব ভালো ভাইভা দিয়েছি। পুরো সময়টাতে আমার মধ্যে কোনো ভয়, শঙ্কা বা দ্বিধা ছিল না। বেশ সবাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে, সম্মানের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি। ঔদ্ধত্য, বোকামি বা আস্পর্ধা প্রকাশিত হয়নি। বিনয়ের সঙ্গে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছি। উপজেলা কমপ্লেক্সের বাইরে গিয়ে চায়ের সঙ্গে মজা করে সিগারেট ধারালাম। বলে রাখি, ক্ষমা করবেন, আমি ধূমপায়ী। কিন্তু অতি সামান্য। সামান্য হলেও এটা যে ক্ষতিকর সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এবং এও বলে রাখি, আমার আপনজনেরা, আমার শিক্ষার্থীরা এবং আমার ফর্মাল সিনিয়র সহকর্মীগণ কোনো দিন আমাকে ধূমপান করতে দেখেননি। মূলত আমি একা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে এই অস্বাস্থ্যকর কাজটি করি।

যাই হোক, এখন অপেক্ষার পালা। কাপাসিয়া কলেজে প্রভাষকের চাকরি নিশ্চয়ই আহামরি কিছু নয়। আর্থিক সাফল্যও আকাশচুম্বী কিছু হবে না। কিন্তু তবুও চাকরির ওই দুর্মূল্যের বাজারে এই চাকরিটা মন্দ নয়। তদুপরি কলেজটির আর্থিক সামর্থ্য ভালো। সরকারি স্কেলে বেতন প্রদান করা হয় এবং বকেয়া থাকে না। নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংকে যার যার হিসাবে বেতনের সরকারি অংশ চলে আসে আর কলেজের অংশ সময়মতো পাওয়া যায়। এই নিয়ে ভাবতে হয় না। এই জন্য আমি মনে করে বসে আছি, এই চাকরিটা হলে চাকরির জন্য আমার হন্যে হয়ে বেড়ানোর অধ্যায় শেষ হবে। দুটার আগেই রেজাল্ট হয়ে গল। চাকরিটা আমার হয়েছে। আমার জীবনে এমন খুশির খবর আর হয়নি। আনন্দে চোখে জল চলে এলো। মনে পড়ল পরিবার-পরিজনের কথা। বিশেষ করে চিরদিন সংসারের জন্য ছুটে বেড়ানো আমার সংগ্রামী বাবার কথা। এই মুহূর্তে পরিবারটির জন্য মাথাগোঁজার একটু ঠাঁই যদি করে দেওয়া যায় তাহলে অনেক করা হবে। বিশেষ করে বাবার মুখে হাসি ফুটবে। গণিতে আমজাদ ভাইয়ের চাকরি হয়েছে। হিসাব বিজ্ঞানে আইয়ুব ভাইয়ের এবং অধ্যক্ষ হিসেবে আলী হোসেন স্যারের।

নিজের বাড়িতে থেকে, পরিবার-পরিজনকে সময় দিয়ে, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এবং এলাকার লোকজন ও সমাজ-সংস্কৃতির মধ্যে বিচিত্র কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থেকে চাকরি করার সৌভাগ্য বিবেচনা করে আমজাদ ভাইও খুব খুশি। দুপুরে আমজাদ ভাইয়ের বাসায় খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কাপাসিয়া বাজারের দিকে। ছোট মফস্বল শহর। সবাই সবাইকে চেনে। পাঁচ-সাত কিলো মিটারের মধ্যে যারা আছেন তাদের অনেকেই বিকেলে আড্ডা দেওয়ার জন্য বাজারে চলে আসেন। কাপাসিয়া কলেজে শিক্ষক হিসেবে কারা নিয়োগ পেলেন- ছোট শহরটিতে সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে ওই শহরের সুধীজন- শিক্ষক, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তারা জানতে চান কারা নিয়োগ পেলেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, মানুষ হিসেবে কেমন, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি। সুখের বিষয় হলো, আমার সম্পর্কে তারা যা জেনেছেন তার সবটুকুই ভালো। বিশেষ করে ভাইভা বোর্ডর সদস্যদের কেউ কেউ বাইরে এসে আমার অনেক প্রশংসা করেছেন এবং সেই প্রশংসাবাণী ডালপালা গজিয়ে কাপাসিয়া শহরের কিছু মানুষের কাছে আমার আলাদা একটি ইমেজ তৈরি করেছে।

বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান অনেক ছাত্রের সঙ্গে দেখা হয়। পরিচয় হয় বন্ধুদের সঙ্গে এবং তাদের বন্ধুদের সঙ্গে। তারা আমাকে সানন্দে গ্রহণ করেছেন। মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার ভাষা ও আচরণ তারা জানেন। এদের সান্নিধ্যে সত্যিকার অর্থে আমি মুক্তির আনন্দ লাভ করলাম। অনেকদিন পরে আমার মনে হলো, আমি ঠিক জায়গায় আসতে পেরেছি। রাতে আমি টঙ্গী চলে এলাম। এবং পরদিন শহীদস্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকর্মীদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে, কাপাসিয়া কলেজে আমার চাকরি হয়েছে। আজকের মতো মোবাইল-ফেসবুক না থাকলেও তখনো যোগাযোগে তেমন কোনো সমস্যা হতো না। এদেশের মানুষের গতিশীলতা ও গমনাগমন তৎপরতায় তখনো সংবাদ পৌঁছোতে সময় লাগত না তেমন। বিশেষ করে টঙ্গী-গাজীপুর-কাপাসিয়ার মতো অভিন্ন সংস্কৃতি ও আত্মীয় পরিবেষ্টিত জনপদ হলে এবং বিচিত্র সম্পর্কজালে আবদ্ধ হলে এধরনের সংবাদ দ্রুতই অংশীজনদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত। আমার সংবাদটিও স্কুলে এভাবেই পৌঁছেছিল।

এমনিতেই স্কুলে সহকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্মানের একটি পরিবেশ ছিলই। আমাকে তারা সম্মান করতেন, বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীরা স্নেহ করতেন। এই সংবাদটি পাওয়ার পরে আমাকে তারা বেশ সমীহ করতে লাগলেন। কেননা টঙ্গী সরকারি কলেজ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজসহ আরও অনেকগুলো কলেজ আছে গাজীপুরে। কাপাসিয়া কলেজ সব সময়ই এগুলোর চেয়ে কম বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষ করে ঐতিহ্যের দিক থেকে কলেজটির পরিচিতি ও সুখ্যাতি তাৎপর্যপূর্ণ। ফলে এই কলেজটিতে প্রভাষক হিসেবে চাকরি হওয়াকে এই জনপদের মানুষ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করে। চলবে

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক