ইতিহাসের চোখে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান

তৌফিকুল ইসলাম পিয়াস

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২০

আইয়ূব খান ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখণ্ড নিয়ে একটি একক দেশ হিসাবে ভারতবর্ষ থেকে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৪৭ সালে। আমাদেরকে ইতিহাস গেলানো হয়েছে যে, স্বাধীনতার পর পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানীদের শোসন করেছে, এদেশ থেকে সবকিছু নিয়ে চলে গেছে— নইলে আমরা দ্রুত বড়লোক হয়ে যেতাম, ইত্যাদি।

১৯৫৮ সালে আইয়ূব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন এবং ১৯৬৯ সালে সেই রাষ্ট্রক্ষমতা ইয়াহিয়া খানের হাতে সপে দিয়ে পদত্যাগ করেন। আসল বিষয়টা কিন্তু আরও মজার। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ রাজ ভারতবর্ষকে দুটি ভাগ করে দুটি দেশ দিয়ে চলে যান? না, বাস্তবতা কিন্তু সেরকম ছিল না। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি দেশের উদ্ভব হলেও এই দেশদুটির নেতারা ঠিক কিভাবে দেশ পরিচালনা করবেন, কি হবে তাদের শাসনতন্ত্র— এসব কিছুই তাদের চিন্তায় ছিল না।

অপরদিকে বৃটিশ রাজও ছেড়ে যেতে পারলে বেঁচে যায়, এরম একটা অবস্থা। অবশেষে ‘ডোমিনিয়ন অব পাকিস্তান’ এবং ‘ডোমিনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ নামে দুটি দেশ সৃষ্টি হয়। যে দেশ দুটির রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে থাকেন বৃটিশ রাজা বা রাণী এবং সরকার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেন একজন গভর্নর জেনারেল। ডোমিনিয়ন অব পাকিস্তান ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বলবত থাকে। তারা এই ৯ বছরেও একটা শাসনতন্ত্র বা সংবিধান তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। এবং বস্তুত ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ডোমিনিয়ন অব পাকিস্তান নামের বৃটিশ রাজ্যটি বলবৎ ছিল, যার প্রধান ছিলেন বৃটিশ রাজা ষষ্ঠ জর্জ।

অপরদিকে ডোমিনিয়ন অব ইন্ডিয়া ১৯৫০ সালেই একটি সংবিধান বা শাসনতন্ত্র গঠন করে ফেলে। তারা তাদের দেশের নামকরণ করে ‘রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া’ ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ডোমিনিয়ন অব ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন বৃটিশ রাজা জর্জ (ষষ্ঠ) এবং গভর্নর জেনারেল হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন বৃটিশ লুইস মাউন্টব্যাটেন ও তামিল ভদ্রলোক চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। যদিও জহরলাল নেহেরু ওই পূর্ণ সময়টাতেই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সাফল্যে সঙ্গে পালন করেন। ইন্ডিয়া সেই যে গণতন্ত্রে প্রবেশ করে, যত যাই-ই হোক, তারা এখনও সেই গণতন্ত্রেই রয়েছে।

বৃটিশ রাজ চেয়েছিল লুইস মাউন্টব্যাটেন বা অন্য কাউকে ডোমিনিয়ন অব পাকিস্তানেরও গভর্নর জেনারেল হিসাবে রেখে দিতে, যতদিন না তারা একটি সংবিধান বা শাসনতন্ত্র লিখতে পারে। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বৃটিশদের মতের তোয়াক্কা না করে নিজেই ডোমিনিয়ন অব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। ভারত যেখানে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই একটি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলল, সেখানে আমাদের পাকিস্তানী কর্তব্যক্তিরা পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিতে সক্ষম হলেন ১৯৭০ সালে এসে। তাও কোনও সূদুরপ্রসারী চিন্তা-চেতনা ছাড়াই।

এখানে আরও কিছু তথ্য রয়েছে, যেটা আমরা জানি না। ভিন্ন ভিন্ন স্ট্যাটাসে পশ্চিম পাকিস্তানে ছয়টির মতো প্রভিন্স বা স্টেট ছিল আর পূর্ব পাকিস্তানে শুধুই পূর্ব বাংলা নামের একটি প্রভিন্স ছিল। সবটুকু মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটি। কিন্তু কিভাবে একটি গ্রহণযোগ্য ও সর্বজন গৃহীত সংবিধান তৈরী করা সম্ভব, সেটা ভাবতে ভাবতেই পাকিস্তানী নেতাদের প্রায় ১৭ বছর পার হয়ে গিয়েছিল। ভাবনাই তারা শেষ করতে পারেননি। আর ৯ বছর পরতো সেনাপ্রধান আইয়ূব খান সাহেব নিজেই ক্ষমতা দখল করে প্রেসিডেন্ট হয়ে বসে পড়লেন।

যখন নেতারা দেখলেন, কোনোভাবেই একটি গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী সংবিধান তৈরি করা সম্ভব না তখন তারা ‘আঞ্চলিক শায়ত্বশাসন’ চিন্তুায় না গিয়ে বরং পশ্চিম পাকিস্তানের সেই ৫/৬টি প্রভিন্সকে মার্জ করে দিয়ে ‘ওয়ান ইউনিট’ নামের একটি নতুন কিন্তু বাস্তবে নিষ্পাপ চিন্তার জন্ম দিলো। দুই পাকিস্তানকে এক রাখার এক নিষ্পাপ চিন্তার ফসল ছিল ‘ওয়ান ইউনিট’। ওয়ান ইউনিট বলতে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি একক প্রদেশ ঘোষণা দিল, যার প্রাদেশিক রাজধানী করা হলো লাহোর এবং পূর্ব বাংলাকে করা হলো একক পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ এবং রাজধানী হলো ঢাকা।

