ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে উদ্দেশ্যবাদী যুক্তি

আমিনুল ইসলাম

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮

জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা একজন আছেন, এ বিশ্বাস অনেক বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের মনেই বদ্ধমূল। তাদেও কেউ কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্বকে সরল বিশ্বাসে মেনে নেন, আবার অন্য কেউ সেই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান যুক্তিপ্রমাণের ওপর। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের লক্ষ্যে উপস্থিাপিত প্রধান প্রধান যুক্তিকে চারটি শিরোনামে আলোচনা করা যেতে পারে। এগুলো হলো, বিশ্বতাত্ত্বিক যুক্তি, উদ্দেশ্যবাদী যুক্তি, নৈতিক যুক্তি ও তত্ত্ববিয়সক যুক্তি। আজ উদ্দেশ্যবাদী যুক্তি আলোচনা করা হলো:

 

ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের লক্ষ্যে রচিত যুক্তিসমূহের মধ্যে উদ্দেশ্যবাদী যুক্তি সর্বাধিক জনপ্রিয়। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বিশ্বতাত্ত্বিক যুক্তিটি প্রাকৃতিক জগতের অস্তিত্ব থেকে সেই জগতের একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করতে চায়। এদিকে উদ্দেশ্যবাদী যুক্তিটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায় প্রাকৃতিক জগতের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য থেকে। যুক্তিটিকে মোটামুটি দু’ভাবে বিবৃত করা যায়।

প্রথমত বলা হয় যে, আমরা যাকে প্রকৃতি বলি তা ঘটনাবলির আকস্মিক সমাবেশ কিংবা আপতিক ঘটনাবলির এলোমেলো সংমিশ্রণ নয়, বরং একটি সুশৃঙ্খল ব্যাপার। গ্রহগুলো তাদের কক্ষপথে নিয়মিত পরিক্রমণ করে; শস্যবীজের পুষ্টি ও বিকাশ ঘটে একই নিয়মে; ঋতুসমূহের পরিবর্তন ঘটে একের পর এক। প্রত্যেক জিনিসেরই সঙ্গতি রয়েছে এক বিধিবদ্ধ নিয়মের সঙ্গে। সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত নিয়মদ্বারা। প্রকৃতির এই বিশাল শৃঙ্খলা আপনা-আপনি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না, কিংবা তাকে কোনও আপতিক ব্যাপার বলেও আখ্যায়িত করা যায় না। এর নিয়ন্ত্রণের জন্যে অবশ্যই একটি বুদ্ধিমান চেতন সত্তার অস্তিত্ব থাকা চাই। প্রকৃতিতে যে শৃঙ্খলা ও পরিকল্পনা নিদর্শন পাওয়া যায় তা থেকে একজন পরিকল্পনাকারী বা স্থপতির অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন, কোনও মরুভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে কেউ যদি একটা ঘড়ি দেখতে পান এবং ঘড়িটির জটিল যন্ত্রপাতি প্রত্যক্ষ করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে ব্যক্তি ঘড়িটির একজন নির্মাতার কথা ভাববেন। কারণ ঘড়িটির যান্ত্রিক কলাকৌশল কোনও নির্মাতা ছাড়া আপনা-আপনি সৃষ্ট হতে পারে না। ঠিক একই যুক্তিতে এ পৃথিবীরও একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। এ পৃথিবী একটি ঘড়ির চেয়ে শতগুণ বেশি বিচিত্র ও জটিল। আর তাই ঘড়ির অস্তিত্ব থেকে যেমন তার নির্মাতার অস্তিত্ব অনুমেয়, তেমনি এ বিচিত্র জগৎ ও তার জটিল কলাকৌশল থেকেও একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুমেয়।

রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করেছিলেন এক প্রচ্ছন্ন সত্তার অনুভূতি; আর তাকে তিনি পেতেও চেয়েছিলেন আকুল আবেগ দিয়ে। আকাশের ঘননীল মেঘের সমারোহ দেখে তিনি অনুভব করেন তার হৃদয় যেন ময়ূরের মতো নাচছে, এবং কোনও এক অজানাকে জানার ও পাওয়ার জন্যে তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে:
শতবরণের ভাবউচ্ছ্বাস
কলাপের মতো করেছে বিকাশ,
আকুল পরাণে আকাশে চাহিয়া
উল্লাসে কারে যাচে রে।
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচেরে।
প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে অসীম ঈশ্বর নিজেকে ক্রমশ ফুটিয়ে তুলেছেন। আর তাই আমরা ভাবতে পারি যে, এ জগৎ নিছক মায়া নয়, বরং বাস্তব ও সত্য। এ জন্যই দূর অতীত থেকে সামনের ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসরমান মানুষের কর্মপ্রবাহে তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়।

