
এটিচ্যুড ব্র্যান্ডিং
পর্ব ১
চয়ন খায়রুল হাবিবপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০১৮
স্মৃতিপাঠ ১.
মনে হয় সেটাই ছিল বাংলা একাডেমিতে স্বাধীনতার পর প্রথম বইমেলা। খুব সম্ভবত বোনদের হাত ধরে সেখানে গিয়েছিলাম। অনেকেই চাদর বিছিয়ে নিজেদের বই বিক্রি করছিল। তাদের ভেতর ছিল চোয়াল গর্তে ঢোকা, পিঠে পেট ঠেকা, ইয়া লম্বা নির্মলেন্দু গুণ। ওর প্রকাশক ছিল খান ব্রাদার্স। এখনো নির্গুনকে লোকে এদেশে, ওদেশে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। খান ব্রাদার্সও নিশ্চিত কলেবরে অনেক বেড়েছে। কিন্তু সত্তরের তরুণ কবিদের যেভাবে বরণ করেছিল, শুধু খান ব্রাদার্স কেন অন্য কোনো প্রকাশনীই তরুণ কবিতার প্রতি আর তেমন মমতা দেখায়নি। নির্গুণ নিজেই একটা ব্র্যান্ড, হাটাবাবা ব্র্যান্ড। ওর সেই বাংলা একাডেমির মাঠে ছড়ানো চাদরেই চাদোয়া বানিয়েছে লিভার ব্রাদার্স, মেরিলসহ আরো গ্রুপেরা। কিন্তু চাদোয়াটা আসলে আরো বড়। কল্পনাতে যার শেষ, রূপকথাতেই পরিচয়।
স্মৃতিপাঠ ২.
ঢাকার আজিমপুরে বড় হয়ে উঠবার সময় লিটেল এঞ্জেলসস, ওয়েস্ট এন্ডে পড়বার সুবাদে আমার বন্ধু বান্ধব ছড়ানো ছিল লালবাগ, পলাশি, নওয়াবগঞ্জ, হাজারিবাগ, ঝিগাতলাতে। পুরান ঢাকার অনেক বাসাই ধা করে উঠে গেছে সটান রাস্তা থেকে। চৌকাঠ পেরোলেই উঠান বা এলোমেলো গলিপথ। কয়েকজন বন্ধুর বাবা ছিল ঝিগাতলার ট্যানারি মালিক। ট্যানারির পাশেই এদের আলিশান বাড়ি। ট্যানারি মালিকদের ভিতর দুই অঞ্চলের লোকেরাই প্রধান; ঢাকার কুট্টি এবং নোয়াখালির। আমার বন্ধুরা ছিল কুট্টি। এদের ভালো লাগত মুখের বুলি এবং গালাগালের কারণে। ইস্কুলে এরা আসত সাধারণ পোষাকেই, কিন্তু এখন বুঝি সেগুলো ছিল ইজিপশিয়ান কটন। জন্ম থেকে এরা বাসাতে ইটালিয়ান, ফরাসিদের দেখছে। গোরারা আসত ব্যাগ, জুতা বানাবার প্রসেস চামড়া কিনতে। এসব ট্যানারির কল্যাণেই চলে আরমানি, ইভ স্য লোরেন, ডলচে গাব্বানা, শ্যানেল। বিশ্বজুড়ে এসব ট্যানারি মালিকের বিনিয়োগ। কিন্তু নিজেদের কোনো ব্র্যান্ড এরা কখনো দাঁড় করাতে চেয়েছে বলে শুনিনি।
ব্র্যান্ড কি?
এটা একটা নাম হতে পারে, কিম্বা একটা প্রতীক অথবা স্লোগান! আইনগতভাবে যখন একটা ব্র্যান্ড সংরক্ষণ করা হয়, তাকে বলা হয় ট্রেডমার্ক! স্ববিশেষে ব্র্যান্ড হচ্ছে নির্দিষ্ট সেবাসামগ্রী বা ব্যাবসায়! বিবর্তিত হতে হতে এটা মূল পরিচয় ছাড়িয়ে অন্য সেবাসমগ্রীতেও সংহত হতে পারে!
ব্র্যান্ড কেন?
গরুছাগলের হাটে একজনেরটার সাথে আরেকজনেরটা মিশে গেলেও যাতে আলাদা করা যায়, তার জন্যই শুরু হয়েছিল লোহা পুড়িয়ে গবাদি পশুর গায়ে মালিকানা প্রমাণের সিলগালা বা ব্র্যান্ডিং! মনে আছে কি স্মৃতিপাঠ ২- এ আমি ঝিগাতলার ট্যানারি শিল্পের উল্লেখ করেছিলাম। এখানে এ শিল্পে লোহা পুড়িয়ে মালিকানার বিবর্তিত ব্র্যান্ডিংয়ের সিলগালা পড়াচ্ছে কারা তা আগেই উল্লেখ করেছি! এতে যে ট্যানারি শিল্পের কোনো ক্ষতি হচ্ছে তা নয়। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিটা বোঝা যাচ্ছে।
কাঠাল, শাপলা, দোয়েলের হাত ধরে ধরে... NGO দের বাইরে...
বিশ্বায়িত ব্র্যান্ড হিশাবে আমরা কোকাকোলা, IBM, টয়োটা ইত্যকার আরো আরো অনেক কিছু জানি। বর্তমান পরিসরে আমি মূলত বাংলা ভাষার, বাংলাদেশের স্থানিক বাস্তবতাতে ব্র্যান্ড বিবর্তনের সূত্র ও বাধাগুলোর ইঙ্গিতগুলো ধরতে চাইব। প্রথমেই মনে পড়ছে বেইলি রোডে মহিলা সমিতি নাট্য মঞ্চের সামনে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির নামের কর্মযজ্ঞটির কথা। স্বত্বাধিকারী মনিরা এমদাদ ছোট্ট একটা দোকান দাঁড় করিয়েছিলেন এখানে ৭০ দশকের প্রথম দিকে। তখনো মধ্যবিত্তের চল ভারতীয় শাড়ি কেনা। নিউ মার্কেট্সহ যে কোনো বিপণি বিতানেই এইসেই কথার পর পেছনে রাখা ভারতীয় শাড়িগুলো পরে পরে দেখাতো একহারা চেহারার পুরুষ মডেলরা। মনিরা এসেছিলেন কুমিল্লা থেকে। স্বামী প্রকৌশলী। প্রকৌশলীদের লাখেরাজ দুর্নিতির কথা ধরেও আমরা জানি, এদের বৌরা সেই জমি কেনা, সেটের পর সেট জড়োয়া বানানো আর একঘেয়ে লাগলে ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে গিয়ে হরেদমে জুয়া খেলার নামে ঘুষ চালাচালি। মনিরাকে টাঙ্গাইলে গিয়ে শাড়ি বিপ্লবের বুদ্ধি দিয়েছিল, জানি না। ওনার নিজের শাড়ি পড়ার ভঙ্গিও, সে এক গল্প করবার মতো। গ্রামিনের, বিবি রাসেলদের অনেক অনেক আগে কুমিল্লার চকবাজার এলাকা থেকে আসা সদ্য বিবাহিত সেই যুবতী মনিরাকে যদি বাংলাদেশের কোকো শ্যানেল বলি তাহলে কি অতিরঞ্জন হবে?
সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির দোলাচল: যাত্রাপালার যাত্রাভংগ
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পত্তনি তৈরি করে দিয়েছিল `বিচিত্রা`, বিটিভি, মহিলা সমিতি এবং সেবা প্রকাশনী। বিচিত্রাতে সেই ছোটবেলা থেকে দেখতাম `অপসংস্কৃতি` শব্দটা। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী, আর বিটিভির মুস্তফা মনোয়ারের নির্দেশনাতে যখন সবাই জহির রায়হানসহ অন্যদের ঘাটতি পুষিয়ে পরিচিত হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ, সেলিম আল দীন, ক্যামেলিয়া মুস্তাফা, সুবর্না মুস্তাফাদের সাথে, একই সময় খলনায়কের আঙ্গুলি ওচানো শুরু হলো যাত্রার দিকে, যাত্রার রানিদের দিকে। যাত্রা দেখে ফাত্রা লোক, সেত ছিলই বাংলা বোলচালে শত বছর ধরেই। তাতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে বা ঢাকার বনেদি বাড়িগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় যাত্রা প্যান্ডেলগুলোতে তেমন বিঘ্ন ঘটেনি। কিন্তু ঐ `অপসংস্কৃতি`র সিলগালা, যাত্রা ব্র্যান্ডটার বিবর্তন থামিয়ে দিল হঠাৎ। একই সাথে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন বলে যেটা শুরু হলো সেটাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পুরো সমর্থন নিয়েও উল্লম্ফিত একটা স্লোগান-ব্র্যান্ড হিশেবে ধুকে ধুকে পরিচর্যার জন্য মুখ থুবড়ে পড়লো NGO বাতাবরণে।
ইস্কুল খুইলাছেরে মওলা, ইস্কুল খুইলাছে
ব্র্যান্ড বিবর্তনের যে কোনো আলোচনায় হারানো যোগসূত্র হিশেবে যাত্রাপালা ধ্রুপদ দৃষ্টান্ত হিশেবে গণ্য হতে পারে। এই হারানো যোগসূত্রেই নিহিত কেন বাংলাদেশের মিডিয়া এত শতমুখি হয়েও সারাতসার বিহীন এবং যতটুকু সারাতাসার আছে তার কেন যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে পারে না। আর স্বীকৃতি যদিও বা দিল তখন কেন তা বিষয়নিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে মনে পড়ে যাচ্ছে, এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে, এই দিনেরে নিতে হবে সেই দিনেরো কাছে... সেই দিনেরো কাছে যাবার আগে অবশ্যই আমাদের মনে রাখা দরকার যে, হ্যাপি আখন্দ, ফিরোজ সাঁই, আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদদের নিয়ে যে কিংবদন্তিতুল্য ব্যান্ড `স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠি` বাংলদেশের মগ্ন চৈতন্যে হাজার বছরের একটা রুট ম্যাপ তৈরি করে দিয়েছিল তা আমরা কত তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলেছি। আজকে ওয়ারি বটেশ্বর খননের সময় আমরা অনলাইনে `স্পন্দনের` একটা গানও আর পাই না। আমরা জানতেই পারি না কেন ফিরোজ `সাঁই` হয়েছিলেন।
অঞ্জু ঘোষ থেকে গিনেস বুকের মোমতাজ
বিটিভির হিরামনের প্রডাকশান এসিস্ট্যান্ট ছিলেন তোজাম্মেল হক বকুল। `বেদের মেয়ে জোতস্না`র স্ক্রিপ্ট লিখে ধরণা দিতে দিতে কামিয়াব এই লোক ঠিকই পেয়ে গেলেন প্রযোজক। কথিত আছে যে, বক্স অফিস ফেল মারবার ভয়ে মূল পরিচালক নিজের নাম না দিয়ে স্ক্রিপ্ট রাইটারের নাম পরিচালক হিশাবে দিয়েছিলেন। তারপর একের পর এক বাম্পার। কোলকাতার উত্তম, সুচিত্রা পরবর্তী চলচ্চিত্র শিল্প তখন ফেলের চেয়েও ফেল। মধ্যবিত্ত টেকো ভিক্টর ব্যানার্জিকে যাও নেয় তাতে মালিকদের হলের ভাড়াও পোষায় না। অঞ্জুসহ `বেদের মেয়ে জোৎস্না` রিমেক হলো ওখানে। কোলকাতাতেও বাম্পার। কিন্তু অপর্না সেনের চামুণ্ডারা টনে টনে টঙ্কা বানানো অঞ্জু ঘোষকে না দিল সম্মান, না দিল স্বীকৃতি। কিন্তু কৌশলটা ছাড়ল