চ্যাপলিন নির্মিত ‘মঁসিয়ে ভার্দু’ ছবির একটি দৃশ্য

চ্যাপলিন নির্মিত ‘মঁসিয়ে ভার্দু’ ছবির একটি দৃশ্য

ইতিহাস থেকে শিক্ষণীয়: বড় ও ছোট অপরাধী

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : নভেম্বর ১১, ২০১৯

বিশ শতকের সবচেয়ে বড় খুনি ছিল হিটলার। কিন্তু একজন খুনি হয়ে গেল দেশনায়ক। চার্লি চ্যাপলিন তাঁর ‘মঁসিয়ে ভার্দু’ ছবিতে দেখান, যখন কেউ তিন চারজনকে হত্যা করে তখন সে খুনি আর যখন লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করে তখন সে হয় নায়ক। চ্যাপলিন নির্মিত ‘মঁসিয়ে ভার্দু’ নির্বাক ছবি ছিল না, আর এই ছবিতে চ্যাপলিনের সেই ভবঘুরে চরিত্রটিও ছিল না। ‘মঁসিয়ে ভার্দু’ ছবির গল্পটি হলো, ভার্দু এক ব্যাংকের করণিক। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের ভরণ পোষণ করা তার পক্ষে অসাধ্য হয়ে ওঠে। ঠিক তখনি সে অর্থ-উপার্জনের নতুন উপায় খুঁজে বের করলো। চালাকি করে সে ধনী মহিলাদের বিবাহ করতো তারপর তাদের হত্যা করে টাকা-পয়সা নিয়ে সরে পড়তো। পয়সা রোজগারের আর কোনো উপায় ছিল না বলেই সে এই ভয়াবহ পথটি বেছে নেয়। ছবির মূল বক্তব্যটি হলো, ব্যবসায়িক মনোভাবের অনিবার্য পরিণাম হলো, নরহত্যা।

প্রথম আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তা-ই ঘটেছিল। চ্যাপলিনের চোখে অবক্ষয় কালের, অসুস্থ বিকারগ্রস্ত সভ্যতার প্রতীক হচ্ছে ভার্দু। ভার্দুর মনে স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন ভেঙে গিয়ে মনের মধ্যে তার তিক্ততা জমে উঠেছে। পুঁজিবাদী বণিকবৃত্তির মুনাফা আর ভোগবাদী সমাজে বেঁচে থাকার সংগ্রামে ভার্দু এভাবে বারোটি ধনী মহিলাকে হত্যা করে। কিন্তু ভার্দুই আবার এক দরিদ্র মহিলার করুণ কাহিনি শুনে তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করে। ভার্দু মানুষ হত্যা করে আবার সামান্য একটা পোকাকে দেখে সাবধানে পথ চলে যাতে পোকাটা তার পায়ে দলে পিষ্ট না হয়। মানুষ ঠিক এভাবেই এক বিপরীতমুখী চরিত্র হতে বাধ্য হয় শোষণ আর নিপীড়নের চাপে।