উদ্দেশ্যবাদী যুক্তিটিকে আবার এভাবেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে: জগতের বস্তুরাশি ও ঘটনাবলির সতর্ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে এ সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, প্রত্যেক জিনিসেরই সম্পাদন করার মতো কিছু কাজ আছে। প্রাণবানই হোক আর নিষ্প্রাণই হোক, প্রত্যেক জিনিসেরই জগতের সামগ্রিক পরিকল্পনায় একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা চাই। জগতের সবকিছুই আপনা-আপনি চলছে, কিংবা প্রত্যেক জিনিস নিজেই সচেতনভাবে তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গতিপ্রকৃতি স্থির করছে, একথা ভাবা অস্বাভাবিক। সুতরাং এ কথা মেনে নিতেই হবে যে, প্রত্যেক জিনিসেরই কর্ম, আচরণ ও গতিপ্রকৃতি আগে থেকেই পরিকল্পিত হয়েছে। অর্থাৎ জগতের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড একই পরম চেতন সত্তা দ্বারা পরিকল্পিত, সংঘটিত ও সমন্বিত হয়ে চলছে। আর এ পরিকল্পনাকারী সার্বিক চেতনাই হচ্ছে জগতের স্রষ্টা। সুতরাং জগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা স্বরূপ ঈশ্বর যে একজন আছেন তা প্রমাণিত।

লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, এ যুক্তির প্রথম অংশে প্রকৃতিকে মনে করা হয়েছে একটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের ফলাফল হিসেবে। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, প্রকৃতি এমন একটি যন্ত্রস্বরূপ যার যথাযোগ্য একটি লক্ষ্য অর্জিত হয়। যুক্তিটির উভয় অংশেই বলা হয়েছে যে, প্রকৃতির কর্মকাণ্ডে ঈশ্বরের বুদ্ধি বা লক্ষ্য অভিব্যক্ত হয়। আর তাই এ যক্তির নাম উদ্দেশ্যবাদী যুক্তি।

দর্শনের ইতিহাসে এ যুক্তির প্রবক্তাদের মধ্যে স্টোয়িক দার্শনিকেরা, টমাস একুইনাস, লাইবনিজ, ইউলিমা পেলে ও মার্টিনো বিখ্যাত। টমাস একুইনাসের মতে, এ জগৎ যেন একটি উদ্দেশ্যের রাজত্ব। এখানকার সব বস্তু নিয়োজিত নিজ নিজ উদ্দেশ্য সাধনে। তাদের এ উদ্দেশ্য সাধনের পেছনে এক বুদ্ধিমান পরিচালকের সঙ্কেত রয়েছে। জগৎ যদি উদ্দেশ্য পরিচালিত হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই এর একজন পরিচালক থাকা চাই। আর এ মহান পরিচালকই হলেন ঈশ্বর।

লাইবনিজের মতে, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মনাডসমূহের তুলনা করা চলে এমন কিছু ঘড়ির সঙ্গে যেগুলোর মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান। এখানে প্রশ্ন ওঠে, মনাডগুলো যদি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হয়ে থাকে তাহলে এদের মধ্যে সামঞ্জস্য সংরক্ষণ করে কে? উত্তরে লাইবনিজ বলেন, ঈশ্বর সব মনাডের স্রষ্টা। তিনি আগে থেকেই এমন ব্যবস্থা করে রেখেছেন যাতে স্বাধীন হয়েও মনাডগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে পারে। এ যেন দুটি ঘড়ির একই সময় নির্দেশ করার মতো। একই সময় নির্দেশকারী দুটি ঘড়ি থেকে আমরা একথা বলতে পারি না যে, এদের একটির যন্ত্রপাতি অপরটির যন্ত্রপাতির ওপর ক্রিয়া করছে। বরঞ্চ আমরা জানি, এদের এমনভাবে তৈরি ও চালু করা হয়েছে যে, শুরু থেকে এরা পূর্বাপর একই সময় নির্দেশ করে যাবে। ঠিক তেমনি জগতের নিয়ম-শৃঙ্খলার মূলে রয়েছে ঈশ্বর।

