ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো

ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো

ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর ৪ কবিতা

অনুবাদ: রথো রাফি

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৫, ২০২১

পেশা

যাজক গ্যালিলিও ছিলেন বড় একরোখা
বড় সর্বনাশা। তবু সময়েরও আছে
নিজস্ব ধরন, দেখিয়ে দিয়েছে,
সবচেয়ে জেদিরাই মেধাবী সবচেয়ে।

আর কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন না তো
সেইকালে এত নির্বোধ, যতটা গ্যালিলিও।
পৃথিবীটা যে ঘুরছে, বেশ জানতেন তিনি
যদিও তার কাঁধে বড় অভাবের সংসার।

পরিপূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতার পর
স্ত্রীর সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে যেই পা রাখলেন
মনে হলো, বড় ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেল তার,
তবু বাস্তবে একে ঠিক পাত্তা দিলেন না।

এ গ্রহের সত্যিকার দশা ঘোষণা করার
ওই ঝুঁকি শুধু গ্যালিলিওই নিয়েছিলেন,
তাকে তা করেছে মহৎ... আমি
যতটা বুঝি, তারটাই সত্যিকার পেশা।

আমি তাই সালাম জানাই, এ পেশাকে
যা শেক্সপিয়ার কিংবা লুই পাস্তুর,
নিউটন কিংবা লিও টলস্টয়ের
প্রণম্য পেশার সমকক্ষ হয়ে ওঠে!

কেন তবে তাদের দিকে এমন কাঁদা ছুড়াছুড়ি?
মূল্য হোক না চড়া, নিজের কথাই তো বলে প্রতিভা।
কেউ মনে রাখেনি তাদের, যারা করতো অপমান,
অপমানিত মানুষেরাই বরং আজ প্রাতঃস্মরণীয়।

যারা সবেগে ছুটছে বায়ুমণ্ডলে, তারা সবাই
যেসব চিকিৎসক কলেরার বিরুদ্ধে লড়ে
দিয়ে গেলেন প্রাণ, তারা সবাই সেরা পেশাদার!
তাদেরকেই আমার দৃষ্টান্ত মনে করি!

তাদের পবিত্র এ বিশ্বাসেই আস্থা আমার।
তাদের বিশ্বাসই আমার কাঙ্ক্ষিত মনুষ্যত্ব
আমিও তাই কারো পেছনে নয় আর
ছুটছি শুধু ছুটছি আমারই পেশার পিছে।

জন্মদিন

তোমাকে অভিনন্দন জানাতে দাও, মা
তোমার ছেলের জন্মদিনে।
তুমি তাকে নিয়ে বড় চিন্তিত। এখানেই শুয়ে আছে সে
বড় কম তার রুজিরোজগার, তার বিয়েটা তো ছিল স্রেফ বোকামি
দীর্ঘ দেহ তার, দিন দিন পাতলা হচ্ছে আরো, উলুজুলু দাড়িতেও ছেয়ে গেছে মুখ।
কী করুণ ও মায়াবী দৃষ্টি তার
আমার উচিত তোমাকেই অভিনন্দন জানানো যদিবা জানাই
তোমার এই দুশ্চিন্তার জন্মদিনে।
সে তো তোমার কাছ থেকেই এই বয়সে পেয়েছে
এই প্রেমভক্তির উত্তরাধিকার, কোনো করুণাভিক্ষা তো নয়
আর দাম্ভিক সে আর নিজের বিশ্বাস নিয়েও বড় বেয়াড়া
তোমার কাছ থেকেই পেয়েছে সে বিপ্লবের এই গভীর বিশ্বাস।
তুমি তো তাকে ধনী বা বিখ্যাত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলোনি,
নির্ভীকতাই তাই তার একমাত্র মেধা।
খুলে দাও না তার জানালাগুলো।
সবুজপাতায় ভরা ডালগুলো না হয় ভরে যাক কিচিরমিচির শব্দে।
তার চোখ দুটি চুম্বনে চুম্বনে মেলে দাও।
তার হাতে দাও নোটবই আর কালির দোয়াত,
পান করতে দাও তাকে এক পেয়ালা দুধ, আর দেখো চলে যায় সে।

স্বাধীনতার প্রশ্নে

দাহাওয়ের ছাইভস্মে পুড়ছে আমার পা
অ্যাসফল্ট ধোঁয়াচ্ছে আমার নিচে
আমার নখের নিচে গেঁথে আছে
বোমা আর বেয়নেট

প্রেমিকার বিচ্ছিন্ন একটা চুলে আলতুভাবে হাত বুলাব
আর যিশুর শিশুদের হত্যায় এই রাতে উড়তে উড়তে
বোমারুবিমানের পাখায় যিশুর মতোই ক্রুশবিদ্ধ হয়ে
আমি সিগারেট টানব নিজে

আমার চামড়া শিরশির করে ওঠে বিস্ফোরণে
এ যেন ভিয়েতনাম
আর আমার মেরুদণ্ড আমার পাঁজরের হাড় গুঁড়িয়ে
আমার ভেতর দিয়েই ছুটে গেছে সেই বার্লিন দেয়াল

আমাকে স্বাধীনতার কথা বলছেন? আকাশে
গুচ্ছ গুচ্ছ বোমার নিচে এ বড় ফাঁপা প্রশ্ন
নিজের যুগ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শুধুই আত্ম-অবমাননা
এর দাস হওয়ার চেয়েও শতগুণ লজ্জার

হ্যাঁ, আমি দাস হয়ে গেছি তাসখন্দের নারীর
আর ডালাসের বুলেট আর পিকিং স্লোগান
আর ভিয়েতনামের বিধবা আর ভাঙা রাস্তার পাশে
রুশ নারী আর তাদের চোখের উপর ছড়িয়ে থাকা ওড়নার

হ্যাঁ, আমি পুশকিন আর ব্লক থেকে কোনোভাবেই মুক্ত নই
ম্যারিল্যান্ড রাজ্য আর জিমা স্টেশন থেকেও মুক্ত নই
মুক্ত নই শয়তান ও ঈশ্বর থেকে
মুক্ত নই পৃথিবীর রূপ আর এর মলমূত্র থেকে

হ্যাঁ, আমি ক্রীতদাস হয়ে গেছি বিশ্বের সমস্ত ঝগড়াটে আর
হত্যারুদের মাথা ভেজা-ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁট দেয়ার ভীষণ তৃষ্ণার কাছে
হ্যাঁ, বিশ্বের সব জারজের মগ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার
সম্মানের কাছে আমি নতজানু এক ক্রীতদাস

আর হয়তোবা এ কারণেই মানুষের ভালোবাসা পাব
আমার গোটা জীবন ব্যয় করে
(এই লৌহযুগের সামনে নজির স্থাপন না করে নয়)
সত্যিকারের স্বাধীনতার লড়াইয়ের চেয়ে
এই স্বাধীনতাহীনতার মর্যাদা বাড়িয়ে গেলাম বলে।

খুন

ঘুমায় না এমন সুন্দরভাবে কেউ আর।
আমি শুধু ভয় পাই
হয়তোবা এখনই জেগে উঠবে তুমি,
আর নিরাবেগ দৃষ্টিতে আমাকে আলতু ছুঁয়ে যাবে,
আর খুন করে বসবে সৌন্দর্যকেই।

কবি পরিচিত: রাশিয়ান কবি ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৮ জুলাই। কবিতা লেখা ছাড়াও তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, প্রকাশক, অভিনেতা, সম্পাদক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল তিনি মারা যান।