ইসলাম ও বিবর্তনবাদ কি সাংঘর্ষিক?

ফরহাদ ইবনে ইলিয়াস

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২১, ২০২৩

শুরুতে আমাদের ধর্ম ও বিজ্ঞান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। বিজ্ঞান হচ্ছে প্রকৃতিকে বোঝার একটা ম্যাথডলজি বা পদ্ধতি। অর্থাৎ প্রকৃতি কিভাবে কাজ করে বা করবে, সেটা বোঝার চেষ্টা করাই বিজ্ঞানের কাজ। আর ধর্ম কাজ করে ‘কেন’ নিয়ে। কেন এই প্রকৃতি আর মানুষের অস্তিত্ব বিদ্যমান তার দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদান করে ধর্ম। ধর্ম হচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্য প্রদানকারী দর্শন ও জীবনব্যবস্থা। অন্যদিকে জীবনের প্রয়োজনীয়তায় বিজ্ঞান একটা উপকরণ মাত্র।

 

এখন বিজ্ঞান ও ধর্ম উভয়ের এই দার্শনিক অবস্থান সম্পর্কে না জানা থাকলে উভয় দিক থেকেই সংঘর্ষ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ফলশ্রুতিতে বিজ্ঞানকে ধর্মের জায়গায় নিয়ে যাওয়া বা ধর্মকে বিজ্ঞানের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

 

বিজ্ঞান মূলত অবজারভেশনের ওপর ভিত্তি করে কোনো কিছুকে বোঝার চেষ্টা করে। অর্থাৎ বিজ্ঞান শুধুমাত্র জাগতিক অবজারভেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখন এইসকল অবজারভেশনের ওপর নির্ভর করে বিজ্ঞান যেসকল অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছায় তা পরিবর্তনশীল। কেননাঃ

 

১. নতুন অবজারভেশন পূর্বের অবজারভেশন হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। এই ভিন্ন অবজারভেশন পূর্বের অনুসিদ্ধান্তকেও পরিবর্তন করে দিতে পারে। যেমন: ফসিল ডাটা। সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন ফসিল ও তার বয়স পূর্বের অনুসিদ্ধান্তকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করছে।

 

২. একই অবজারভেশন দিয়ে ভিন্ন কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেতে পারে যা পূর্বের ব্যাখ্যার বিপরীত হতে পারে। যেমন: নিউটন ফিক্সড স্পেসের ধারণা দিলেও আইন্সটাইন ফ্লেক্সিবল টাইম স্পেসের ধারণা নিয়ে আসেন। নিউটন গ্র্যাভিটিকে পুলিং ফোর্স হিসেবে দেখেছিলেন যা আইন্সটাইন এসে পুশিং ফোর্স দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন।

 

এখন বিজ্ঞানের ধারণা পরিবর্তনশীল হলেও বিজ্ঞানের মূল কার্যকারিতা হচ্ছে বিজ্ঞান ভুল হলেও সেটা দিয়ে কাজ চালানো যায়। যেমন: নিউটনিয়ান থিওরির ওপর ভিত্তি করে মানুষ ঠিকই চাঁদ থেকে ঘুরে এসেছে কিংবা ভুল পদ্ধতিতে নাইট্রোজেন গ্যাস আবিষ্কার করেছে। বিজ্ঞানের দুটো ভিন্ন থিওরি একইসাথে কাজে লাগতে পারে যারা একে অন্যের সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে। যেমন: থিওরি অব রিলেটিভিটি আর কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স। অর্থাৎ, বিজ্ঞান আমাদের কাজকে সহজ করার উপায় খোঁজে। সত্য-মিথ্যার সত্যায়ন করা বিজ্ঞানের কাজ নয়। সকল বিজ্ঞানই পরিবর্তনশীল। সেটা কার্যকরী হোক বা না হোক।

 