১৫০০ মাইল দূরের দুটি ভিন্ন চরিত্রের ভুখণ্ড যে কোনও অবস্থাতেই একক শাসনে থাকা অসম্ভব, সেটা ভাবার মতো প্রজ্ঞা তাদের কোনোদিনও হয়নি। এরচেও মজার বিষয়টি শুনবেন? ওই যে পশ্চিম পাকিস্তানের সবগুলি প্রদেশকে মার্জ করে ওয়ান ইউনিট পাকিস্তান তৈরি করা হলো, সেই আদেশটি কে দিয়েছিলেন জানেন? তিনি পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী এই বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সন্তান ও বাঙালি বগুড়ার মোহাম্মদ আলী। পাকিস্তানীরা কি তখন বলেছিল, বাঙালি প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের ভেতরের সিদ্ধান্ত নেবার কে?

আরও কয়েকটা তথ্য দিই, দেখুন তো হজম করতে পারেন কিনা? ১৯৪৭ সালে গভর্ণর জেনারেল হন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি মারা যান ১৯৪৮ সালেই। তারপরই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন বাঙালি খাজা নাজিমউদ্দিন। তিনি কোনো পাকিস্তানী নন। এরপর আসেন পাকিস্তানী গোলাম মোহাম্মদ এবং অতঃপর বাঙালি ইসকান্দার মির্জা হন গভর্নর জেনারেল। পাকিস্তানের বাঙালি গভর্নর জেনারেল ইসকান্দার মির্জা সাহেব ১৯৫৬ সালে বৃটিশ (ডোমিনিয়ন অব পাকিস্তান) থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে প্রথম পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের পূর্বপর্যন্ত।

কি? কয়জন পাকিস্তানী আর কয়জন বাঙালি গভর্নর জেনারেল দেখলেন? আরেকটু দেখাচ্ছি, ওয়েট করুন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন গর্ভনর জেনারেল তখন তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলী খান। ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খান গুলিতে নিহত হবার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমউদ্দিন— ইনি কিন্তু বাঙালি। এরপর আরও চমক আছে, বাঙালি গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার সময়ে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন আরেক বাঙালি বাবু জনাব মোহাম্মদ আলী (বগুড়া)। কি? শাসন কে কাকে করেছে? পাকিস্তানীরা বাঙালিদের নাকি বাঙালিরা পাকিস্তানীদের? তাহলে তো হিসাবে বলে, ‘চুরি’ যদি কিছু হয়েই থাকে সেটা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নয়, বরং পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানেই তো চুরি হবার কথা? নাকি ভুল বললাম?

প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার পর আসেন পাকিস্তানী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এবং এরপর আবারও প্রধানমন্ত্রী হলেন বাঙালি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। অংক কি মিলছে? এবার আসুন তাহলে, গল্পের আসল মজাটা এবার দেখা যাক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা পাচ্ছে তখন বা তারও প্রায় বছর দশেক আগে থেকেই ‘বাংলা’ মূলত বাঙালিদের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে আসছিল। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ‘বৃটিশ বাংলা’র (পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা) রাজধানী ছিল কলকাতা এবং সেই বৃটিশ বেঙ্গলের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যথাক্রমে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমউদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

১৯৪৭ সালের পর পূর্ব বাংলা ভারতবর্ষ থেকে পৃথক হলে প্রধানমন্ত্রী বা মূখ্যমন্ত্রী বাস্তবে চিফ মিনিস্টার হন খাজা নাজিমউদ্দিন এবং এরপর নূরুল আমিন (যিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের শেষ সময় পাকিস্তানের (বাঙালি) প্রধানমন্ত্রী এবং পরে বিচ্ছিন্ন একক পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন)। এরপর শেরে বাংলা একে ফজলুল হকও পূর্ব বাংলার চিফ মিনিস্টার এবং কিছুকাল গভর্নরও ছিলেন। নূরুল আমিন যখন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী তখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক। জেলখানায় অনশন করে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু ভাষানী, শামসুল হকসহ আরও অনেকেই তখনও জেলে।

শেখ মুজিব করাচি যান এবং তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন বাঙালি খাজা নাজিমউদ্দিন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে অনুরোধ করেন জেলবন্দি মাওলানা ভাষানী, শামসুল হকসহ অন্যদের ছেড়ে দিতে তিনি যেন পূর্ব বাংলার চীফ মিনিস্টার নূরুল আমিনকে অনুরোধ করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন শেখ মুজিবকে উত্তরে বলেছিলেন, ‘এটা তো প্রাদেশিক সরকারের হাতে। আমি কি করতে পারি?’ জবাবে শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘আপনি মুসলিম লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আর পূর্ব বাংলায়ও মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতায়। আপনি তাদের অনুরোধ করতে পারেন।’

এখানে পরিষ্কার বোঝা সম্ভব যে, ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত (আইয়ুবের ক্ষমতা দখলের পূর্ব পর্যন্ত) পূর্ব বাংলা স্বাধীনভাবেই পরিচালিত হয়েছে। এদেশ থেকে কোনোকিছু পশ্চিম পাকিস্তানে চুরি করে নিয়ে গেছে, সেটা কিভাবে প্রমাণ হবে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আমি ইতিহাসের ছাত্র নই। ইতিহাসে আগ্রহ ছিল না কোনোকালে। কিন্তু বাঙালি মিথ্যার গল্পে গা ভাসিয়ে দিতে অক্ষম এই আমি যতই ইতিহাস ঘাটছি ততই হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।