আর্ট এবং আর্টিস্ট কথন

ফ্রি থিংকিং ৩

রিফাহ সানজিদা

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০১৮

অন্যসব কিছুর মতোই আর্টও যে শ্রেণিতে বিভক্ত, অনেকেই মানবে না কথাটা। কেন মানবে না, তাও বলছি। সবাই নিজের মানদণ্ডে নিজের মতো করে আর্ট মাপে। আবার তার মধ্যে বেশিরভাগ লোকজন একটা স্ট্যান্ডার্ডকে সর্বেসর্বা ধরে এই মাপ বানিয়েছে। এর বাইরে কিছুকে তারা আর্ট ভাবতেই রাজি নয়। আবার ধরুন, আর্ট বেশি বা কম তার বিচার কি আর্টিস্টের খ্যাতি দিয়ে মাপা আসলেই সম্ভব?

যেমন আপনার সামনে একটা রিকশা পেইন্টিং আর একটা পিকাসোর পেইন্টিং দাঁড় করানো হলো। আপনি তখন সামান্য দ্বিধা করে কিংবা দ্বিধা না করেই বলবেন, পিকাসোর পেইন্টিং বেশি আর্টিস্টিক জিনিস। আর্টের এসব শ্রেণি-বিভাজন প্রথম শুরু হয় যখন লেখকেরা ১৭০০ সালের দিকে আর্টকে তার গূঢ়ার্থ দ্বারা বিভাজন করতে থাকে। ভিঞ্চির মতো প্রথমদিকের আর্টিস্টরা বলতে শুরু করেন, কিছু আর্ট যেমন পেইন্টিং, স্কেচিং আর ভাস্কর্য শিল্পের দাম বা উচ্চতা বেশি। তারা মনে করতেন, এসব আর্ট করতে দক্ষতা বেশি প্রয়োজন। তাই ইতালিয়ান রেঁনেসার ওই প্যারাগন সময়ে হাই আর্ট আর লো আর্টের বিভাজন এভাবেই শুরু হয়।

সে সময় এ বিষয় অনেক বেশি সমর্থিত না হলেও ধীরে ধীরে পেইন্টিংই হাই-আর্টের জায়গা দখল করে। তখনকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত একাডেমি এ বিষয়টাকে আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রাখে। যারা লাইসেন্স দিত পেইন্টিংয়ের। এই লাইসেন্স না থাকলে পেইন্টিংয়ের মূল্য ছিল না। এসব প্রতিষ্ঠান ট্রেনিং দিত পেইন্টিংয়ের। যেখানে বড় আকারের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার পেইন্টিংই মূল্য পেত। অন্য কথায় বলা যায়, রাজকীয় পেইন্টিং, মিথলজির কোনো ঘটনা, ধর্মীয় বিশেষ ঘটনা, যুদ্ধের ঘটনা, বিশেষ ঘটনা, রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থাকতে হতো পেইন্টিংয়ে। আর না থাকলে জীবনের সাধারণ বিষয়ের ওপর আঁকা পেইন্টিং তাচ্ছিল্য ভরে দেখা হতো।

এসব প্রতিষ্ঠান আর্টের ধারক হয়ে উঠতে থাকলো। তারা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলো আর্টের টেস্ট ও সংজ্ঞা। এককথায় আর্টিস্টের রুচিকেও। এরকম একটা প্রতিষ্ঠান ছিল ফ্রান্সের একাদেমি দে বুয়েক্স-আর্টস, যারা এ ধরণের পেইন্টিংকে (যা এখন একাডেমি পেইন্টিং হিসেবে পরিচিত) আর্টের সর্বোচ্চ স্থানে উঁচুতলার কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতো। ১৯০০ সালের মাঝামাঝি আর্টের অন্য মাধ্যমগুলোর মতো এ ফর্মেও একটা বৈপ্লবিক ধারা আসে। কিছু আর্টিস্ট যেমন, গুস্তাভ করবেট আর অ্যাডুয়ার্ড মানেট যখন এসব প্রতিষ্ঠানের সো-কল্ড আর্টের সংজ্ঞা ছুড়ে ফেলে প্রতিবাদ জানিয়ে উলটো দিকে গিয়ে একটা মুভমেন্ট শুরু করেন। নিজেদের ব্যক্তিগত প্রদর্শনীতে তারা রিজেক্টেড আর্ট অর্থাৎ যেসব আর্টকে এসব প্রতিষ্ঠান লো আর্ট বলে স্বীকৃত করে আসছিল, সেসব আর্ট দেখাতে শুরু করেন।

এ ধারা প্রচুর দর্শক আকর্ষিত হয়। এরপরই আসলে লো আর্ট বলে পরিচিত এসব মধ্যবিত্তীয় জীবনভিত্তিক চিত্রকর্ম লো আর্টের কাতার থেকে উঠে আসে হাই-আর্ট বলে পরিচিত একাডেমি পেইন্টিংয়ের পাশেই। আর আমরা পরিচিত হই রিয়েলিসমের সাথে। এই মুভমেন্টে যেসব পেইন্টিং ধারা ভেঙে নতুন ফর্ম শুরু করেছিল তা-ই আজকের রিয়েলিজম হিসেবে প্রচলিত জনপ্রিয় ধারাটি। পরে কিউবিজম এর প্রচলন ঘটে পিকাসোর সময়। 