উইলিয়াম পেলের মতে, একটি ঘড়ির ডিজাইন ও কলাকৌশল থেকে আমরা যেমন একজন ঘড়ি নির্মাতার অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি, তেমনি প্রকৃতি ও জীবজগতের শৃঙ্খলা ও পরিকল্পনা থেকে একজন পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। আর এ পরিকল্পনাকারীই হলেন ঈশ্বর।

মার্টিনোর মতে, জগতে নির্বাচন, সংযোগ ও স্তরভেদ- এ তিনটি ব্যাপারের উপস্থিতিও একজন পরম চেতন বুদ্ধিমান সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এ তিনটি মানদণ্ডের নিরিখে সনাক্ত করা যায় এক বুদ্ধিমান মনের কর্মকাণ্ডকে।

এ উদ্দেশ্যবাদী যুক্তি প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে কান্ট বলেন, এ যুক্তি সম্মানের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য। যুক্তি হিসেবে এটি প্রাচীনতম, স্পষ্টতম, এবং তা মানুষের সাধারণ যুক্তিবুদ্ধির সঙ্গে সবচাইতে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ। তবে একটি পূর্ণস্বভাব, সর্বতোভাবে নিখুঁত সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণে তার সীমাবদ্ধতাও অসামান্য। এ যুক্তি বড়জোর জগতের একজন পরিকল্পনাকারীর ইঙ্গিত দিতে পারে; কিন্তু সেই পরিকল্পনাকারী যে জগতের পরমস্রষ্টা তাতে তা প্রমাণিত হয় না। এখানে যে পরিকল্পনাকারীর কথা বলা হয়েছে তার ব্যক্তিত্বের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে কিছুই স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ তিনি কি দয়াল, নিষ্ঠুর, না উদাসীন, এগুলোর কিছুই এ যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় না। এছাড়া এই মহাপরিকল্পনাকারীর যে একটা ব্যক্তিত্ব আছে, তারই বা প্রমাণ কি? এও তো সম্ভব যে, জগতের উৎস কোনও পরমব্যক্তি নন, বরং নিছক একটি নৈর্ব্যক্তিক শক্তি। প্রকৃতিবাদীদের মতে, প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতাকে প্রাকৃতিক উপায়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এর জন্যে কোনও অতিপ্রাকৃত সত্তার শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই।

লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, উদ্দেশ্যবাদী যুক্তিটি সাদৃশ্যানুমানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গাড়ি, ঘড়ি প্রভৃতি সাধারণ জিনিসের সাথে বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের পরিকল্পনা ও কলাকৌশলের সাদৃশ্য যথার্থ নয়। কারণ আমরা সহজেই গাড়ি, বাড়ি, ঘড়ির নকশা দেখি ও দেখাতে পারি; কিন্তু আমরা যে জগতে বাস করছি তার পরিকল্পনা ও নকশা করতে কখনও কাউকে দেখিনি, দেখার প্রশ্নই ওঠে না। এ যুক্তিতে শৃঙ্খলা বা সামঞ্জস্য কথাটিকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে একজন পরম পরিকল্পনাকারী চেতন সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণের যে চেষ্টা করা হয়েছে, তাও নিঃসংশয়ে গ্রহণযোগ্য নয়।

জগতে যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা বিদ্যমান তাকে কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু সেটা যে পূর্বপরিকল্পিত, তা হলফ করে বলা যায় না। কয়েকটি ভারি জিনিসকে উপর থেকে নিচের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে সেগুলোও মোটামুটি শৃঙ্খলাবদ্ধভাবেই পড়বে। কয়েকটা পাথরের টুকরো হাতে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে মারলে এগুলো অবশ্যই শেষ পর্যন্ত মাটিতে এসে পড়বে, এবং তাকেও এক ধরনের শৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হবে। এ থেকে কি এ ধারণা করা যায় না যে, সুদূর অতীতে এক প্রকাণ্ড বিস্ফোরণে জগৎসংসারের সবকিছুকে বিক্ষিপ্ত করে দিয়ে এক ধরনের শৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জগতের এ শৃঙ্খলার মূলে একজন চেতন পরিকল্পনাকারী ঈশ্বরের কল্পনা করা অহেতুক নয় কি?

লেখকের ‘জগৎ জীবন দর্শন’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো