
উনিশতম অশ্বারোহী
পর্ব ১
মলয় রায়চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৮
বেগম সুফিয়া কামাল, আব্বাসউদ্দীন আহমদ প্রমুখ অনেকে নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্ধে তাঁদের বিশেষ আচরণটিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘কদমবুছি’ নামক শব্দটির দ্বারা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপকগণ কর্তৃক সংকলিত ও সংশোধিত ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ গ্রন্হে শব্দটি নেই। অর্থৎ অভিধানে অভিধা নেই। এই বহু ব্যবহৃত ও প্রচারিত বইটির উপদেষ্টাবৃন্দের মধ্যে আবদুল ওদুদ, আবুল হাসনাৎ, মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম আছে। অর্থাৎ অভিধানটি কেবল পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু উচ্চবর্গ-উচ্চবর্ণ ভাষাবিদ ও সাহিত্য অনুরাগীদের তত্ত্বাবধানে বিরচিত, এমন মনে করার কারণ নেই। ঢাকায় প্রকাশিত যে বাংলা অভিধানগুলো কলকাতায় বিক্রি হয়, তাতেও শব্দটি নেই। কিন্তু এই একটিমাত্র উদাহরণের দ্বারা প্রতিপাদিত হয় যে, ভাষা, তা সে বাংলা, উর্দু, ইংরেজি, ফরাসি যা-ই হোক না কেন, একটি ঐকিক প্রণালি নয়। একবর্গীয় অভিব্যক্তি-বিন্যাস নয়। ভাষাকে যদি কাঠামিবদ্ধ ঐকিক নিয়মের অন্তর্গত মনে করা হয়, এবং সেই ভাষাপ্রণালিটিকে সাংস্কৃতিক স্ফূরণের কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে একটি এজমালি সংস্কৃতি অথবা একটি প্রভাবশালী, এমনকী আধিপত্যবাদী, ভাবতত্বের চাগিয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়, যার দরুণ সমাজটির অন্তর্গত সাংস্কৃতিক জটিলতার যৌগিক প্রক্রিয়াটি আমাদের অনুসন্ধানের আড়ালে থেকে যেতে পারে। বলনকেতা এবং লিখিত ভাষার কার্যসম্পাদন সর্বদা সংঘটিত হয় একটি কালখণ্ডের বিশেষ সামাজিক অবস্থায়, আলোচ্য সমাজটির সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক টানাপোড়েনে।
একটি ভাষা বহুবিধ ছোট-ছোট প্রণালি বা ডিসকোর্সের সংমিশ্রণে গঠিত। যেমন লেটোর গান, সনেট, অভিভাষণ, চিঠি, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, মর্সিয়া, কীর্তন, গালাগাল, আবৃত্তি, কোরাস, গজল, গল্প, প্রতিবেদন, বকবক, আঞ্চলিক বাচন, অমার্জিত কথাবার্তা, প্রেমালাপ, বকুনি, অফিস-নোট ইত্যাদি। ব্যবহৃত শব্দাবলি এবং অভিব্যক্তির নিহিতার্থ, সন্দর্ভ অনুযায়ী পালটায়, প্রয়োগকারীর সামাজিক সাংস্কৃতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে তাদের অর্থবোধকতার সম্পর্ক। শব্দাবলির বা অভিব্যক্তিসমূহের নির্গলিতার্থ ভাষা-বিশেষটির দরুণ রূপায়িত হয় না, তা হয় ডিসকোর্স-বিশেষটিতে অন্তর্ভুক্তির কারণে। শ্রেণি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, বর্গ, জাতপাত, ধর্ম ইত্যাদির অন্তর্গত দ্বন্দ্বের মাধ্যমে বলনকেতার জন্ম হয়, এবং তা ভাবাত্মক স্থিতিগুলোর পরস্পর-বিরোধিতার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। অতএব, সমাজটির সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতার জাল ছেয়ে ফেলতে পারে অভিব্যক্তির স্ফূরণ ও তার মধ্যেকার আধিপত্য বা দুর্বলতাকে, মানে বা নিহিতার্থ নামের পুরো ব্যাপারটাকে, আর অভিধান প্রণেতাদের। আমরা জানি, একই অভিব্যক্তির ট্রেড ইউনিয়ন মঞ্চে একরকম মানে হয়, আবার আমলাদের সভায় আরেকরকম মানে হয়। অভিব্যক্তি চেপে যাওয়াটাও এক ধাঁচের অভিব্যক্তি। পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের বহু অভিধানে, সজ্ঞানে অথবা অজান্তে, বহু অভিব্যক্তি চেপে যাওয়া হয়েছে, এবং তা সচেতনভাবে বা অবচেতনায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সমাজের অন্যান্য বর্গের মতন, সাহিত্যের আলোচক ও ইতিহাসকার, ভাষার ক্ষমতা ও দক্ষতাকে প্রয়োগ করেন। যাঁরা সাহিত্য পড়েন এবং আলোচনা করেন, তাঁরা কেউই সাংস্কৃতিক-মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নন। কোনও লোকের পক্ষে অমন নিরপেক্ষ হয়ে সাহিত্যের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। সংস্কৃতি বলতে জীবনের সবকিছু বোঝায়, সমস্ত ব্যাপার, এমনকী ডাক্তারির মতন নিরপেক্ষ জ্ঞানের এলাকাও।
অভিব্যক্তির সাহায্যে সমাজের ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো রূপায়িত হয়, আর তাকে দাঁড় করিয়ে রাখে মূর্ত বা বিমূর্ত সমসাময়িক জ্ঞান, বিশেষ করে সেই সব জ্ঞানাধিকারীদের কার্যকলাপ, যাঁরা এই জ্ঞানকে একচেটিয়া করে রাখতে চান। বিশেষ একটি জ্ঞানের সাহায্যে যে-ব্যাপারটিকে পঞ্চাশ বছর আগে আমরা বলতুম পাগল হয়ে যাওয়া, এখন তাকে বলি মানসিক অসুস্থতা। সমাজে অন্যত্র তাকে বলা হয় ভুতে পাওয়া। মানসিক অসুস্থতাও যে অনেক ধরণের হয়, তা আমরা আজ জানতে পেরেছি। একশো বছর আগে সুন্দরী বলতে যে দেহকাঠামো ও মুখাবয়ব অনুমোদিত ছিল, এখনকার সুন্দরীর সংজ্ঞা তা থেকে একেবারে আলাদা। তখনও, এবং এখনও, সংজ্ঞা তৈরি করা হয়েছে জ্ঞান প্রয়োগ করে। জ্ঞানের প্রয়োগে সাহিত্যের মান বা অনুশাসন বা মানদণ্ড বা ক্যানন বানানো হয়। অমন নানা জ্ঞান নানা বিষয়ে স্ফূরিত হতে থাকে সমাজের ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে, মসনদটির মূল্যবোধ থেকে। জ্ঞান ব্যাপারটি হল সমাজিক নিয়ন্ত্রণের ফর্ম। জ্ঞান থেকে ক্ষমতার উৎসারণ ঘটে। যেমন-যেমন নতুন নতুন জ্ঞানের উদ্ভব হয়, তেমন-তেমন বিকশিত হয় ক্ষমতার নবীন আদরা। কোনটা উৎকৃষ্ট বা কোনটা নিকৃষ্ট, কাকে স্বাভাবিক বলা হবে আর কাকে অস্বাভাবিক, কী হলে ভালো আর কী হলে খারাপ, নির্ধারিত হয় ক্ষমতাকাঠামোর চরিত্রের দ্বারা। কেননা ক্ষমতা দেয় বিচার করার অধিকার, এবং সেহেতু শাস্তি দেবার বা উপেক্ষা করার যোগ্যতা। প্রাচীনকালে সাহিত্যিক-ভাবুক-দার্শনিকদের শারীরিক শাস্তি দেবার চল ছিল। ক্রমশ শাস্তিকে করে তোলা হয়েছে মানসিক। বহু কবি লেখক আঁকিয়ে আজও সমাজ থেকে একঘরে বা স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হন ক্ষমতাকেন্দ্রে আঘাত হানার কারণে, এমনকী তাঁদের গুমখুন করে লোপাট করে দেয়া হয়, কিংবা খুন করে খুনিরা লুকিয়ে পড়ে। অভিধান থেকে নির্বাচিত ও চিহ্ণিত অভিব্যক্তিসমূহকে বাদ দিয়ে যেমন একদল মানুষকে শাস্তি দিতে পারে সমাজ, তেমনি একজন সাহিত্যিককে শাস্তি দিতে পারে তাকে ম্লেচ্ছ, নেড়ে, কাফের, মালাউন, ক্ষ্যাপা, আধপাগল বদনাম দিয়ে। অথবা সাংস্কৃতিক চত্বর থেকে তার অপসারণ ঘটিয়ে, বা তাকে হীনম্মন্য চিহ্ণিত করে। কিংবা এরকম রটনাও বাজারে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে, যে অমুক লোকটি ছোটোলোকদের জন্য লেখেন, নোংরা লেখেন, মাগিবাজ ছিলেন, মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান, গলায় গানের মাধুর্য নেই, মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন ইত্যাদি। ক্ষমতার অবয়ব ব্যতিরেকে কুৎসার প্রসার ঘটে না। কুৎসা সর্বদা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
চলবে