ভার্দু যাকে সাহায্য করেছিল, যখন সেই দরিদ্র মহিলা ধনী ব্যক্তিকে বিয়ে করে সম্পদের মালিক হয়, তখন হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে যায় তার ভার্দুর সঙ্গে। ভার্দু মহিলার কাছে জানতে পারে তার স্বামী বিরাট অস্ত্র কারখানার মালিক। শুনে অদ্ভুত একটা হাসি দেয় ভার্দু আর বলে, ‘অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবসায়ে টাকা খাটানোই আমার উচিৎ ছিল। ও ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায়ে আর আজকাল লাভ নেই। সময় বুঝে যারা সেখানে টাকা খাটিয়েছে তারাই এখন প্রচুর মুনাফা করবে।’ যখন মেয়েটির সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে গল্প করছিল ভার্দু, তখন থেলমার নামের যে মহিলাকে সে খুন করেছিল তার বোন ভার্দুকে চিনতে পারে। বিপদ দেখে ভার্দু সটকে পড়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা দেয়। বিচারে প্রমাণিত হলো, সে অপরাধী আর বিচারক তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। কারাকক্ষের মধ্যে সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরলো ভার্দুকে। সাংবাদিকদের একজন ঘৃণিত ভার্দুকে বললো, ‘তাহলে বুঝতেই পারছেন, অপরাধের পথে গিয়ে কোনো লাভ নেই।’ মঁসিয়ে ভার্দু তখন সাংবাদিকদের বললো, ‘ছোটখাট অপরাধে লাভ নেই বটে তবে বড় বড় অপরাধে লাভ আছে। আছে বলেই যুদ্ধ বিগ্রহ বাধানো হয়। একটা মাত্র মানুষকে যে খুন করেছে তাকে আপনারা অপরাধী বলেন। আর লক্ষ লক্ষ মানুষকে যারা খুন করে আপনাদের কাছে তারা পরম পূজনীয় দেশনায়ক। অপরাধের পরিমাণটা বাড়িয়ে নিতে পারলেই তাতে আর কোনো দোষ থাকে না।’ চলচ্চিত্রকার চ্যাপলিন বুঝিয়ে দিলেন বড় বড় অপরাধে সমস্যা নেই, বিপদ তাদের যারা ছোট ছোট ছোট অপরাধ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাবানরা চ্যাপলিনের এই ছবি দেখে রুষ্ট হয়, কমিউনিস্ট অভিধা দিয়ে তাকে আর যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেয়া হয় না। অভিধা দেয়াটা শাসক আর তার চাটুকারদের একটা মহান কর্তব্য। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে যারা লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে হিটলারের মতো সেইসব মানুষরা ছিল এই ছবিতে চ্যাপলিনের কাছে সমালোচিত। সত্যি কথাটা বলার জন্য তাকে কমিউনিস্ট অভিধা দিয়ে অপরাধী শনাক্ত করা হলো।

বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ, ফলে হিটলার আর যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের কাছে মাথাব্যথার কারণ নয়। বরং চ্যাপলিন যে তাঁর ছবিতে শক্তভাবে ‘অস্ত্র ব্যবসায়ী’দের আক্রমণ করেছে এটাই তাদের রাগের কারণ। চ্যাপলিন যুক্তরাষ্ট্রে থেকেছেন কিন্তু কখনো নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। নাগরিকত্ব দিতে চাইলেও নেননি। ফলে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে চ্যাপলিন বিরোধী প্রচারণা শুরু হয়। যুদ্ধের সময় চ্যাপলিন মিত্রপক্ষকে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিয়ে বেড়াতেন। দ্বিতীয় ফ্রণ্ট খোলার কথা ব্রিটেনের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সেই একই সময়ে খুব জোর দিয়ে বলেছিল। কিন্তু যুদ্ধকালে চ্যাপলিনের দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার নানা বক্তৃতাকে সরকার চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে অপরাধ বলে চালাতে চাইলো। চ্যাপলিনের দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার দাবি নাকি ছিল কমিউনিস্টদের পক্ষে প্রচার বা সাম্যবাদ-প্রীতি। চ্যাপলিন যখন দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার কথা বলেছিলেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মিত্রপক্ষের অন্তর্ভুক্ত। চার্চিল, রুজভল্ট, বিভারব্রুকও তখন রাশিয়ার বীরত্বের প্রশংসা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন, ব্যক্তি স্ট্যালিনেরও খুব প্রশংসা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু দাবার ঘুঁটি যুদ্ধ শেষে উল্টে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বণিকরা তখন হিটলারের চেয়ে স্ট্যালিনকে বড় প্রতিপক্ষ মনে করতে শুরু করেছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিপদের দিনে রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা করলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হবার আগে ব্রিটেন আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাবানরা আর বণিকরা ছিল খুনি হিটলারের পক্ষে। ক্ষমতাবানরা তখন হিটলারের পক্ষে না থাকলে ভার্সাই চুক্তির শর্ত ভেঙে জার্মানি কী করে বিরাট সামরিক শক্তি তৈরি করেছিল, সেই প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ভার্সাই চুক্তির মধ্য দিয়ে। সেই চুক্তির লক্ষ্য ছিল, জার্মানির ভবিষ্যৎ উত্থান নির্মূল করা। জার্মানির সামরিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য জার্মানির উপর কঠোর সামরিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। জার্মানির নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীকে ভেঙে দেয়া হয়। শর্ত থাকে জার্মানি বারো বছরের জন্য মাত্র একলক্ষ সৈন্য রাখতে পারবে আর সেটা অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। জার্মানিতে সামরিক প্রশিক্ষণ বা সামরিক শিক্ষাপ্রদান ও সৈন্য সংগ্রহের নীতি বন্ধ করা হলো। জার্মান সেনাপতিদেরও বরখাস্ত করা হয় সেই সময়ে। জার্মানিতে ট্যাঙ্ক, কামান, বোমারু বিমান নির্মাণ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। রাইন নদীর তীরে ত্রিশ মাইল এলাকা জুড়ে জার্মানির যে সামরিক ঘাঁটিগুলি ছিল তা ভেঙে ফেলা হলো আর সেখানে জার্মানরা যাতে আবার সৈন্য সমাবেশ না ঘটাতে পারে তার জন্য নদীর বাম তীরবর্তী অঞ্চল মিত্র বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছিল।