বুর্জোয়া টেস্ট সব সময়ই সব কিছুকে শ্রেণিতে বিভাজন করেছে। নিজেদের জিম্মায় আবদ্ধ করতে চেয়েছে আর্টকেও। যদিও আর্টকে আটকাতে পারেনি, তবু এখনও আর্ট আসলে কতটা মুক্ত? কতজন মানুষ আর্টকে তুলনায় নিয়ে যায় না? শুধু আর্ট হিসেবেই দেখে স্বাদ নিতে চেষ্টা করে? ক্ল্যাসিকাল ফেস্ট/ফোক ফেস্টে বসে মাথা দোলানো ক`জন মানুষ আসলেই ক্লাসিক্যাল আর ফোকের খবর জানে বা রাখে বা বোঝে?
নিজেদের ক`জন ক্ল্যাসিকাল/ফোক আর্টিস্টকে চেনে? শুধুমাত্র আজকাল হাই-আর্টের তকমা পেয়ে যাওয়াতে এ ধরণের অনুষ্ঠানে মানুষের ভিড়, সে কথা কে না জানে? জাতে ওঠার জন্য আমরা যখন কোনো বিষয়কে ‘জাত’ চেনানোর প্রতিযোগিতায় নামাই ঠিক তখনই বিষয়টা তেতো হয়ে যায়। রাজা-মহারাজাদের আমল থেকেই গণমানুষের গান, নৃত্য, ছবি, নাটক অবহেলিত, বঞ্চিত। সেগুলো সব সময় লো আর্ট ধরা হয়েছে। এই ধারা ভেঙেছে তবে হাই-আর্টের ধারাতে আমরা এখনো বহু অংশেই যে আটকে আছি তা অস্বীকার করতে পারি না। হাবিবের ফোক গানকে নতুনভাবে তুলে ধরা, লালন ব্যান্ড/লালন নিয়ে গান করা ব্যান্ডগুলোর আত্মপ্রকাশের আগে আমরা ফোক গানকে, লালনকে কতটুকু হাই-আর্ট হিসেবে মূল্য দিয়েছিলাম? আজকাল লালন হাই আর্ট হয়ে উঠেছে। এ কথা বলছি না যে, এসব ব্যান্ডের কন্ট্যাম্পরারি ফোক গান বা লালন-রিপ্রেজেন্টেশন খারাপ কিছু। তবে ওই যে আমরা সব কিছুই চকচকে ঝকঝকের মধ্যে না থাকলে পাত্তা দেই না, জাতে ওঠার মজা পাই না।

সুফি মিউজিক সেই চকচকে ঝকঝকে ব্যাপার ধরার পথে আছে। ধরে ফেললে সবাই সুফি-লাভার হয়ে যাবে নিশ্চিত। পাকিস্তানে সুফি-মিউজিকের প্রচলন বহু পুরোনো। সেখানে বেশিরভাগ ব্যান্ডই সুফি-মিউজিকে ইন্সপায়ারড। অথচ আমাদের কয়টা ব্যান্ড আমাদের বাউল-কালচারে অনুপ্রাণিত? হাতে গোনা। সমস্যাটা আমাদের বহু পুরোনো, পলিটিক্যাল-রিলিজিয়াস ব্যাপারগুলো এখানে উল্লেখযোগ্য। চারিদিকে মেটাল ব্যান্ড। এখন মেটাল গান শুধুমাত্র গানের বাইরেও, যেখানে যুদ্ধ-পরবর্তী সামাজিক দুরাবস্থা, ভাঙা অর্থনীতির ওপর ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয়া একটা ধারা, একটা পুরো ফুঁসে ওঠা প্রজন্মের লাইফ স্টাইলকে ধরে এগিয়েছে। অথচ আমাদের দেশে মেটাল মানেই হার্ড মিউজিক, বাইরের দেশের মেটাল ব্যান্ড ফলো করা, মেটাল মিউজিক যে প্রতিবাদের মিউজিক, এ কথা ক`জন উঠতি মেটাল-হেড ব্যাং প্রজন্ম জানে? ওরা শুধু জানে, বড় চুল রেখে, মদ, গাঁজা, মেটাল গুলিয়ে দিলেই সাচ্চা মেটাল। এদের জ্ঞান আর বোধ লিরিক্স শুনেই বোঝা যায়। এর কারণ, ওই যে  হাই আর্ট। আমরা হাই-ক্লাসের হাই-আর্টে উঠে যেতে চাই। নিজেদের কিছুই নেই, অন্যের জাতে উঠে কিছু জাত চেনাতে ব্যাস্ত আমরা।

চলবে