আমার শান্তিনিকেতন

পর্ব ২

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৮

আগের পর্বের শেষ লাইন দিয়েই শুরু করি। নজরুল প্রেমীরা, যারা রবীন্দ্রনাথকে অরাজনৈতিক বলে উড়িয়ে দেন, তারা অনেকটা সঠিক, কিন্তু ঠিক ততটাই ভুল। নজরুল আর রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তার ফারাক ছিল। শান্তিনিকেতন সেটারই একটা প্রতিফলন। কেন শান্তিনিকেতন আলাদা একটা রাষ্ট্র, সেটা বুঝতে হলে এর প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটা যানা জরুরি। এপর্বে আমরা সেটারই একটা ধারণা নেব।

শান্তিনিকেতন (বিশ্বভারতী) ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের একটা বিস্ময়। ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজস্ব উদ্যোগে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেছিলেন, তারই বাস্তব রূপ শান্তিনিকেতন। ১৮৬৩ সালে আশ্রম হিসেবে শুরু হয় শান্তিনিকেতনের যাত্রা। পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার অন্তর্গত বোলপুরের রায়পুর জমিদার ভূবনমোহন সিনহার কাছ থেকে বিশ বিঘা জমি কিনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি প্রতিষ্ঠা করেন।

জাগতিক করণীয় কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে প্রার্থনায় সময় কাটানোর জন্য গৃহী ব্যক্তিদের নির্জন আশ্রয় দান করাই ছিল এ আশ্রমের উদ্দেশ্য। ১৮৮৮ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট একটি অতিথিভবন, প্রার্থনা কক্ষ এবং ধর্মীয় সাহিত্যের জন্য নিবেদিত গ্রন্থাগারের সংস্থান করেছিল। পূর্বপুরুষের চিন্তাকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রমে শিশুদের জন্য তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০ বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ১৯২১ সালে  বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯০১ এর আগে পারিবারিক জমিদারির ব্যবস্থাপনার কাজে তিনি পদ্মাতীরের শিলাইদহে দশ বছর কাটান। জমিদারির ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে তিনি গ্রামের মানুষের জীবনযাপন প্রণালি বিষয়ে ধারণা অর্জন করেন। এ অভিজ্ঞতা কবিগুরুকে সমাজের জন্য গঠনমূলক কিছু করতে আগ্রহী করে তোলে। শিক্ষা ও গ্রামীণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রকে বেছে নিয়ে তিনি শিলাইদহে তার কার্যক্রম শুরু করেন। পরে স্থান পরিবর্তন করে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন।

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একটা আদর্শ স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বাল্যকালে তাকে যেসব স্কুলে পাঠানো হয়েছিল, সেগুলি সম্পর্কে তিনি খুশি ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, ইংরেজি স্কুলগুলি ছিল ভারতীয় জীবনধারা, সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন। বলা হয়, শান্তিনিকেতনকে বেছে নেয়ার পেছনে তার তিনটি স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল। এগুলো হলো:
১. প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদের বেড়ে ওঠা।
২. পরিবর্তনশীল ভারতে শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে শিক্ষা দান।
৩. বৃহত্তর বিশ্বকে গ্রহণের উপযুক্ত করে তোলার জন্য জ্ঞানদান।

আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী শুরু হওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথের মনে এই সমগ্রতার চিন্তা ছিল। বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, ১৯১৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর সঙ্গে ভারতকে সংযুক্ত করার সূত্র হিসেবে শান্তিনিকেতন স্কুলকে গড়ে তুলতে হবে। সেখানে আমাদের পৃথিবীর সকল মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবতাবাদী গবেষণার জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমার শেষ কয়েক বছরের কাজ হবে জাতীয় অন্ধ স্বদেশপ্রেমের কুণ্ডলি থেকে বিশ্বকে মুক্ত করা।’

ভারতকে তিনি এর স্বাতন্ত্র্য-চেতনা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘সেবা করতে ও পেতে, দিতে এবং নিতে, বিশ্বের সঙ্গে আমাদের অবশ্যই একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে ভারত বিচ্ছিন্ন। শিক্ষার নামে সে যা পায়, তা সামান্য। বিশ্বের তুলনায় ভারতের শিক্ষা প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ের। আমরা এখন এই আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবমাননা থেকে মুক্তি চাই।’

এই নতুন ধারণাটি ছিল বিশ্বের সংস্কৃতিগুলোর সমন্বয় ও সহযোগিতার। ভারতীয় সংস্কৃতির যথার্থ একটি কেন্দ্র প্রথমে ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এবং পরবর্তীকালে সাধারণভাবে বিশ্বের সকল সংস্কৃতিতে সৃজনশীল ও বিশ্বজনীন সংস্কৃতির লালন করবে। এ ধারণাটিই বিশ্বভারতীর জন্ম দিয়েছিল। বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ, জৈন এবং ইসলামি মানসের সম্পদ আহরণ করা ছিল পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। আশা করা হয়েছিল যে, এ জ্ঞান ভারতকে বৈচিত্র্যের মধ্যে তার স্বরূপ খুঁজে বের করার পথ দেখাবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এই প্রসারিত ও পরস্পর গ্রথিত পথে আমাদের নিজেদেরকে উপলব্ধি করতে হবে, নচেৎ আমরা যে শিক্ষা লাভ করব তা হবে ভিক্ষুকের মতো। ভিক্ষা করে কোনও জাতি ধনী হতে পারে না।’

বিশ্বভারতীর ধারণায় সার্বিক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুতরাং শ্রীনিকেতনে অর্থনীতিবিদ, কৃষিবিদ, সমাজকর্মী, চিকিৎসক, ধাত্রী, স্বাস্থ্যকর্মী এবং গ্রামীণ শিল্প ও শিক্ষা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও গ্রামীণ সমস্যার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গ্রামবাসীদের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও কাজ করতেন। গবেষণা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানের মধ্য দিয়েই শান্তিনিকেতনের কার্যপদ্ধতি গড়ে উঠেছিল। গ্রামের যুব সম্প্রদায়কে আত্মনির্ভরশীলতায় ব্রতী করার জন্য ‘ব্রতী বালক সংগঠন’ নামে একটি স্কাউট আন্দোলনও সংগঠিত হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল যে, শিশুদেরকে প্রস্তুত করতে পারলে বয়োজ্যেষ্ঠরাও আকর্ষণ বোধ করবেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, নিজেদের মধ্যে ঝগড়ার ফলে ক্ষতবিক্ষত হওয়া গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের মনে সহযোগিতার একান্ত প্রয়োজনীয়তাবোধ জাগানো।

চলবে...

লেখক: কলামিস্ট, কার্টুনিস্ট ও বিশ্বাভারতীর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী