আশুরা: বাস্তবতা ও পালনীয়-বর্জনীয় বিষয়সমূহ

শেষ পর্ব

তারেকুজ্জামান তারেক

প্রকাশিত : আগস্ট ২৯, ২০২০

দ্বিতীয় অধ্যায়
এ অধ্যায়ে আমরা মুহাররম মাস ও আশুরা দিবস-সংক্রান্ত নানা রুসুম, বিদআত, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মিথ্যা কল্পকাহিনি নিয়ে আলোচনা করব। এ অধ্যায়ের আলোচনা ভালো করে পড়লে মুহাররম মাস ও আশুরা দিবসের বর্জনীয় সকল বিষয়ে আমাদের সম্যক জ্ঞান অর্জন হবে।

আশুরার রাতে বিশেষ সালাত আদায়। যেমন বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরার রাতে ইবাদত করবে সে যেন সাত আসমানের অধিবাসীদের মতো ইবাদত করল। আর যে ব্যক্তি চার রাকআত সালাত আদায় করবে, যার প্রত্যেক রাকআতে একবার সুরা ফাতিহা ও পঞ্চাশবার সুরা ইখলাস পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের পঞ্চাশ বছর ও ভবিষ্যতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তার জন্য সর্বোচ্চ স্তরে এক মিলিয়ন নূরের মিম্বর তৈরি করবেন। আর যে ব্যক্তি কাউকে এক ঢোক পানি পান করাবে সে যেন এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর অবাধ্য হয়নি।

এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি: ২/৯৩; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি: ২/১৫০; তালখিসুল মাওজুআত, জাহাবি: ১/১৮৪

আশুরা দিবসের বিশেষ সালাত আদায়। যেমন বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে জোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে চার রাকআত সালাত আদায় করবে, যার প্রত্যেক রাকআতে একবার সুরা ফাতিহা, দশবার আয়াতুল কুরসি, এগারোবার সুরা ইখলাস, পাঁচবার করে সুরা ফালাক ও নাস পড়বে, অতঃপর সালাম ফিরানোর পর আল্লাহর নিকট সত্তরবার ইসতিগফার করবে, আল্লাহ তাআলা জান্নাতুল ফিরদাউসে তাকে একটি শ্বেত অট্টলিকা দান করবেন, যার মাঝে সবুজ জামরাদ পাথরের তৈরি একটি ঘর থাকবে, যার আয়তন হবে তিন পৃথিবীর সমপরিমাণ।

এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি: ১/৪৭; আল-আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি: ১/৪৭৪; আল-আসারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মাওজুআ, লাখনৌবি: ১/৯০; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি: ২/৪৬; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি: ২/৮৯

সালাতুল খাসমা নামের বিশেষ সালাত আদায়। যেমন বর্ণিত হয়েছে, সালাতুল খাসমা, যা আশুরা দিবসে চার রাকআত সালাতকে বলে। এটা ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি: ১/১১১; কিতাবুল কাসসাস ওয়াল মুজাক্কিরিন, ইবনুল জাওজি: ১/৩১২

প্রয়োজন পূরণের জন্য বিশেষ সালাত আদায়। যেমন বর্ণিত হয়েছে, আশুরা দিবসের সালাত ছয় রাকআত। প্রথম রাকআতে সুরা ফাতিহার পর সুরা শামস, দ্বিতীয় রাকআতে সুরা কদর, তৃতীয় রাকআতে সুরা জিলজাল, চতুর্থ রাকআতে সুরা ইখলাস, পঞ্চম রাকআতে সুরা ফালাক, ষষ্ঠ রাকআতে সুরা নাস। অতঃপর সালামের ফিরিয়ে সিজদা দেবে এবং সাতবার সুরা কাফিরুন পড়ে আল্লাহর নিকট প্রয়োজন পূরণের দুআ করবে। এটিও ভিত্তিহীন একটি বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-আসারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মাওজুআ, লাখনৌবি: ১/১১০

আশুরার বিশেষ সালাত আদায়। যেমন বর্ণিত হয়েছে, ইশরাকের সময় দুই রাকআত সালাত আদায় করবে। প্রথম রাকআতে সুরা ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসি এবং দ্বিতীয় রাকআতে লাও আনজালনা হাজাল কুরআনা থেকে সুরা হাশরের শেষ পর্যন্ত পড়বে। সালামের পর বলবে, ইয়া আউয়ালাল আউওয়ালিন, ইয়া আখিরাল আখিরিন, লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাকতা আউয়ালা মা খালাকতা ফি হাজাল ইয়াউমি ওয়া তাখলুকু আখিরা মা তাখলুকু ফি হাজাল ইয়াউমি, আ’তিনি ফিহি খাইরা মা আ’তাইতা ফিহি আম্বিয়াআকা ওয়া আসফিয়াআকা মিন সাওয়াবিল বালায়া ওয়া আসহিম লানা মা আ’তাইতাহুম ফিহি মিনাল কারামাতি বিহাক্কি মুহাম্মাদিন আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা। (দেখুন, প্রাগুক্ত)

ৎআশুরার শেষ রাতের সালাত। যেমন বর্ণিত হয়েছে , আশুরার শেষ রাতের সালাত হলো চার রাকআত, যার প্রত্যেক রাকআতে ফাতিহার পর আয়াতুল কুরসি তিনবার, সুরা ইখলাস এগারোবার এবং সালাত শেষে সুরা ইখলাস একশবার। এটা ভিত্তিহীন বর্ণনা। (দেখুন, প্রাগুক্ত)

আরেকটি বিশেষ সালাত। যেমন বর্ণিত হয়েছে, আশুরার রাতের সালাত হলো একশ রাকআত। প্রত্যেক রাকআতে সুরা ফাতিহার পর তিনবার করে সুরা ইখলাস পড়বে। এটাও ভিত্তিহীন বর্ণনা। (দেখুন, প্রাগুক্ত)

আশুরার সিয়ামে দশ হাজার শহিদের সওয়াব। যেমন বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করবে, তাকে দশ হাজার শহিদের সওয়াব দেওয়া হবে। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-মাওজুআত, ইবনুল জাওজি: ২/১১৪; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি: ১/৯৪; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি: ২/৯৪; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি: ২/১৪৯

আশুরার সিয়ামে দশ হাজার ফেরেশতার সওয়াব। যেমন বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করবে, তাকে দশ হাজার ফেরেশতার সওয়াব দেওয়া হবে। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি: ১/৯৬; আল-মাওজুআত, ইবনুল জাওজি: ২/১১৪; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি: ১/৯৪; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি: ২/৯২, তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনে ইরাক কিনানি: ২/১৪৯

আশুরার সিয়ামে ষাট বছরের ইবাদতের সওয়াব। যেমন বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য ষাট বছরের ইবাদতের সওয়াব লিখে দেবেন।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-মাওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/২০২; আল-আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : পৃ. নং ৪০২; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/১০৮; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি : ২/১৪৯

আশুরার সিয়ামের নানারকম ফজিলত। যেমন বর্নিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করবে, তাকে হজকারী ও উমরাকারীর সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরার সিয়াম পালন করবে, তাকে সাত আসমান ও তাতে অবস্থানরত সকল ফেরেশতার সওয়াব দেওয়া হবে। আশুরা দিবসে যার নিকট বসে কোনো মুমিন ইফতার করবে, তার কাছে যেন উম্মতে মুহাম্মাদির সকলেই ইফতার করল। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো ক্ষুধার্তকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে, সে যেন উম্মতে মুহাম্মাদির সকল দরিদ্রের পেট ভরিয়ে দিল। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো এতিমের মাথার হাত বুলিয়ে দিল, তার প্রতিটি চুলের বিনিময়ে জান্নাতে তার একটি করে মর্যাদা সমুন্নত হবে।’
ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, কিতাবুল মাজরুহিন, ইবনু হিব্বান : ১/২৬৫; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৪; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯২; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি : ২/১৪৯

বনের পশুরাও আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করে। যেমন বর্ণিত হয়েছে, নিশ্চয় বন্য জন্তু-জানোয়ারেরাও আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করে। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, তাজকিরাতুল মাওজুআত, ইবনু তাহির পাটনি : পৃ. নং ১১৮; আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৮; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৪; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি : ২/১৫৬

পাখিদের মধ্যে কাঠঠোকরা পাখি প্রথম আশুরার সিয়াম পালন করেছে। যেমন বর্নিত হয়েছে, নিশ্চয় পাখিদের মধ্যে প্রথম কাঠঠোকরা পাখি আশুরার সিয়াম পালন করেছে। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, কাশফুল খাফা ওয়া মুজিলুল ইলবাস : ২/৫৫৫; আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৭; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি : ২/১৫৬; আল-আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : পৃ. নং ৪১৫

আশুরা দিবসে গোসল করলে কোনো রোগ হবে না। যেমন বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে গোসল করবে, সে মৃত্যু ছাড়া কোনো রোগে আক্রান্ত হবে না। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-মাওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৩; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৭; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি : ২/১৫১

আশুরা দিবসে গরিব-মিসকিনদের খানা খাওয়ালে পুলসিরাত বিদ্যুৎ গতিতে পার হওয়া যাবে। যেমন বর্নিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে দরিদ্র লোকদের পরিবারকে তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াবে, সে বিদ্যুতের ন্যায় পুলসিরাত অতিক্রম করবে। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-মাওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৩; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৭; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি : ২/১৫১

আশুরা দিবসে রোগীর দেখাশোনা করলে সমগ্র মানবজাতির শুশ্রূষার সওয়াব পাওয়া যায়। যেমন বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো অসুস্থের সেবা-শুশ্রূষা করল, সে যেন আদম-সন্তানের সকল অসুস্থ লোকেরই সেবা-শুশ্রূষা করল। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-মাওজুআত, ইবনুল জাওজি : ২/১১৪; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৭; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৩; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি : ২/১৫১

আশুরা দিবসে সুরমা ব্যবহার করলে প্রদাহজনিত রোগ হবে না। যেমন বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে চোখে সুরমা লাগাবে, তার চোখ সারাবছরে প্রদাহগ্রস্থ হবে না। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, কাশফুল খাফা ওয়া মুজিলুল ইলবাস, আজালুনি : ২/৩০৬; আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৯৮; আল-আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি : পৃ. নং ৩৩২; আত-তাজকিরা ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরা, জারকাশি : ১/১৫৯

আশুরা দিবসে হুসাইন রা.-এর শাহাদাতে কান্না করলে কিয়ামতের দিন সে শীর্ষস্থানীয় আম্বিয়ায়ে কিরামের সাথে থাকবে। যেমন বর্ণিত হয়েছে, কোনো বান্দা হুসাইন রা.-এর শাহাদতের দিন তথা আশুরা দিবসে কান্না করলে সে কিয়ামতের দিন অবশ্যই শীর্ষস্থানীয় আম্বিয়ায়ে কিরামের সাথে থাকবে। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ, শাওকানি : ১/৪৪০; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি : ২/৩৯; লিসানুল মিজান, ইবনু হাজার : ২/৪৫১

আশুরা দিবসে আল্লাহ অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং বিভিন্ন নবিদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা আশুরা দিবসে কলম সৃষ্টি করেছেন, লাওহে মাহফুজ সৃষ্টি করেছেন, জিবরাইল আ.-কে সৃষ্টি করেছেন, অন্যান্য সকল ফেরেশতাকে সৃষ্টি করেছেন, আদম আ.-কে সৃষ্টি করেছেন, ইবরাহিম আ. জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁকে আগুন থেকে মুক্তি দিয়েছেন, ইসমাইল আ.-কে জবেহ থেকে মুক্তি দিয়েছেন, ফিরআউনকে নিমজ্জিত করেছেন, ইদরিস আ.-কে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন, আদম আ.-এর তাওবা কবুল করেছেন, দাউদ আ.-এর ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন, সুলাইমান আ.-কে রাজত্ব দান করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন, আল্লাহ তাআলা আরশে সমুন্নত হয়েছেন এবং কিয়ামতও এদিনেই সংঘটিত হবে।

এসবই ভিত্তিহীন বর্ণনা। তবে ফিরআউনের নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাটি বিশুদ্ধ। বিস্তারিত দেখুন, কিতাবুল মাজরুহিন, ইবনু হিব্বান: ১/২৬৬; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি: ১/৯৪; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি: ২/৯৩; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি: ২/১৪৯; আল-মাওজুআত, ইবনুল জাওজি: ২/১১৫

আশুরা দিবসে আসমান-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন বর্নিত হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা আসমান ও জমিন আশুরা দিবসে সৃষ্টি করেছেন। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-মানারুল মুনিফ, ইবনু কাইয়িম জাওজিয়া: ১/৫২; কাশফুল খাফা ওয়া মুজিলুল ইলবাস, আজালুনি: ২/৫৫৭; আল-আসরারুল মারফুআ, মুল্লা আলি কারি: পৃ. নং ৪২৭; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি: ১/৯৪; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি: ২/৯৩, আল-মাওজুআত, ইবনুল জাওজি: ২/১১৪

আশুরা দিবসে বিভিন্ন নবিদের বিপদাপদ ও কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে, আশুরা দিবসে আদম আ.-এর তাওবা কবুল হয়েছে, নূহ আ.-এর জাহাজ জুদি পাহাড়ে গিয়ে স্থির হয়েছে, ইয়াকুব আ.-এর নিকট ইউসুফ আ.-কে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ইবরাহিম আ.-কে আগুন থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, আল-মাজমুউল ফাতাওয়া : ২৫/৩০০; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৬; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/১০৯; তানজিহুশ শারিআতিল মারফুআ, ইবনু ইরাক কিনানি : ২/১৪৮

ছয়মাস পানিতে ভাসার পর আশুরা দিবসে নুহ আ.-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে গিয়ে থামে। যেমন বর্ণিত হয়েছে, রজবের প্রথম তারিখে নুহ আ. নৌকায় আরোহণ করেন। অতঃপর তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা সবাই সিয়াম পালন করেন। তাদেরকে নিয়ে নৌকা ছয় মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। মুহাররম মাসে গিয়ে এর চলা বন্ধ হয় এবং আশুরা দিবসে জুদি পাহাড়ে গিয়ে নৌকা স্থির হয়। অতঃপর নুহ আ. আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সিয়াম পালন করলেন এবং তাঁর সাথে থাকা সকল মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারকেও সিয়াম পালন করতে আদেশ করলেন। ভিত্তিহীন বর্ণনা। বিস্তারিত দেখুন, মিজানুল ইতিদাল, জাহাবি : ৫/৬২; আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৬; আল-লাআলিল মাসনুআ, সুয়ুতি : ২/৯৯