এবার আসি বিবর্তনবাদ নিয়ে। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো বিবর্তনবিদ্যা একটি শাখা যা পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ বিবর্তনবিদ্যারও প্রতিনিয়ত বিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু তারপরও কেন বিবর্তন থিওরি নিয়ে এত মাতামাতি? কেন বেশিরভাগ ধার্মিকেরা এর বিরোধিতা করে বা তথাকথিত বিজ্ঞানমনস্করা এর ওপর ভিত্তি করে ধর্মকে বাতিল করছে? এর কারণ হচ্ছে, বিবর্তন আর বিবর্তনবাদ এক জিনিস না। বিবর্তনবাদে এখন আর শুধু বিজ্ঞানের এলিমেন্ট নাই। পূর্বেই বলেছি, বিজ্ঞান কিভাবে কি ঘটছে সেটা বোঝার চেষ্টা করবে আর ধর্ম ‘কেন’ হচ্ছে সেটার উত্তর খুঁজবে। কিন্তু বিবর্বতনবাদিরা এই ‘কেন’কেও বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছেন। ফলে বিজ্ঞান এখন শুধুমাত্র ম্যাথডলজি আর নাই। হয়ে গেছে আলাদা একটা ধর্ম। ফলে এই ধর্ম অনিবার্যভাবে অন্য সকল ধর্মের সাথে বাই-ডিফল্ট সংঘর্ষে মিলিত হচ্ছে। অর্থাৎ, বিবর্তনবাদিতা বা বিজ্ঞানবাদিতা বিজ্ঞানের মোড়কে আলাদা একটা দার্শনিক অবস্থান তৈরি করেছে। অথচ এটা বিজ্ঞানের দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক।

 

এবার আসি কিভাবে বিবর্তনবাদিতার দর্শন সামাজিকতা পেল। বিবর্তন নামক বিজ্ঞানের একটা শাখাকে দার্শনিক ভিত্তি এনে দিয়েছেন ডারউইন। ডারউইন এমন একটি ধারণা দিয়ে গেছেন যেটা মূলত ‘কিভাবে’এর পাশাপাশি ‘কেন’এরও উত্তর দেয়। যেমন ধরুন মহাবিশ্বের শুরু কিভাবে হলো, এর উত্তর বিজ্ঞান দিলো ‘বিগ ব্যাং’ এর মাধ্যমে। কিন্তু কেন বিগ ব্যাং হলো? কেন নাথিং থেকে সামথিং আসলো? এর উত্তর কিন্তু বিজ্ঞান দিতে পারে না। এটা বিজ্ঞানের সাবজেক্টই না। একইভাবে দেখি ডারউইন কী করেছেন? ডারউইন প্রজাতি থেকে প্রজাতি কিভাবে পরিবর্তিত হলো তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার জন্য এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির পরিবর্তন হয় এবং এভাবে বিবর্তন হতে থাকে। কিন্তু যখন কেউ প্রশ্ন করবে, কেন প্রজাতিরা টিকে থাকার এই ম্যাকানিজম এডপ্ট করে? কেন সব বিলুপ্ত হয়ে গেল না? টিকে থাকার এই ইচ্ছাকে প্রকৃতি কেন আমলে নিচ্ছে? ন্যাচার কেন টিকে থাকার বৈশিষ্ট্যকে প্রজাতির মধ্যে চালিত রাখছে? এই ‘কেন’ এর উত্তর বিজ্ঞানের দেয়ার কথা না। কিন্তু ডারউইন তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন ন্যাচারাল সিলেকশান আর র‍্যান্ডম মিউটেশনের মাধ্যমে। অর্থাৎ র‍্যান্ডমলি এই পরিবর্তনগুলো ঘটতে থাকে কোন উদ্দেশ্য ছাড়া। যেগুলো প্রকৃতির সাথে খাপ খায় সেগুলো টিকে থাকছে। এখন এই র‍্যান্ডম মিউটেশনের প্রবাবিলিটি মিথ নিয়ে কথা না বাড়িয়ে শুধুমাত্র ঐ উদ্দেশ্য তৈরি করাটাকে ফোকাস করি। এখানে ডারউইন প্রকৃতির উদ্দেশ্যহীনতাকেই প্রজাতির পরিবর্তনের উদ্দেশ্য বানিয়ে দিলেন। এভাবে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব কমন এন্সেস্ট্রি, ট্রি-অব-লাইফ দিয়ে প্রাণীর উৎপত্তির গোড়া অব্দি যায়।

 

