উনিশতম অশ্বারোহী

শেষ পর্ব

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৮

চার.
রবীন্দ্রনাথ ১৩০৫ বঙ্গাব্দে তাঁর ‘গ্রামসাহিত্য’ নিবন্ধে এই কটা কথা লিখেছিলেন, ‘গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া থাকে; তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়। তাহা কেবল দেশের জনসাধারণেরই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য, সেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায় না। সাহিত্যের যে অংশ সার্বভৌমিক তাহা এই প্রাদেশিক নিম্নস্তরের থাকাটার উপরে দাঁড়াইয়া আছে। এইরূপ নিম্নসাহিত্য এবং উচ্চসাহিত্যের মধ্যে বরাবর ভিতরকার একটি যোগ আছে। যে অংশ আকাশের দিকে আছে তাহার ফুলফল ডালপালার সঙ্গে মাটির নিচেকার শিকড়গুলোর তুলনা হয় না— তবু তত্ত্ববিদদের কাছে তাহাদের সাদৃশ্য ও সম্বন্ধ কিছুতেই ঘুচিবার নহে।’ প্রাগুক্ত নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছিলেন, ‘নিচের সহিত উপরের এই যে যোগ, প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য আলোচনা করিলে ইহা স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। অন্নদামঙ্গল ও কবিকঙ্কণ- এর কবি যদিচ তাঁহারা উভয়ে রাজসভা-ধনীসভার কবি, যদিচ তাঁহারা উভয়ে পণ্ডিত, সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিশারদ, তথাপি দেশীয় প্রচলিত সাহিত্যকে বেশিদূর ছাড়াইয়া যাইতে পারেন নাই।’

নিম্নসাহিত্য ও উচ্চসাহিত্যের খুঁটি দুটিতে বাঁধা বঙ্গসংস্কৃতির অশ্বটিকে মুক্ত করে দিলেন নজরুল, ছুটিয়ে দিলেন তাকে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝেকার বঙ্গীয় মননের টালমাটাল কালখণ্ডে, এবং আঘাত হানলেন যুগ্ম-বৈপরীত্যগুলোর ভিত্তিবাদী ও খণ্ডবাদী বনেদে। একেবারে ভণ্ডুল করে দিতে চাইলেন তাদের: আর্য ও অনার্য, উচ্চ ও নিম্ন, হিন্দু ও মুসলমান, ভূমিপুত্র ও বহিরাগত, মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র, সাকার ও নিরাকার, কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক, জ্ঞান ও কর্ম, মন ও দেহ, দেবতা ও রাক্ষস, শহর ও গ্রাম, বেদ ও নির্বেদ, ফরসা ও কালো, ঈশ্বর ও অনীশ্বর, মস্তিষ্ক ও হৃদয়, শ্রীকৃষ্ণ ও ইন্দ্র, শুভ ও অশুভ, উর্বশী ও অর্জুন, মূর্ত ও বিমূর্ত, ভদ্রলোক ও ছোটলোক ইত্যাদি। এ-প্রসঙ্গে আনন্দবেদনার অভিজ্ঞান ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সেই নিগূঢ় ও ওজস্বী বৈপরীত্যগুলোকে স্মরণ করা যায়, যা একদা ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য মানদণ্ড প্রয়োগ করে বিচ্যুতি ঠাওরেছেন এলিট আলোচকের দল, যাঁদের সঙ্গে সুফি গায়ক-কবি বুল্লে শাহের রচনার (বুল্লা কি জানা ম্যায় কৌন) পরিচয় নেই:

আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘুর্ণি
আমি পথ সন্মুখে যাহা পাই তাহা চূর্ণি
আমি চিরদুরন্ত দুর্মদ

আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়
আমি শ্মশান,
আমি আবাসন, নিশাবসান।

এরই বিপরীতে, একই পাঠকৃতিতে তিনি লিখেছিলেন:
আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী
তন্বী নয়নে বহ্ণি,
আমি ষোড়শীর হৃদি সরসিজ প্রেম
উদ্দাম, আমি ধন্যি।

চিন্তা ও অসামঞ্জস্যকে যেভাবে তাঁর পদ্যে ও গানে বার বার এনেছেন নজরুল, আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে, ঠাণ্ডামাথায় পুনঃচিন্তিত স্মৃতি কালক্রমে তার আদল পালটায়, চরিত্রহীন হয়ে যায়। তাঁর অধিকাংশ পাঠকৃতি সেহেতু দ্রুত, স্বতঃস্ফূর্ত ভৌতবৃত্তীয়, সংবাহক। ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বে প্রতিপালিত বাঙালি ভাবুকদের একদেশদর্শিতা থেকে মুক্ত। নয়তো তাঁরা কীভাবেই বা এই ঘটনাগুলো মিলিয়েছেন: জেমস স্টুয়ার্ট মিল-এর উদারনীতি এবং তাঁর ভারতবর্ষের ইতিহাস, ম্যাকলের হুইগিশ উদারনীতি নিজেরদেশে বসে এবং উপনিবেশে রেসিজম, ইউরোপীয়দের নিজেদের জন্য ‘মুক্তি-ভাতৃত্ব-স্বাধীনতা’-র স্লোগান আবার একই সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস রাখা, একদিকে আলোকপ্রাপ্তি তত্বের রমরমা আর তার বিপরীতে নারীকে ভোটাধিকার না দেবার প্রয়াস। একইভাবে প্রশ্ন ওঠে যে, হিন্দু ও ব্রাহ্ম সাহিত্যিকদের রচনাতে ইসলামের মিথ ব্যবহৃত হয়নি কেন!  হয় না কেন? তাহলে তাঁদের চেতনাকে তো আত্মসর্বস্ব এবং খণ্ডিত আখ্যা দেওয়াই উপযুক্ত। আসলে ‘মসনদের মূল্যবোধ তার নিজস্ব মালিন্য গড়ে তোলে’। যেমন পরবর্তীকালে তসলিমা নসরিনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার ও তাদের বিতাড়ন বিষয়ক বই ‘লজ্জা’-কে কেন্দ্র করে।

প্রাগুক্ত মালিকানার দরুণ অনেক আলোচক নজরুলে আলোচনা এড়িয়ে যান। তাঁদের ভয় হয়, নজরুলের আলোচনা করলে বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁরা নিজেরাই বেকায়দায় পড়বেন, তাঁদের হয়তো সাহিত্যসমাজে জবাবদিহি করতে হবে, অধ্যাপকদের কাছে কারণ দর্শাতে হবে। আসলে নজরুলের সংবরণহীনতা, সংহতিহীনতা, সংশ্লেষহীনতার সামনে পড়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান তাঁরা, কেননা তাঁদের হাতে গুঁজে দেওয়া মাপকাঠিতি জগা কৈবর্ত, বিশা ভূঞিমাল এমনকি শিবনাথ শাস্ত্রীও নয়। তা দিশি কেরি সাহেবদের মারফত পাওয়া স্যামুয়েল জনসন প্রমুখের মাপকাঠি। তিরিশের দশকের পাঁচজন কবি, যাঁরা বাংলা কবিতায় আধুনিক আদরা-আদল-কাঠামোর অনুপ্রবেশ ঘটান, তাঁরা সবাই ছিলেন ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক। অর্থাৎ সাদা-কলার সংস্কৃতির তাঁরা ছিলেন অন্তরঙ্গজন। বাঙালি চাষা ক্ষেতমজুর ঢুলি মোয়াজ্জিন সেপাই কাজি বাবুর্চি খানসামা এমাম ইত্যাদি প্রান্তিক মানুষের কালচেতনা ও অভিব্যক্তি-বিন্যাস যে কলেজ অধ্যাপকদের থেকে আলাদা হবে না, তা নজরুলের আলোচকরা ঠাহর করতে পারেননি, পারেন না। ওপরতলার বিদ্যায়তনিক ঠাটটিকে যেহেতু নিচুতলার হেলাফেলার বিশ্ববীক্ষা দিয়ে চুরমার করেছিলেন তিনি, সেহেতু ওপরতলার তথাকথিত শিক্ষিত সংস্কৃতিবান রুচিসম্পন্ন এলিটের আঁতে ঘা লেগেছিল, আজও লাগে। নজরুলের পাঠকৃতিতে আওয়াজ অর্থকে ছাপিয়ে যায়। অর্থ অনেক সময়ে বোধাতীত হতে পারে, কিন্তু আওয়াজের ঘোরের মধ্যে বোধকে পড়তেই হয়। নিহিতার্থ বা মানের মালিকানা থাকে ওপরতলার কবজায়। আওয়াজ নিচুতলায়। রস ওপর থেকেই টানা যায়। সেখানেই নান্দনিকতার কারখানা। ফলে যত দিন যাচ্ছে আর যাবে, দেয়ালে টাঙনো তাঁর ছবির সংখ্যাবৃদ্ধি হলেও, তাঁর বহু পাঠকৃতি বিদ্যায়তনিক ও বৌদ্ধিক মহলে হয়ে উঠবে এগজটিক।

লক্ষণীয় যে, কাজী নজরুল ইসলামের সমকক্ষ জনপ্রিয় কবি, উভয় বাংলাতেই, আবির্ভূত হননি। আবৃত্তিকার-কবিদের পারফরমেন্স আরম্ভ হয়েছে তাঁর বহু পরে। পারিবারিক সংস্কৃতিতে ইউরোপীয় দ্যোতকগুলি অনুপ্রবেশ করতে পারেনি বলে, পশ্চিমবঙ্গে তিন, চার ও পাঁচের দশকে মুসলমান সমাজ থেকে বাঙালি কবি নেই। তারপর যাঁরা এলেন, কবিরুল ইসলাম, সামসুল হক, শামসের আনোয়ার প্রমুখ, মসনদের পপাতিষ্ঠানিক জ্যোতির্মণ্ডলের বাইরের অন্ধকারে, রয়ে গেলেন আগন্তুক ও প্রান্তিক। উপেক্ষিত ও অবহেলিত শামসের আনোয়ার বেছে নিলেন আত্মনিধনের পথ। সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর হিন্দু সমাজটি এমন এক বিমূর্ত মূল্যবোধের চাপ সৃষ্টি করে যে, সেই প্রক্রিয়ায় মুসলমান কবি রয়ে যান প্রান্তে, সাহিত্যশাসকদের ক্ষমতাকেন্দ্রটির ছত্রছায়ার বাইরে। কবি নজরুল ইসলামের, পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, ক্রমাবলুপ্তির ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ওই প্রক্রিয়ায়।

মক্তব, মদ্রাসা, দার-উল-উলুমে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকের পক্ষে আর বোধহয় পশ্চিমবঙ্গে কবি হওয়া এবং স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশে কি সম্ভব? আমার মনে হয় সম্ভব নয়। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় ‘লানত গলায় গোলাম ওরা সালাম করে জুলুমবাজে/ধর্মধ্বজা উড়ায় দাড়ি গলিজ মুখে কোরান ভাঁজে’ পড়েন পাঠক তখন তিনি মানে বইয়ের খোঁজ করেন। একই ব্যাপার ঘটে যখন ‘চিরনির্ভর’ কবিতায় শোনা যায় ‘ইস্রাফিলের বজ্রবিষাণ বেজে ছিল বারবার’, কিংবা ‘চোর ডাকাত’ কবিতায় ‘জগৎ হয়েছে জিন্দানখানা প্রহরী যত ডাকাত’। এমন অজস্র আছে। পেশাদার আবৃত্তিকাররা নজরুলের গুটিকয় অতিজনপ্রিয় কবিতাই মঞ্চে-মঞ্চে পড়ে বেড়ান। পশ্চিমবঙ্গের ভাষাজগৎটিতে দেশভাগের পর যে বৌদ্ধিক ও সেম্যানটিক পরিবর্তন ঘটেছে, ঘটে চলেছে, নজরুলের বহু প্রতীক রূপকল্প শব্দবন্ধ অভিধা সেই প্রেক্ষিতে হয়ে উঠেছে অপরিচিত। পক্ষান্তরে তাঁর গান, বিশেষ করে শ্যামাসঙ্গীত, টিকে আছে তৃণমূল স্তরে। নজরুলের অভিব্যক্তি বুঝতে না পারলেও, বাঙালি যুবক-যুবতীরা, নর্তক-নর্তকীরা বলিউডের সালমান খান বা শাহরুখ খানের উর্দু সংলাপ দিব্বি বোঝেন ও নিজেদের বাক্যালাপে ব্যবহার করেন।

