ইসলামের দৃষ্টিতে সূক্ষ্ম ও পরোক্ষ শিরক

মোশাররফ হোসাইন সাগর

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৩, ২০২৪

যে কোনো ইবাদত-বন্দেগি ও পুণ্যের কাজ করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এর সাথে অন্য কোনো উদ্দেশ্য যোগ হলে, যেমন সমাজে ঈমানদার, দ্বীনদার, মুত্তাকি, পরহেজগার, হাজি ও গাজি হিসেবে পরিচিত লাভ করে সুনাম-সুখ্যাতি আশা করলে এটা রিয়া (লোকদেখানো কাজ) করা হলো। এটাও এক ধরনের শিরক। এ কারণে সব ইবাদত-বন্দেগি ও পুণ্যকাজ তো বরবাদ হবেই, পরকালে জুটবে পুরস্কারের পরিবর্তে কঠিন শাস্তি।

শুধুমাত্র মূর্তিপূজার নাম শিরক নয়। ইসলামি বিধি-বিধান মেনেও শিরক করা যায়। যেমন: নামাজ পড়া, রোযা করা, যাকাত দেয়া, হজ্জ ও কুরবানি করা, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা— এসব ইবাদত-বন্দেগি ও পুণ্য কাজগুলো যদি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য না হয়ে তার সাথে অন্যকিছু যোগ হয় এবং এসব কাজ করে তা ফেসবুকে বা অন্যভাবে প্রচার করে বেড়ানো হয়, তাহলেও আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে শরিক করা হয়। এই শরিক করাটাই ইসলামের পরিভাষায় শিরক।

আমাদের দেশের মানুষেরা হজ্জ পালন করার নিয়ত করলেই আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনের কাছ থেকে দু’আ চাওয়ার নামে সবাইকে বলে বেড়ান। হজ্জযাত্রার আগে আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে গিয়ে কিংবা তাদের নিজের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে এনে হজ্জে যাওয়ার কথাটা সবাইকে জানিয়ে শেষে ঘটা করে মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হন। বর্তমানে এর সাথে নতুন যোগ হয়েছে ইহরামের কাপড় পরে হজ্জযাত্রার প্রাক্কালে ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করা।

মক্কা-মদিনায় গিয়েও হজ্জের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। এগুলো সব হলো লোকদেরকে তার হজ্জ পালনের কথা জানিয়ে দিয়ে প্রশংসা কুড়ানো। সেহেতু তাদের হজ্জ পালন করাটা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য না হয়ে অন্যকিছু তার সাথে যোগ করা হয়ে যায় সেহেতু এটা ইসলামের দৃষ্টিতে রিয়া। রিয়া প্রকারান্তরে শিরক। ফলে হজ্জটা জেনে বা না জেনেই তারা বরবাদ করে দিচ্ছে।

অনেকে শুক্রবার জুম’আর নামায আদায় করে জায়নামাজ হাতে পাজামা-পাঞ্জাবি ও টুপি পরা ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে সবাইকে জানায়। এ কাজ করেও সে তা নিজের নামাজটা বরবাদ করে দেয়। কুরবানির পশুর হাটে গিয়ে কিংবা কুরবানির পশু কিনেও অনেকে সেই পশুর সাথে নিজের ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে তারা পশু কিনে কুরবানি করে। অথচ এসব করে তারা কুরবানির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ করে দেয়।

কেউ কেউ একটি ইসলামি কবিতা বা গান লিখে ফেসবুকে পোস্ট করার সাথে সাথে নিজের একখানা আবক্ষ ছবি জুড়ে দেন। এরা ইসলাম প্রচারকারী নয়, ইসলামের নামে আত্মপ্রচারকারী। এরাও রিয়াকারী তথা শিরককারী। এরা সওয়াবের পরিবর্তে কিছু গুনাহ নিজের ঝুলিতে ভরে থাকে। এ ধরনের হাজারটা কর্মকাণ্ড আমাদের সমাজের লোকেরা করে বেড়ায়, যা ইসলামের দৃষ্টিতে চরম গর্হিত কাজ। তার মাধ্যমে সব ইবাদাত-বন্দেগি ও পুণ্যকাজগুলো বরবাদ হয়ে যায়।

এ বিষয়ের সপক্ষে কুরআন-হাদিসে অসংখ্য দলিল আছে। সবগুলো তুলে ধরতে গেলে বিশাল গ্রন্থ হয়ে যাবে। সেহেতু মাত্র কয়েকটি তুলে ধরা হলো :

আল্লাহ বলেন, তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে। সূরা বাইয়িনাহ: ৫
নিশ্চয় মুনাফিক (কপট) ব্যক্তিরা আল্লাহকে প্রতারিত করতে চায়। বস্তুত তিনিও তাদেরকে প্রতারিত করে থাকেন এবং যখন তারা নামাযে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে নিছক লোকদেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে থাকে। সূরা নিসা: ১৪২

হে ঈমানদারগণ, দানের কথা প্রচার করে এবং কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে নষ্ট করে দিও না ঐ লোকের মতো যে নিজের সম্পদ লোকদেখানোর জন্য ব্যয় করে। সূরা বাকারা: ২৬৪

বলো, আমার নামায, আমার যাবতীয় ‘ইবাদত, আমার জীবন, আমার মরণ (সবকিছুই) বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই (নিবেদিত)। সূরা আনআম: ১৬২

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে, সেই উদ্দেশ্যই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য। বুখারি ১

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, আমি শরিকদের শিরক্ হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। যদি কোনো লোক কোনো কাজ করে এবং এতে আমি ছাড়া অপর কাউকে শরিক করে, তবে আমি তাকে ও তার শিরকি কাজসহ বর্জন করি। বুখারি ২৯৮৫, ইবনু মাযাহ ৪২০২, আহমাদ ৭৯৩৯, মুসলিম ৭৩৬৫, মিশকাত ৫০৮৪

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দেহ এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন। বুখারি ৫১৪৪, মুসলিম ২৫৬৪, তিরমিযী ১১৩৪, নাসায়ী ৩২৩৯, আবু দাউদ ৩৪৩৮, ইবনু মাযাহ ১৮৬৭ ও আহমাদ ৭৬৭০

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ক্বিয়ামাতের দিন প্রথমে এক শহীদ ব্যক্তির ব্যাপারে বিচার হবে। আল্লাহ তা`আলার সামনে হাশরের ময়দানে তাকে পেশ করবেন এবং তিনি তার সকল নি`আমাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। এরপর তার এসব নিআমাতের কথা স্মরণ হয়ে যাবে। এরপর আল্লাহ তা`আলা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি এসব নিআমাত পাবার পর দুনিয়াতে তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকারে কী কাজ করেছো? সে উত্তরে বলবে, আমি তোমার (সন্তুষ্টির) জন্য তোমার পথে (কাফিরদের বিরুদ্ধে) লড়াই করেছি, এমনকি শেষ পর্যন্ত আমাকে শহিদ করে দেয়া হয়েছে।

তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। তোমাকে বীরপুরুষ বলবে এজন্য তুমি লড়েছো। আর তা বলাও হয়েছে (তাই তোমার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে)। পরে তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি, যে নিজে জ্ঞান অর্জন করেছে, অন্যকেও তা শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন পড়েছে, তাকে উপস্থিত করা হবে। তাকে দেয়া সব নি`আমাত আল্লাহ তাকে স্মরণ করিয়ে দিবেন। এসব নি`আমাত তার স্মরণ হবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, এসব নি`আমাতের তুমি কি শোকর আদায় করেছো? সে উত্তরে বলবে, আমি `ইল্ম অর্জন করেছি, মানুষকে `ইল্ম শিক্ষা দিয়েছি, তোমার জন্য কুরআন পড়েছি।

আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, তোমাকে `আলেম বলা হবে, ক্বারী বলা হবে, তাই তুমি এসব কাজ করেছ। তোমাকে দুনিয়ায় এসব বলাও হয়েছে। তারপর তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং মুখের উপর উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তৃতীয় ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তা`আলা বিভিন্ন ধরনের মাল দিয়ে সম্পদশালী করেছেন, তাকেও আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তাকে দেয়া সব নি`আমাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। এসব তারও মনে পড়ে যাবে। আল্লাহ তাকে এবার জিজ্ঞেস করবেন, এসব নি`আমাত পেয়ে তুমি কি `আমল করেছো?

সে ব্যক্তি উত্তরে বলবে, আমি এমন কোনো খাতে করচ করা বাকী রাখিনি, যে খাতে খরচ করাকে তুমি পছন্দ করো। আল্লাহ তা`আলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি খরচ করেছো, যাতে মানুষ তোমাকে দানবীর বলে। সে খেতাব তুমি দুনিয়ায় অর্জন করেছো। তারপর তার ব্যাপারে হুকুম দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। মুসলিম ১৯০৫ ও ৪৮১৭, মিশকাতুল মাসাবিহ ২০৫