ভার্সাই চুক্তির এইসব শর্তের পর কীকরে তাহলে হিটলার জার্মানিতে বিরাট বাহিনী আর সামরিক শক্তি গড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন দেশকে পরপর পরাজিত করতে থাকলো? ভার্সাই চুক্তির শর্ত মতে, তার তো সামরিক কোনো শক্তি থাকার কথা নয়। না বিরাট সেনাবাহিনী, না কোনো ট্যাঙ্ক, কামান আর যুদ্ধবিমান। কিন্তু যুদ্ধের পূর্বেই বিরাট সেনাবাহিনী ছিল হিটলারের। হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন দখলের সময় বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণের জন্য বিরাট সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিল। কেবলমাত্র মস্কো আক্রমণের জন্য পাঠিয়েছিল আঠারো লাখের বেশি সেনা, সতেরশো ট্যাঙ্ক, চোদ্দশো বিমান। সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ চালাবার জন্য তারা প্রাথমিকভাবে চারহাজার তিনশো ট্যাঙ্ক আর চার হাজার নয়শো আশিটি যুদ্ধবিমান কাজে লাগিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে ফ্রান্সসহ আরো বহুদেশে জার্মানদের লাখ লাখ সেনা নিয়োজিত ছিল। ভার্সাই চুক্তিকে পাত্তা না দিয়ে কীকরে হিটলারের পক্ষে এইরকম বিশাল বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব হলো? কী করে তারা হাজার হাজার ট্যাঙ্ক আর যুদ্ধ-বিমান তৈরি করতে পারলো? সহজ কারণ, ব্রিটেনের সরকারসহ আরো বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাবানরা এবং বড় বড় ব্যবসায়ীরা হিটলারকে সমর্থন যুগিয়েছিল। হিটলার বলেছিল, তার লক্ষ্য ইহুদি আর মাকর্সবাদকে নিশ্চিহ্ন করা। হিটলার স্পষ্ট করেই বলেছিলো, ‘মতবাদ হিসেবে বলশেভিজম হলো প্রথম এবং শেষ শত্রু’। পুঁজিবাদীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, হিটলারের মূল লড়াইটা মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। হিটলারের লক্ষ্য যেহেতু মার্কসবাদ বা সমাজতান্ত্রিক বা বলশেভিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করা, পুঁজিবাদী দেশগুলি তাই হিটলারে মতো খুনির পক্ষে থাকতে দ্বিধা করলো না।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করা হলে ব্রিটেন বা পুঁজিবাদী দেশগুলির আপত্তি থাকার কারণ নেই। ফলে হিটলারকে তারা উৎসাহ জোগাতে লাগলো। কিন্তু ফ্রান্স বিশ্বাস করতে পারছিল না হিটলারকে। ফ্রান্স জানতো হিটলার আক্রমণ চালাবে তার দেশের ওপর, ফ্রান্স সেই ভয়ের কথা বারবার ব্রিটেনকে বলা সত্ত্বেও ব্রিটেন ফ্রান্সের কথায় কান দিলো না। ব্রিটেন তখন দিবাস্বপ্ন দেখছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হবে হিটলারের হাতে। ফলে হিটলারকে তোষণ করতে আপত্তি ছিল না ব্রিটেনসহ বড় বড় ব্যবসায়ীদের। হিটলারকে অর্থ জোগালো অনেকগুলি বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ভয়াবহ এক খুনিকে সমর্থন দিয়ে গেল তারা। পরে টের পেল তার পরিণাম। যখন হিটলার পুরোমাত্রায় শক্তিসঞ্চয় করলো, হিটলারের আক্রমণের শিকার হলো ব্রিটেনসহ অনেকেই। পাশাপাশি হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করতে ছাড়লো না। কিন্তু বিজয়ী হতে হতে জার্মানরা ভয়াবহ মার খেল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। দীর্ঘদিনের বিজয়ী হিটলার পরাজয়ের স্বাদ বরণ করলো প্রথমবার সোভিয়েত ইউনিয়নের লালফৌজের হাতে। সবাই যখন দেখতে পেল সোভিয়েত ইউনিয়ন বিজয় লাভ করতে যাচ্ছে, হিটলারের কাছে পরাজিত পুাঁজবাদী রাষ্ট্রগুলি তখন আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য প্রার্থী হলো। কিন্তু যেইমাত্র হিটলার আর জার্মান বাহিনীর পতন হলো, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর চেহারা পুনরায় পাল্টাতে থাকলো। চরিত্রহীন মুনাফাখোর তারা।

যুদ্ধ শেষে তাই যা হবার তাই হলো। ব্যবসায়ীদের বিশেষ করে অস্ত্রব্যবসায়ীদের আক্রমণ করে ছবি বানাবার জন্য চ্যাপলিন নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। চ্যাপলিন আসলে মঁশিয়ে ভার্দু ছবিতে দেখাতে চেয়েছিলেন, সমাজে নানারকম শত্রু রয়েছে। বড় বড় শত্রু আর ছোট ছোট শত্রু, তাদের ভিতরে সবচয়ে ভয়ংকর শত্রুটি কে? তিনি আরো দেখালেন, সমাজে ছোট ছোট শত্রুরা যে জন্ম নিচ্ছে, তার কারণ বড় শত্রুরা তার পরিবেশ তৈরি করে রাখে। কিন্তু বড় শত্রুদের উপর আঘাত হানাটা সহজ নয়। বরং বড় বড় শত্রুরা ছোট ছোট শত্রুদের ধরপাকড় করে, শাস্তি দিয়ে নিজেদের অপরাধগুলিকে আড়াল করতে চায়। ফলে তিনজনকে হত্যা করলে খুনি, লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করালে আর ঠকালে হয়ে যাওয়া সম্ভব পূজনীয় দেশনায়ক। বড় আপরাধগুলি পার পেয়ে যায়, ছোট অপরাধগুলির শাস্তি হয়। মঁশিয়ে ভার্দু ছবিতে চিরন্তন এক সত্যকে প্রকাশ করলেন চ্যাপলিন। বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে তাই হিটলারকে আক্রমণ করা গেলেও, যুদ্ধ শেষে আর হিটলারের মতো মানুষকে আক্রমণ করা সহজ রইলো না। কারণ হিটলারের মতো মানুষদের সঙ্গে পুঁজিবাদীদের স্বার্থ জড়িত। কারণ হিটলার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভিতর দিয়ে ধনীদের কারখানাগুলিকে বিনাপয়সায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিক জোগাড় করে দিয়েছিলো। লক্ষ লক্ষ ইহুদি আর যুদ্ধ বন্দীদের আমৃত্যু বিনা পারিশ্রমিকে সেসব কারখানায় মুখ বন্ধ করে সামান্য খেয়ে কাজ করতে বাধ্য করেছিল। কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি ছিল না, কাজ করে যেতে হবে সম্পূর্ণ ক্লান্ত না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। সামান্য টু শব্দটি করলে ভয়াবহ অত্যাচার বা নির্মমভাবে হত্যা করার বিধান ছিল। ষাট লক্ষ রাশান যুদ্ধবন্দিকে এভাবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, যুদ্ধ শেষে যাদের মধ্যে মাত্র দশ লাখ লোকের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল।