নজরুলের বিদ্যায়তনিক ও সমাজতাত্বিক গ্রহণ বর্জন ব্যাখ্যা করা যায় সম্ভবত পোস্টস্টাকচারাল অর্থাৎ উত্তরকাঠামোবাদী বা উত্তরগঠনবাদী ভাষাতত্বের দ্বারা। ধারণাটি জানায় যে, মানবসত্তাকে কোনও সর্বজনীন নিয়ম-পদ্ধতি প্রয়োগ করে টের পাওয়া যায় না, যা আধুনিকতাবাদ করতে চেয়েছিল নানারকম গ্র্যাণ্ডন্যারেটিভ (মহাআখ্যান, মহাসন্দর্ভ, মহাগল্প ) দ্বারা। বলা হল যে, গল্পটি অনুযায়ী, ইউরোপ একটি তুলাদণ্ড তৈরি করেছে এবং এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার সাহিত্য-সংস্কৃতি জীবনধারাকে তাইতে ওজন করে ফতোয়া দিতে চেয়েছে। ওজন করার পর তাদের মাপে যে বা যা বা যেগুলোকে মনে হয়েছে ইউরোপের, সেই বুড়ি ছুঁয়ে-ছুঁয়ে একটা একমুখী একরেখ ইতিহাসের নৈতিকতা ও বৈধতা তারা অনুমোদন করেছে। এমনিতেই, একটিমাত্র সংস্কৃতি নামে কিছুই ছিল না উপনিবেশগুলোয়। তার ওপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দাপটে তা হয়ে গেছে যৌগিক, দোআঁশলা, মিশ্রিত, বহুমুখী, বহুরেখ, বহুস্বর।

সাম্রাজ্যবাদী শাসনকেন্দ্রটি, আধুনিকতাবাদের মাধ্যমে তৈরি করেছিল একটি জেলখানা, যা আজও বজায় আছে উপনিবেশগুলোয়, এবং ভয়ংকর রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে প্রাক্তন উপনিবেশগুলোয়। এমন জেলখানা, যেখানে, সমস্ত আত্মপরিচয়কে খোপে-খোপে আবদ্ধ করা হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামকে তেমন কোনো খোপে ফেলতে না পারায় দেখা দিয়েছে সমস্যা, কেননা একদিকে আরব ইন্দ্রিয়চেতনার সাহায্যে ও ইসলামের গরিমা আশ্রয় করে তিনি আধুনিকতাবাদকে প্রতিরোধ করেছেন, আরেকদিকে রাঢ় বাংলার সহজ চিত্তবৃত্তি প্রয়োগ করে বহু প্রচলিত ও পপতিষ্ঠিত সীমাগুলোকে অভাবিত তাড়নায় লঙ্ঘন করে গেলেন। অথচ দ্রোহীর অহংটিকে সংজ্ঞায়িত করলেন না। দ্রোহী নজরুল তাঁর প্রান্তিক স্হিতি বজায় রেখেছেন সাম্রাজ্যবাদী শাসনকেন্দ্রটির বিরুদ্ধে আঘাত ঘটিয়ে। আর সাবঅলটার্ন উপসংস্কৃতির সঙ্গে প্রগাঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন ‘শ্মশানকালীর নাম শুনেরে, শ্যামা মায়ের ভেলায় চড়ে, আল্লা রসুল জপের গুণে, বক্ষে ধরেন শিব যে চরণ’  ইত্যাদি অজস্র লোকায়ত গানের মাধ্যমে।

নজরুলের পাঠকৃতি অনুধাবনকালে উত্তরকাঠামোবাদের  এই বক্তব্যটিও প্রযোয্য যে, শব্দাবলী বা অভিধাসমূহের  নিহিতার্থের উৎস হল আধিপত্যবাদী ক্ষমতার পারস্পরিক সম্পর্কের লাগাতার টানাপোড়েন। এই টানাপোড়েনে শব্দ তামাদি হয়ে যায়, কিংবা তার নিহিতার্থ পালটে যায়। যে-বিবাহ বাসর থেকে বরের পোশাক ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি, সেই বিয়ের কনেকে নিয়ে লেখা ‘হিংসাতুর’ শিরোনামটি ওই প্রগাঢ় প্রেমের কবিতাটি এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। নজরুলের আলোচনা ডায়াক্রনিক নিরিখের পরিবর্তে সিংক্রনিক নিরিখ অনুসারী হলে তাঁকে এবং তাঁর রচনাকে বুঝতে সুবিধে হবে। সিংক্রনিক নিরিখটি পাঠকৃতিটিকে সংস্কৃতি-বিশেষটির জটিলতার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করে। নজরুলের পাঠকৃতিগুলো অনেকানেক সাংস্কৃতিক, নৈতিক, ধার্মিক, নান্দনিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক উপাদানে নির্মিত। তাতে পাওয়া যায় জ্ঞানতাত্বিক ও ভাবাত্মক রেশারেশির অনর্গল দোটানা, মেলবন্ধন, বহুধ্বনিময়তা।