না। সেই `হিরামন` কৌশল ধরে ধরেই আজকের মোমতাজ ব্র্যান্ড। তার পাশে বিকট পরচুলা পরে দাঁত কেলাচ্ছে হুমায়ূন ফরিদী। এই ইন্ডাস্ট্রি টাকা বানাচ্ছে, কিন্তু যে এফডিসি এর পৃষ্ঠপোষক তার কর্ণধর হচ্ছে আবার সেই ভিক্টর ব্যানার্জি, অপর্না গেলা স্নব সালাউদ্দিন জাকি। যে নেতৃত্ব দেয় আবার বনুয়েল দেখা, ফেলিনি মারানো `বাংলাদেশ চলচ্চিত্র আন্দোলনের`। যে আন্দোলনের কথা উঠলেই আমার মনে পড়ে যায় ঢাকা ক্যন্টনমেন্টের গ্যারিসন সিনেমা হলের কথা; যেখানে সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা, লুঙ্গি পরিয়া প্রবেশ নিষেধ। অন্তত গ্রুপ থিয়েটারের লোকজন এধরনের সাইনবোর্ড তাদের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে এখনো টাঙ্গাননি। এভাবেই মধ্যবিত্ত শুধু না, তাদের অনুকরণে নিম্নবিত্তরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা এসব থেকে। ক্রিকেটের ধক্কর, মক্কর, চক্করে যত বিনিয়োগ হয়, তার কিয়দংশও ব্যয় হয়না নৌকা বাইচের পেছনে। এখানে ক্রিকেট অনুরাগীরা যখন চাপানো ব্র্যান্ডগুলোতে অভ্যস্থ হবার অপরাধবোধী নস্টালজিয়াকে ভারসাম্যে আনতে `সাব অল্টার্ন` জাতীয় শব্দ সম্ভারের আমদানি ঘটায়, তাও হয়ে পড়ে কর্পোরেট লিভার ব্রাদার্সের বিজ্ঞাপন। এ শব্দ সম্ভারগুলো আনা যাবে না তা বলছি না, কিন্তু এগুলো ঠিক মনিরা এমদাদ, অঞ্জু ঘোষ, মোমতাজকে ব্যাখ্যা করছে না। চাইলেও পারছে না।
ব্র্যান্ড বুঝতে `সাবল্টার্ন` শুভঙ্করের ফাঁকি বই নয়
অনেক NGO কর্মী, মার্ক্সবাদের অনুসারী Subaltern শব্দটা ব্যবহার করে। বুঝেই করে হয়ত। কিন্তু আমার ব্র্যান্ড প্রস্তাবনাতে তা একেবারেই দরকার নেই। তা সে ফুকো থেকে আসুক, আর চোমস্কি থেকে আসুক। অবশ্য এরা এই শব্দের উদ্গাতাও নয়। কেন এই সাবল্টার্ন ব্রান্ড-মেনেজমেন্টের ক্ষেত্রে দরকারি নয় তা একটু দেখা যাক:
ল্যাটিন ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী subaltern হচ্ছে অধস্থন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এই শব্দের ব্যবহারও প্রায়োগিক ভাবে কাপ্তেনের নিচের সারির অধস্থন কমিশন অফিসারদের বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। হতে পারে যে, ১৯৭৫এর বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদবিধারী যে সৈনিকেরা জড়িত ছিল তাদের বোঝাতে এবং তাদের প্রতি সহানুভুতিশীল বেসামরিক রাজনীতিক তাত্ত্বিকরা ক্যাম্পাসগুলোতে এই শব্দটা ছড়িয়ে দেয়। এখন মনিরা, অঞ্জু ঘোষ, মোমতাজ বিভিন্ন শ্রেনি থেকে আসলেও এরা শুরু থেকেই empowered। সাবল্টার্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এদের empowerment বিমূর্ত হয়ে পড়ে। এদেরকে স্বীকৃতি দেবার আর দরকারই পড়ে না। এখানেই কি মৌলবাদী NGO এবং বাম NGO দু`পক্ষ্ই এই সেই আন্দোলনের নামে যা করেছে, তা ব্যক্তির অবদানকে গৌণ করতে, করতেই অনিবার্যভাবে ব্যক্তির সাথে কর্পোরেটের দর কষাকষিকে দুর্বল করে ফেলছে না? মৌলবাদ এটা করছে বুঝেশুনে। আর অতি বামেরা করছে পানি ঘোলা করে যট্টুকু যা আদায় করা যায় তার স্বার্থ সামনে রেখে। ব্যক্তি ও ব্র্যান্ড এগিয়ে গেছে। কিন্তু তত্ত্ব এগোয়নি। যাকে বলা হচ্ছে তত্ত্বের বিবর্তন, তা যে একের পর এক বিমূর্তের স্তর বদল, তাও হয়ত ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন Attitude Branding এ যাবার আগে এই মনিরা, অঞ্জু, মোমতাজের সাথে তত্ত্বের বিমূর্ত বিবর্তনের দূরত্বটা দেখার জন্য এদের বিপরীতে বসিয়ে দেয়া যাক কাদের সিদ্দিকি, আওরংগ এবং গোলাম ফারুক অভিকে।
চলবে