হিটলারের বড় পরিচয় সে সমাজতন্ত্রের বিরোধী, ফলে চিরকালই সে মনের গভীরে পুঁজিবাদীদের বন্ধু। সাময়িক শত্রুতা হতে পারে হিটলারে সঙ্গে পুঁজিবাদের কিন্তু সেটা চিরন্তন মতাদর্শগত শত্রুতা নয়। যার জন্য বিশ্বযুদ্ধ শেষে হিটলার আর আক্রমণের বস্তু নয় পুঁজিবাদীদের কাছে বরং আক্রমণের লক্ষ্য স্তালিন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের বিজয় নিশ্চিত করেছে। স্তালিন তাদের যুদ্ধকালীন সাময়িক বন্ধু, মতাদর্শগত চিরকালীন বন্ধু নয়। সব ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী দেশের শাসকদের চেহারাটা তেমনি। সবসময় তারা কিছু গুণ্ডা-পাণ্ডাকে তোষণ করে নিজেদের ক্ষমতাকে ধরে রাখার স্বার্থে। সেইসব গুণ্ডারা কখনো কখনো সামান্য অবাধ্য হলে তখন শাসকরা তাদের দমন করে। কঠোর হস্তে দমন করে আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের কৃতিত্ব দেখায় এই বলে যে, দ্যাখো সুশাসক হিসেবে আমি অপরাধ দমন করছি, অপরাধীদের শাস্তি দিচ্ছি। কিন্তু তারমানে এই নয় যে, গুণ্ডারাজ খতম হয়ে গেল বা তা নির্মূল করার প্রচেষ্টা এটা। আসল কথাটা হলো, পুরানো গুণ্ডার জায়গায় আসবে নতুন গুণ্ডারা বা নতুন খুনিরা। ফলে হিটলারের মতো খুনিদের সর্বদা নিন্দা করাটা পছন্দ করতে পারে না শাসকরা। কারণ গুণ্ডা ছাড়া এসব শাসকরা টিকে থাকতে পারে না। ফলে চ্যাপলিনকে তারা বাতিল করে দেয় মঁশিয়ে ভার্দু ছবিতে সত্যি কথাটা বলার জন্য। যুদ্ধকালীন সময়ে ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবি মেনে নেয়া যায় কিন্তু যুদ্ধ শেষে হিটলারের সমালোচনা, বা হিটলারে মতো দেশনেতাদের সমালোচনা মেনে নেয়া যায় না। কারণ দিনের শেষে হিটলার একজন সমাজতন্ত্র বিরোধী এবং বহুরকম দ্বিমত সত্ত্বেও পুঁজিবাদীদের মতাদর্শগত বন্ধু। ঠিক সে কারণেই হিটলারের বিরুদ্ধে সত্যি কথা বলার জন্য চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে কালাকানুন প্রয়োগ করে তারা। বিশ্বমানবসমাজ চ্যাপলিনকে সম্মান জানালেও, গুণ্ডা রাজত্বের শাসকদের পক্ষে চ্যাপলিনকে গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

ইতিহাস থেকে এভাবে বহু কিছু শিখবার রয়েছে যা চিরকাল ধরেই ঘটবে। ফলে মঁশিয়ে ভার্দু ছবির সাংবাদিক আর বিচারকদের মতো ছোট ছোট অপরাধীদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে গিয়ে যেন বড় বড় অপরাধীদের কথা ভুলে না যাই।