ভাষার বাইরের নার তার ভেতরের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ আলাদা-আলাদা করা যায় না। শব্দ ও বাক্যের মানে বাইরের বস্তুজগতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থেকেই কেবল গড়ে ওঠে না, পাশাপাশি অন্যান্য শব্দ ও অভিব্যক্তির কারণেও শব্দের নিহিতার্থ তৈরি হয়। চিন্তা ও কর্মে প্রোথিত থাকে ভাষা। নজরুলেরও তা-ই ছিল। ছিল তাঁর স্বজন ও পরিচিতের। শব্দার্থ উদ্ভূত হয় সামাজিক প্রসঙ্গভূমিতে। শব্দ ও চিন্তা, শব্দ ও কাজ, শব্দ ও বস্তু, এদের মধ্যে নিহিতার্থের অপরিবর্তনীয় সম্পর্ক যে থাকে না, তা অভিধান খুললেই টের পাওয়া যায়। শব্দ ও অভিব্যক্তি মাত্রেরই থাকে অপার মানে-সম্ভাবনা। অধিপতিরা এই সম্ভাবনাকে খাটান। যে আলোচকরা কাজী নজরুল ইসলামকে নাকচ করে দিতেন, এখনও নাকচ করে দিতে চান, তাঁরাও খাটান এই সম্ভাবনা।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতারা খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে আধুনিকতাবাদী ঐতিহাসিকতার নকশা প্রয়োগ করে যে গল্পটি লেখার চেষ্টা করেন, তাতে বিভিন্ন কালখণ্ডের একই পথ-বরাবর, তাঁদের নিজেদের পোঁতা মাইল-পাথরের বুড়ি ছুঁয়ে, এগিয়ে যান। সে-পথ, যাদের এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’, এবং রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘উচ্চবর্গ’, তাঁদের চেনাজানা। আশপাশ থেকে যে আরও নানা পথ নানা দিকে চলে যাচ্ছে, যায়, তা তাঁরা খেয়াল রাখেন না, কেননা সেসব পথ, প্রথমত তাঁদের পরিচিত নয়, দ্বিতীয়ত তাঁদের নিরিখ-নকশায় খাপ খায় না, এবং তৃতীয়ত তাঁদের স্বীকৃতি পায় না। সাহিত্যের ইতিহাস চর্যাপদ থেকে বিভিন্ন দিকে এগিয়ে গেছে অজস্র সাংস্কৃতিক কাজের মাধ্যমে। ইতিহাস তো অতীত। রেখা টানতে হলে অগুনতি জাতি, গোষ্ঠী, বর্গ, শ্রেণি, ধর্ম, সম্প্রদায়, অঞ্চল, মতাদর্শ সবকিছুর জন্যে বিভিন্ন দিকে টানতে হয়। পেঁপের বীজ থেকে অজস্র পেঁপের বীজ আর তার প্রতিটি থেকে আরও অজস্রের মতন হবে রেখাগুলো। একটিমাত্র তত্ত্ব বিশ্বের ধারণাটি ভুল ও তা মানবজাতির পক্ষে ক্ষতিকর। বাঙালি বলতে কেবল কলকাতা-ঢাকার শহরাঞ্চলের অতিশক্ষিত বর্গটিকে বোঝায় না। বলাবাহুল্য যে প্রথমে হিন্দু পরে খ্রিস্টধর্মী মাইকেল, ব্রাহ্ম জমিদার সন্তান রবীন্দ্রনাথ এবং নিম্নবর্গীয় যোদ্ধা মুসলমান ও পরে সর্বসম্প্রদায়ি নজরুল ইসলাম একই পথের মাইল-পাথর নন।

রচনাকাল: ১৯৯৬, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো