ইংরেজি দিয়ে না বললে বাঙালি বাংলাই বোঝে না
হামীম কামরুল হকপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
বাংলা কথায় এত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছি! অবশ্যই ব্যবহার করব। যেখানে বাংলা শব্দ নেই, সেখানে ব্যবহার করতেই হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা হলো বিশেষ্য; যেমন কম্পিউটার, মাউস, মোবাইল, এমন যা যা, কিন্তু ক্রিয়াবাচক শব্দগুলিও ইংরেজিতে বলতে হবে? বিশেষ করে যেগুলির সুন্দর বাংলা রয়েছে।
বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার প্রায় দুই লাখ। এটা তো ভুলে গেলে চলবে না। অথচ সেই ভাণ্ডারের দিকে নজর ক’জনের? সুন্দর সুন্দর শব্দ বাংলায় পড়ে আছে। আদতে নিজের ভাষায়ই সব বলা যায়। কিন্তু কে বলুন এত কষ্ট করে! এদিকে সবার সাধ্যমতো তিন-চারটে ভাষা শেখার দরকার, সেখানে আগ্রহ প্রায় শূন্য!
ভালো ইংরেজি বলতে পারা ও লিখতে পারা লোকের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। খুব কম লোক পাওয়া যাবে যারা বাংলা ও ইংরেজি সমান তালে শুদ্ধ করে লিখতে পারে। এখন তো বলে, এত শুদ্ধতার কী দরকার? এখন উত্তরাধুনিকতার দরবার খুলেছে একেকজন বাংলাদেশি খাজাবাবা! উত্তরাধুনিক কায়দায় চলবে সব! আপনাদের সমস্যা আছে?
ফলে কারণে-অকারণে ইংরেজিই ভরসা। লেখকরা সাহিত্যিকরা যেখানে বাংলা শব্দ সহজ সুন্দরভাবে যায়, সেখানেও সাঁটিয়ে দিচ্ছেন ইংরেজি। বোধ করি, এই ধরনটি এসেছে ভারত থেকে, হিন্দিভাষীদের কথায় কথায় ইংরেজি যোগ, সেই সঙ্গে কলকাতার বাঙালিদের কাছ থেকেও। আমরা তো আগে এত ইংরেজি ব্যবহার করতাম না। কবিতায় লিখছে ‘‘বৃষ্টির ড্রপ লেট’’। মুখে বলছি সারাক্ষণ, হ্যালো ভিউয়ার্স, থ্যাংকস ফর ওয়াচিং, সো, বাট, মেইবি, অ্যাকচুয়েলি, ব্রেক আপের চেয়ে ‘ছাড়াছাড়ি’ বা ‘সম্পর্ক শেষ’— ভালো লাগে না শুনতে!
আর টিভি অনুষ্ঠানগুলি দেখুন, সারাক্ষণ ইংরেজি কপচে যাচ্ছে। যারা ব্যাণ্ডসংগীত গায়, তারা কথা বলে চার ভাগের তিন ভাগ ইংরেজিতে। গায় বাংলা গান। নাটকের নাম, সিনেমার নাম ইংরেজিতে। এসব কী শুরু হলো? এটা কি ঔপনিবেশিক মানসকাঠামোর ফল? আমরা যে ইংরেজের গোলাম ছিলাম, তার প্রমাণ কি প্রতি পদে দিতে হবে? নাকি নিজেকে নব্যশিক্ষিত প্রমাণের হিড়িক? গল্প উপন্যাসের নামও দিচ্ছে লোকে ইংরেজিতে! অথচ আমি জানি না, একটাও প্রমাণ মিলবে কিনা যে, একজন ইংরেজ/আমেরিকান তার গল্প উপন্যাসের নাম বাংলায় বা হিন্দিতে রেখেছেন! কে জানে, আমিই প্রলাপ বকছি হয়তো। বাকিরা সবাই ঠিকই আছেন।
রুশদের অতি ফরাসি-প্রীতির বিপরীতে দাঁড়াতে গিয়েই কয়েকটা প্রজন্ম পুশকিন থেকে চেখভ (মাঝে গোগল, তুর্গেনেভ, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় আরো আছেন) তারা নিজেদের ভাষার সক্ষমতা, সামর্থ্য বাড়িয়ে দেখিয়েছিলেন— রুশেই সব বলা যায়, সুন্দর করে বলা যায়। মহাকবি ফেরদৌসী তার এত বিশাল `শাহনামা`তে একটি মাত্র আরবি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, আহসান। এছাড়া পুরোটা ফারসিতে লেখা। ভাবা যায়! তৈরি হয়েছিল ইরানি জাতীয়তাবাদের বীজ!
ফরাসি ঔপন্যাসিক জর্জ পেরেক ফরাসিতে সবচেয়ে ব্যবহৃত শব্দ e বাদ দিয়ে পুরো একটা উপন্যাস ‘লা দিপারিশঁ’ (১৯৬৯) লিখেছিলেন। একটি শব্দে e নেই। এমনকি এর যে ইংরেজি অনুবাদ হলো A Void (১৯৯৪) তাতেও e পাওয়া যাবে না একটি শব্দেও। আর আমরা একটি বাক্য এখন ইংরেজি ছাড়া বলতে পারি না, ভাবা যায়!
বাঙালি এখন ইংরেজি দিয়ে কথা না বললে বাংলাই বোঝে না। কষ্ট হয়! সিনেমা হলের বাংলা হয়েছিল প্রেক্ষাগৃহ। ছোটবেলায় মাইকিং হতো, ঢাকা নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের অভিজাত প্রেক্ষাগৃহে মু্ক্তি পাচ্ছে রাজ্জাক-ববিতা অভিনীত অনন্তপ্রেম— মনে পড়ে? এত কঠিন শব্দ `প্রেক্ষাগৃহ` দিব্যি খাপ খেয়ে গিয়েছিল। নিজের ভাষা কঠিন বলে তা ব্যবহার না করে অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করব— এটাই আমাদের ধরন গড়ন। ভারতচন্দ্র বলেছিলেন, প্রসাদগুণের জন্য যেকোনো ভাষার শব্দ আনা যায়। কিন্তু তাই বলে নিজের কবিতার বইয়ের নাম, নাটকের নাম, উপন্যাসের নাম, সিনেমার নামে এত ইংরেজি! সব ভাষা মিশ্র, তাও মানি। কিন্তু যে ভাষায় যে শব্দ ঢোকে তা সেই ভাষার হয়ে যায়, মনেই হয় না ভিন্ন; কিন্তু ‘হয়তো’র মতো এত সহজ শব্দ থাকার পরও লোকে ‘মেই বি কেন বলে! আমাদের আদরের ডাকও এখন বেইবি। হাঃ হাঃ হাঃ!
লেখক: কথাসাহিত্যিক
