এখন অবিশ্বাসীরা ডারউইনের এই ব্যাখ্যাটাকে ধর্মের বিপরীতে ইন্টেলেকচুয়ালি ব্যবহার করার একটা সুযোগ হিসেবে দেখলো। ফলে তারাই মূলত বিজ্ঞানকে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করালো বিজ্ঞানের দর্শনকে তোয়াক্বা না করে। ফলে বিজ্ঞানের নাম করে ধর্মকে অগ্রহণযোগ্য দেখানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গেলো। এবং এখনও ধর্ম থেকে বিচ্যুতির পেছনে বিবর্তনবাদ একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। এই পর্যায়ে এসে বাইডিফল্ট বিশ্বাসীরা বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করার তাড়না অনুভব করে। কিন্তু সমস্যা হয়, ডারউইনের বিবর্তনবাদকে বিরোধিতা করতে গিয়ে পুরো বিবর্তনকে প্রশ্নের সম্মুখীন করার চেষ্টাতে গিয়ে। এই জায়গায় গিয়ে দুটো ভুল হয়।

 

প্রথমত. পুরো বিবর্তনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা পুরো বিজ্ঞানের একটি শাখাকে প্রশ্ন করার শামিল। অথচ বিবর্তন এখন আর ডারউইনের বিবর্তনে সীমাবদ্ধ নাই। বিবর্তনবিজ্ঞানের এরিয়াতে আরো অনেক এফেক্টিভ মডেল এডোপ্ট করা হয়েছে। যেমন ডারউইনিয়ান বিবর্তন তত্ত্বের এজাম্পশনগুলোর মধ্যে রয়েছে:

 

ক. ন্যাচারাল সিলেকশান বিবর্তনের একটা ড্রাইভিং ফোর্স।
খ. জিন ভারটিকালি ট্রান্সমিটেড।
গ. গ্র্যাজুয়ালিজম।
ঘ. ট্রি অব লাইফ।
ঙ. বৈশিষ্ট্যগুলো ইনহ্যারিটেড নয়।
চ. মিউটেশন র‍্যান্ডম।

 

ডারউইনের এইসকল এজাম্পশনগুলো নিও ডারউইনিজমে এসে ডিস্প্রুভেন হয়েছে। ফলে অলটারনেটিভ আরো অনেক মডেল মেইনস্ট্রিম সেক্যুলার বায়োলজিস্ট কর্তৃক প্রস্তাবিত হয়েছে:

 

ক. ন্যাচারাল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং।
খ. নিও ল্যামার্কিয়ান ইভোলিউশান।
গ. মিউটেশন ড্রিভেন ইভোলিউশান।
ঘ. ইভোলিউশান বাই সেলফ অর্গানাইজেশন।
ঙ. সিম্বায়োটিক ইভোলিউশান।

 

অর্থাৎ, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব প্রবল্যামেটিক, অপ্রমাণিত। তাই ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের বদলে পুরো বিবর্তন তত্ত্বকে অপ্রাসঙ্গিক করা একটা ভুল এপ্রোচ।

 

দ্বিতীয়ত, ডারউইনের বিবর্তনকে ভুল-শুদ্ধ প্রমাণ করার চেষ্টার বদলে প্রশ্ন করা উচিত ডারউইনিজমকে নিয়ে। বিজ্ঞানবাদিতা নিয়ে। কেননা ডারউইনিজম মূলত কোনো বিজ্ঞান নয়। এইটা বিজ্ঞানবাদিতা। এটা একটা মতবাদ, দর্শন যা বিজ্ঞানের দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক। ডারউইনের বিবর্তন বিজ্ঞান যেমন অপ্রমাণিত-প্রবল্যামেটিক-পরিবর্তনশীল তেমননি এর হতে জেগে ওঠা বিবর্তনবাদ দর্শন বিজ্ঞানের দর্শন বিরোধী। ডারউইনীয় বিবর্তন তত্ত্বের মূল এজাম্পশানগুলো ডিস্প্রুভেন হওয়া সত্ত্বেও এর থেকে উদ্ভুত ডারউইনিজম যেহেতু প্রাণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে উদ্দেশ্যহীন করে দেয়ার চেষ্টা করে একটা স্বতন্ত্র বিলিফ সিস্টেমের প্রবর্তন করে তাই এটা শুধু মাত্র বিজ্ঞানের কাঠামোতে সীমাবদ্ধ নাই। এটা এখন রিলিজিয়াস সিস্টেম, এথিকাল সিস্টেম এবং পলিটিকাল সিস্টেম। এই দিকটাতে ফোকাস করা উচিত।