‘আল-মাওজুআতুল কুবরা’-এর বর্ণনায় একসাথে এমন অনেক ভিত্তিহীন বিষয় বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের ওপর বছরে একদিন কেবল আশুরা দিবসের সিয়াম আবশ্যক করেছিলেন। আর আশুরা হলো মুহাররমের দশ তারিখ। অতএব তোমরা এদিনে সিয়াম পালন করো এবং তোমাদের পরিবারের জন্য খরচে প্রশস্ততা অবলম্বন করো। কেননা, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে স্বীয় সম্পদ থেকে নিজ পরিবারের খরচে প্রশস্ততা করবে, তার সারা বছরে প্রশস্ততা দান করা হবে। অতএব তোমরা এ দিবসে সিয়াম পালন করো। কেননা, এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা আদম আ.-এর তাওবা কবুল করেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইদরিস আ.-কে উচ্চ আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম আ.-কে (নমরুদের) আগুন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা নুহ আ.-কে জাহাজ থেকে বের করে এনেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা মুসা আ.-এর ওপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন। এদিনেই আল্লাহ তাআলা ইসমাইল আ.-কে জবেহ হওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তা
আলা ইউসুফ আ.-কে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইয়াকুব আ.-এর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা আইয়ুব আ.-কে বিপদমুক্ত করেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা ইউনুস আ.-কে মাছের পেট থেকে বের করেছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রের মাঝ দিয়ে পথ করে দিয়েছেন। এটা এমন একটি দিন, যেদিনে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগে-পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। এদিনেই মুসা আ. সমুদ্র অতিক্রম করেছেন। এদিনেই আল্লাহ তাআলা ইউনুস আ.-এর সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি এদিনে সিয়াম পালন করবে, তার জন্য এটা চল্লিশ বছরের গুনাহের কাফফারা হবে। আশুরা দিবসেই আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর জন্য প্রথম দিন সৃষ্টি করেছেন। আশুরা দিবসেই আকাশ থেকে প্রথম বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে। আশুরা দিবসেই প্রথম রহমত অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি আশুরার সিয়াম পালন করবে, সে যেন সারা বছরই সিয়াম পালন করল। এটা সকল নবিদের সিয়াম। যে ব্যক্তি আশুরার রাতে ইবাদত করবে, সে যেন সাত আসমানের অধিবাসীদের মতো ইবাদত করল। আর যে ব্যক্তি চার রাকআত সালাত পড়বে, যার প্রত্যেক রাকআতে একবার সুরা ফাতিহা ও পঞ্চাশবার সুরা ইখলাস পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের পঞ্চাশ বছর এবং ভবিষ্যতের পঞ্চাশ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তার জন্য সর্বোচ্চ স্তরে এক মিলিয়ন নুরের মিম্বর তৈরি করবেন। যে ব্যক্তি কাউকে এক ঢোক পানি পান করাবে, সে যেন এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর অবাধ্য হয়নি। আর যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে মিসকিনদের পরিবারকে তৃপ্তি সহকারে আহার করাবে, সে পুলসিরাত বিদ্যুতের ন্যায় অতিক্রম করবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সদকা করবে, সে যেন কখনো কোনো ভিক্ষুক ও প্রার্থীকে খালী হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে গোসল করবে, সে মৃত্যু ছাড়া কোনো রোগে আক্রান্ত হবে না। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে চোখে সুরমা লাগাবে, তার চোখ সারা বছরে প্রদাহগ্রস্থ হবে না। যে ব্যক্তি কোনো এতিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে, সে যেন মানবজাতির সকল এতিমের সাথে সদ্ব্যবহার করল। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করবে, তাকে দশ হাজার ফেরেশতার সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করবে, তাকে এক হাজার হজকারী ও উমরাকারীর সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করবে, তাকে এক হাজার শহিদের সওয়াব দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করবে, তার জন্য সাত আসমান সমপরিমাণ পূণ্য লেখা হবে। এদিনেই আল্লাহ তাআলা আসমান, জমিন, পাহাড় ও সাগর সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই আরশ সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই কলম সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই লাওহে মাহফুজ সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই জিবরাইল আ.-কে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আশুরা দিবসেই ইসা আ.-কে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। তিনি আশুরা দিবসেই সুলাইমান আ.-কে রাজত্ব দান করেছেন। আশুরা দিবসেই কিয়ামত হবে। যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে কোনো অসুস্থের সেবা-শুশ্রূষা করল সে যেন আদম-সন্তানের সকল অসুস্থ লোকেরই সেবা-শুশ্রূষা করল।’ (আল-মওজুআত, ইবনে জাওজি : ২/২০০-২০১, প্রকাশক : মুহাম্মাদ বিন মুনির, মদিনা)

