ড. আজফার হোসেন

ড. আজফার হোসেন

ইউরোপই বিশ্ব নয়, এই বোধ যত সঞ্চারিত হয় তত ভালো

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৯, ২০২০

কয়েক মাস আগে হঠাৎ করেই ‘কবিতার নিবিড় পাঠ ও অর্থের অস্থিরতা’ নামে আমার একটি লেখা কী মনে করে যেন কয়েকজন সাহিত্য ও কাব্যবোদ্ধাকে ট্যাগ করলাম। লেখাটি আসলে তৈরি করেছিলাম কবিতা বিষয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ করা আমার খণ্ড খন্ড রচনাকে জুড়ে দিয়ে। লেখাটিকে প্রাসঙ্গিক করতে দুই-চার লাইন এদিক সেদিক সংযুক্তও করেছিলাম। তো, যেটি বলার জন্যে এই কাহন, সেটি হলো লেখাটিতে ট্যাগ করার কিছুক্ষণ পর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমেরিকা থেকে ভিডিও কল দিলেন অধ্যাপক লেখক তাত্ত্বিক ড.আজফার হোসেন। কথা হলো প্রায় আধঘণ্টার বেশি সময়।

তিনি শ্রেণিকক্ষে আমার সরাসরি শিক্ষক নন, কিন্তু আমার শিক্ষকদের শিক্ষক তিনি। সেই হিসেবে আমারও শিক্ষক। অত্যন্ত আন্তরিক ও সপ্রাণ মানুষ। ভরাট গলা। কণ্ঠে তার তারুণ্য ঝরে পড়ে। শক্তিশালী ও চমক জাগানো বাক্য গঠন তার, যেমন লেখায়, তেমনি বাচনেও। তার লেখা পড়া বা তাকে শোনা মানেই কিছু নতুন তথ্য বা চিন্তার সাথে পরিচিতির সুযোগ। স্যার আমাকে জানালেন, টেক্সচুয়াল যে এনালাইসিসকে আমি নিবিড় পাঠ বলছি, সেটা ঠিকই আছে, তবে সমাজতাত্ত্বিক পাঠও নিবিড় পাঠ হতে পারে। আর, সমাজতাত্বিক পাঠ মোটেই কাব্যের উপভোগে বিঘ্ন ঘটায় না। এই কথাটি গুরুত্বপূর্ণ লেগেছে যে, সমাজতাত্ত্বিক পাঠও নিবিড় পাঠ হতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে আমার নিজের সাহিত্য ভাবনা, প্রকৃত প্রস্তাবে, স্যারের ভাবনা থেকে দূরবর্তী নয়।

উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক, জেমস জয়েসের বিখ্যাত গল্প Araby। এই গল্পে সদ্য কৈশোরে উপনীত হওয়া এক বালকের মনে নারীর প্রতি অদ্ভুত এক সর্বপ্লাবী ভালোলাগার বর্ণনা আছে, আছে  নারী শরীরের প্রতি তার অসংজ্ঞায়িত মুগ্ধতার কথা, আর বন্ধুর ওই বোনের প্রতি বুকচেরা এক আকুল আচ্ছন্নতা। এই প্রেম, ভালোলাগা বা যৌবনের সদ্যপ্রস্ফুটনের বয়ানের ভেতরেও জয়েস লুকিয়ে রেখেছেন আইরিশ জীবনের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আরেক গল্প, যে বাস্তবতা তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গ ঘটায়। গল্পে থাকা জাস্ট কয়েকটি শব্দ—  যেমন: ডাবলিনের বাজারে এক গায়কের গানে ওডোনোভা রোসা নামক আইরিশ বিপ্লবীর উল্লেখ এবং এরাবি`র মেলায় সেলসগার্লের ইংলিশ এক্সেন্টে কথা বলা— জানিয়ে দেয় আয়ারল্যান্ডে  ব্রিটিশ উপনিবেশের জেঁকে বসা আর আইরিশদের ক্ষোভ ও বেদনার কথা।

এভাবে গল্পটির ‘সমাজতাত্ত্বিক’ ব্যাখ্যা গল্পপাঠের আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করে। গল্পটির পোস্টকলোনিয়াল ভাষ্য বেশ জনপ্রিয়ও আজকাল। আবার, গল্পটিতে ধর্মীয় প্রসঙ্গের উপস্থিতি ও বিবেচনা গল্পটিকে নিয়ে যেতে পারে অর্থের আরেক স্তরে। হাতের কাছে অবশ্য কবিতার উদাহরণও আছে আমার। যেমন— E.B Browning এর How do I love thee কবিতাটি। এই কবিতায় কবি তার `স্বামী`র প্রতি এক তীব্র আকুতিভরা ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। ভালোবাসাকে স্বর্গীয়, প্রায় দেহাতীত, ভাবগম্ভীর ও শাশ্বতের অনুভব দিতে তিনি ব্যবহার করেছেন বেশ কিছু ধর্মীয় শব্দ ও অনুষঙ্গ। একটা জায়গায় কবি বলছেন, I love thee freely as men strive for Right। এই খানে রাইট ও ফ্রীলি শব্দদ্বয়ের একাধিক অর্থ হতে পারে। তবে, এই ঘটনাকে যদি মনে রাখি যে, ব্রিটিশ  উপনিবেশগুলোতে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দানা বাঁধছিল নিজেদের অধিকারের জন্যে সংগ্রাম, তখন ‘আমি তোমাকে মুক্তভাবে ভালবাসি যেভাবে মানুষ লড়ে অধিকারের জন্যে’ এই বাক্যটি ধারণ করে ফেলে সেই প্রবল আকুলতা ও আত্মনিবেদনের উদগ্রতা, যা প্রকাশিত হয় উপনিবেশ-বিরোধী নানারূপের সংগ্রামে।

এভাবে কিছু ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক অনুষঙ্গও যে কবিতার পদের আবডালে লুকিয়ে থাকে, তার উদ্ধার আনন্দকে বাড়ায়ই বটে। উদাহরণ হিশেবে ইংরেজি কবিতা না এনে ইউরোপের বাইরে যে আরো আরো কত কত কবিতা রচিত হচ্ছে তার দিকেও নজর ফেরাতে বললেন স্যার। আমি নিজেও সদাই মনে করি, মনোজগতে যেন শুধু ইউরোপ জাঁকিয়ে না বসে এই সতর্কতা আসলেই জরুরি। ইউরোপই বিশ্ব নয়, এই বোধ যত দ্রুত সঞ্চারিত হয় তত ভালো। আজফার স্যার বললেন, আগাম্বেন-জিজেক-বাডিয়ু এই ‘ত্রয়ী’ বর্তমান পৃথিবীতে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পৃথিবীর অন্যত্র যে মানুষ জরুরি চিন্তা করছে না, এমন নয়। তিনি এক ফাঁকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন Enrique Dussel এর Ethics of Liberation নামের ভারি বইটির সাথে। ডুসেল আর্জেনটিনিয়ান-মেক্সিকান চিন্তক। সূচিপত্রও পড়ে শোনালেন। জানালেন বইটি কেউ বাংলায় অনুবাদ করলে কাজের হতো। এনরিক ডুসেলের নাম আগে শুনিনি, তার কিছু পড়াও হয়নি। হয়তো ডুসেলের কিছু পড়বার আগ্রহ জন্মাবে।

চিন্তাযানে আমরা যে  লেখার একাডেমিক হওয়াকে গুরুত্ব দেই, এ বিষয়ে তিনি তার ভিন্নচিন্তা জানালেন। একাডেমিক বিষয়টাকেই প্রশ্নের মধ্যে রাখা দরকার বলে তিনি মনে করেন। একাডেমিক রেফারেন্স ছাড়াও বা কঠোর একাডেমিক নীতিপদ্ধতি না মেনেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী চিন্তা হাজির করা সম্ভব, এমন অনেক নজির আছে। স্যার উদাহরণ দিলেন ওল্টার বেনিয়ামিনের ইতিহাসবিষয়ক সূত্রাবলি বা Theses on History প্রবন্ধটির, যেটি সরাসরি একাডেমিক পদ্ধতিতে রেফারেন্সিং করে লেখা নয়। চিন্তার সামর্থটুকু উদ্ধার করা জরুরি, লেখা একাডেমিক হতেই হবে এমনটা দৃঢ় না হওয়া ভালো। অবশ্য চিন্তাযানে সেমিএকাডেমিক বা নন-একাডেমিক লেখাও আমরা ছাপিয়েছি, চিন্তা বা পর্যালোচনা সামর্থের উদ্ভাস লক্ষ্য করেছি বলে।

আমার সম্পর্কেও কিছু অবলোকন হাজির করলেন স্যার, সেগুলো প্রশংসামূলক বলে লিখছি না এখানে। তবে স্যারকে ধন্যবাদ এত সুন্দর করে বলার জন্যে। স্যারের নতুন বই, চিন্তাযানের অনাগত সংখ্যাগুলোর জন্যে কিছু টপিকের কথাও বললেন তিনি। ‘ইসলাম ও মার্ক্সবাদ’ বা ‘ইসলাম ও পাশ্চিমাচিন্তা’ নিয়ে সংখ্যাও হতে পারে বলে পরামর্শ দিলেন। দেশে এলে অনেক কাজ করা যাবে বলে আন্তরিকভাবে জানালেন। মুগ্ধ হলাম তার বিনয় ও আন্তরিকতায়। আরো আরো অনেক কথা হলো। এমন দিলখোলা, নিরহংকার ও সামাজিক মানুষ তিনি, আশ্চর্য হতে হয়। কিছুটা ভিন্নমত ও মতাদর্শের মানুষও তার আন্তরিকতা ও ভালোবাসার উষ্ণতা থেকে বঞ্চিত হয় না। স্যারের জন্যে শ্রদ্ধা ও শুভকামনা।

ড.আজফার হোসেন এমন মানুষ যিনি কখনো প্রাণখুলে  প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেন না। ছোট-বড় সবাইকে সম্মান করতে জানেন তিনি আশ্চর্য আন্তরিকতায়; উৎসাহিত ও উদ্দীপিত করতে জানেন মনোমুগ্ধকর শব্দাবলিতে। এই দীপ্তিময় মানুষটিকে আল্লাহতায়ালা দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন, এই প্রার্থনা। সামনে মাসেই স্যারের নতুন বই বেরুচ্ছে, সেটি নিয়ে লিখবার আশা রাখছি। ভালো থাকুন স্যার।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