 

বিজ্ঞানের কোন তত্ত্বকে আজকে আপনি ভুল হয়তো প্রমাণ করতে পারেন, কিন্তু কালকেই সেটা শুদ্ধ হিসেবে আবির্ভাব হতে পারে বা তার উলটো। তাই লড়াইটা মূলত বিজ্ঞান নিয়ে নয়, বিজ্ঞানবাদিতা নিয়ে। দর্শন নিয়ে। বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের জায়গায় রাখলে ধর্মের সাথে এর কোন সংঘর্ষ থাকার কথা না।

 

বিজ্ঞানের দর্শন না বুঝে এর বিরুদ্ধে যেভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছিলো এককালের চার্চতন্ত্র ঠিক একইভাবে বিজ্ঞানবাদিরা বিজ্ঞানকে এখন ব্যবহার করছে ধর্মের বিরুদ্ধে। তবে এইসকল বিজ্ঞানবাদিদের রিফিউট করার জন্য ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রয়োজনই নাই, বিজ্ঞানের দর্শনই যথেষ্ট।

 

ধর্ম কখনোই বিজ্ঞানের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করার বিষয় না। এই মহাবিশ্ব এবং এর মাঝে যা কিছু আছে তার কারণ হিসেবে দার্শনিক ভাবে স্রষ্টার প্রয়োজনীয়তাই ধর্মকে অস্তিত্বে আনবে। সেটা ভিন্ন ও বিস্তারিত আলোচনা। বিজ্ঞান শুধুমাত্র আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে এই জগত বোঝার একটা চেষ্টা মাত্র। আমাদের সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয় (কোয়ান্টিটিভলি/ কোয়ালিটিটিভলি) সকল অভিজ্ঞতা অবলোকনের জন্য যেমন যথেষ্ট নয় তেমনি এই মহাবিশ্বের কোন স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন তবে তিনি আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে নির্ণয় করা নিয়মের মধ্যেই কাজ করতে বাধ্য নন।

 

ইসলামে মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী তৈরী করার প্রক্রিয়ার কথা জানানো হয়নি। তাই মানুষ ছাড়া অন্য কোনো স্পিসিসের ক্ষেত্রে স্পেসিফিকভাবে কোন অনুসিদ্ধান্তের উপর আমাদের বিশ্বাস রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। বিবর্তন নিয়ে ইসলামিস্ট স্কলাররাও কাজ করে গিয়েছেন অতীতে। নবম শতাব্দীর স্কলার আল-জাহিয তার কিতাব আল-হায়াওয়ান Book of Animals এ আধুনিক যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এম্ব্র্যায়োলজি, এডাপটেশন এবং প্রাণীর সাইকোলজি নিয়ে কাজ করে গেছেন। চোদ্দশ শতাব্দীর হিস্টোরিয়ান ইবন খালদুন তার মুকাদ্দিমাতেও গ্র্যাজুয়াল প্রসেস অব ক্রিয়েশন নিয়ে বলেছেন।

 

ধর্মকে ধর্মের জায়গায় এবং বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের জায়গায় রেখে মানবকল্যাণের জন্য বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ চর্চাতে ইসলামের কোন ধরনের বিধিনিষেধ নেই। অপরদিকে বিজ্ঞানবাদিদেরও বুঝতে হবে যে বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে বিশ্বাস না রাখাটাই বিজ্ঞানসম্মত অবস্থান। ডারউইনিজম যেমন বিজ্ঞান নয়, তেমনি ডারউইনিয়ান বিবর্তন তত্ত্বকে খন্ডানো মানেই পুরো বিবর্তনের বিরোধিতা করা না। নিজেরা প্রান্তিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে অন্যের প্রান্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর, হিপোক্রেসি।