হাদিসটি বর্ণনা করে ইমাম ইবনুল জাওজি রহ. বলেন, এ হাদিসটি মওজু হওয়ার ব্যাপারে কোনো বিবেকবান সন্দেহ পোষণ করতে পারে না। (প্রাগুক্ত)

সিহাহ সিত্তা ও অন্যান্য সহিহ বর্ণনাসমূহ থেকে যতটুকু বিশুদ্ধ বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে তা হলো, আল্লাহ তাআলা আশুরা দিবসে মুসা আ.-কে ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনীর কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফিরআউন ও তার সঙ্গীসাথীরা নিমজ্জিত হয়ে মারা গিয়েছে। এ কারণেই ইহুদিরা এদিনে সিয়াম পালন করত এবং এটাকে তারা তাদের ইদ ও উৎসবের দিবসে পরিণত করেছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার পর ইহুদিদের সিয়াম পালন করতে দেখে তিনি নিজেও সিয়াম পালন করেছেন এবং সাহাবিদেরও সিয়াম পালন করতে আদেশ দিয়েছেন; একথা বলে যে, আমরা তোমাদের (ইহুদিদের) চেয়ে মুসা আ.-এর অধিক নিকটতর। অবশ্য এদিনে ইদ উৎসব করতে নিষেধ করেছেন। ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য হওয়া থেকে বাঁচার জন্য আশুরার আগে বা পরে আরও একটি সিয়াম পালনের আদেশ দিয়েছেন। এছাড়াও ইবনে রজব রহ.-এর “লাতাইফুল মাআরিফ” ও অন্যান্য আরও বর্ণনা থেকে সাব্যস্ত হয় যে, আল্লাহ তাআলা এদিনে আদম আ.-এর তাওবা কবুল করেছেন। অন্য আরেকটি বর্ণনা থেকে সাব্যস্ত হয় যে, নুহ আ.-এর নৌকা আশুরা দিবসে জুদি পাহাড়ে গিয়ে স্থির হয়; যেমনটি ইমাম আহমাদ রহ., ইমাম আবুশ শাইখ রহ., ইমাম ইবনে মারদুয়া রহ., ইমাম ইবনে জারির রহ., ইমাম আসবাহানি রহ. প্রমূখের উদ্ধৃতিতে দুররে মানসুর ইত্যাদি গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম আসবাহানি রহ.-এর বর্ণনায় “আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব” গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, ইসা আ.-এর জন্মদিন হলো আশুরা দিবস; যেমনটি দুররে মানসুরে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য যেসব দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে, যাতে পূর্বের এবং ভবিষ্যতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আশুরা দিবসে হওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে, এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। যদিও অনেক ইতিহাসবিদ ও বুযুর্গগণ স্ব স্ব গ্রন্থে এসব ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যেমন ফকিহ আবুল লাইস রহ. তামবিহুল গাফিলিন ও বুসতান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এদের এসব বর্ণনার দ্বারা ধোঁকায় নিপতিত হয়ো না। কেননা, এসব ক্ষেত্রে শুধু বর্ণনার উল্লেখই যথেষ্ট নয়; বরং এসবের পূর্ণ তদন্তের পরই তা গ্রহণযোগ্য হয়।’ (আল-আসারুল মারফুআ, লাখনৌবি : ১/৯৫-৯৬, প্রকাশনী : মাকতাবাতুশ শারকিল জাদিদ, বাগদাদ)

উল্লেখ্য যে, নবিদের মধ্যে কেবল মুসা আ.-এর ঘটনাই বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত। আর আদম আ.-এর তাওবা কবুল হওয়া, নুহ আ.-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে স্থির হওয়া এবং ইসা আ.-এর জন্মের কথা দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। তবে এ দুর্বলতা মারাত্মক পর্যায়ের না হওয়ায় ইতিহাসের ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া বাকি অন্যান্য ঘটনার কোনো ভিত্তি নেই।