
এটিচ্যুড ব্র্যান্ডিং
শেষ পর্ব
চয়ন খায়রুল হাবিবপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৯, ২০১৮
মিথের বিকৃতি এবং ব্র্যান্ডের অবমূল্যায়ন
একজন বাউলের কাছে তার কেন্দ্র হচ্ছে গুরু। মু্রিদের কাছে পির। মাইজভাণ্ডার থেকে মহাস্থানগড়ের সুলতান শাহ বলখির মাজারে যাত্রা ফিরতি যাত্রার মুখে সহজিয়া বাউলদের দেখা হয়েছে সহজিয়া সুফিদের। সহজিয়া মরমিয়া ব্র্যান্ডটাকে উৎখাত না করেই শ্যামাসঙ্গীত জায়গা করে নিয়েছে সুফি দর্শনের ভজন সাধনে। ব্র্যান্ড এখানে বিভেদের চলক নয় বরং পথবন্ধন।
১৯৫২, ১৯৭১ এর প্রতিরোধগুলো দিয়ে বাঙালির মানসে যে পটভূমি তৈরি হয়েছে এবং ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যে বিভিন্নমুখি তত্ত্বের উপস্থাপনা তাতে মিথগুলো অবমূল্যায়িত হতে হতে এরকম পর্যায়ে এসেছে যে, আমরা যোগসূত্রকে মনে করছি দেয়াল আর কুলাঙ্গারদের মনে করছি কিংবদন্তি। একটা বড় মিথ দাঁড়িয়ে থাকে অনেকগুলো ছোট ছোট মিথের ওপর ভর করে। রিলে রেসে যেমন পরের দৌড়বিদের কাছে হাতের খাটো ছড়ি পৌছে দেয় দৌড়বিদ ছুটতে, ছুটতেই; সাধকেরা তীর্থে তীর্থে সেরকম এ ওর কানে নতুন শব্দ, নতুন সুর তুলে দেয়।
প্রতীকের ছদ্মনামজারি: হাজার বছরের টেলিমেকাস
`রৌদ্র করোটি` পর্বের পর কবি শামসুর রাহমান তার কাব্যকৃতিতে তিরিশীয় প্রভাব ঝেড়ে ফেলেছিলেন হেঁচকা টানে। `স্বাধিনতা তুমি`র লেখক বাংলা ভাষার বাংলাদেশি প্রমিতের পত্তনি ঘটানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বাঁককে করে তুলেছিলেন তার কবিতার আত্মীকৃত ব্র্যান্ড। প্রমিতের পত্তনি ঘটানো স্বত্ত্বেও আইয়ূবি স্বৈরতন্ত্রের পাকিস্তানি আমলে শামসুরকে গ্রিক পুরানের প্রচ্ছন্নতায় আড়াল করতে হয়েছিল একটা জাতির প্রাণভোমরা। `আসাদের শার্ট` এর কবি স্যাম্পসন, টেলেমেকাসে তার ভাষাভাষি সম্প্রদায়ের কাছে জানিয়ে দেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতে যাদের খলনায়ক হিশেবে দেখানো হচ্ছে তারাই আসলে নায়ক। `ইকারুসের আকাশ` এর যে স্বপ্নচারিতা, তাসহ স্যাম্পসন, টেলিমেকাস কবিতাগুলো যে বঙ্গবন্ধু ব্র্যান্ডের স্বাগত সঙ্কেত তা শামসুর জানিয়ে গেছেন তার আত্মজীবনীতে। তবে পর্ব থেকে বিচিত্র পর্বান্তরে শামসুরের যে বিচরণ তার স্বচ্ছন্দতার মূল শর্ত কালিক বাস্তবতার নান্দনিক আত্মীকরণ, প্রস্তুতি ছাড়া এ আত্মীকরণের অনুকরণের অবকাশ নেই। কারণ ব্র্যান্ড কখনোই বিমূর্ত নয়। ব্র্যান্ড একঅর্থে সময়েরই ব্যক্তিক অভিপ্রায়।
ব্র্যান্ডের সঙ্কেতসূত্র হেয়ালি নয়
মিথ, প্রতীক, ভাষার পরোক্ষতা ছাড়িয়ে ব্যক্তি তখনই ব্র্যান্ড যখন তার মূল্যমান দাঁড়িয়ে যায়; বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গ-নৈপুণ্যে বা সঙ্গ-ব্যবচ্ছেদে এবং গ্রহণযোগ্যতার প্রসার বা সঙ্কোচনে যখন তার মূল্য বাড়ানো বা কমানো যায়। আগেই বলেছি বিবর্তনের সূত্রে মূল ব্র্যান্ডের বিকাশ ঘটতে পারে, ঘটতে পারে বিকৃতিও। যে `জাতীয় কবিতা পরিষদ’ এর অন্যতম স্থপতি ছিলেন শামসুর রাহমান, নব্বইয়ের দশকে সেই মঞ্চেই দাঁড়িয়ে শামসুরের স্যাম্পসন কবিতার সূত্রে তাকে বলা হয়, ইহুদি তোষণকারী। বিকৃতি এবং মিথ্যাচার ঘটিয়ে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সমস্ত ব্র্যান্ডের অবমূল্যায়নের যে প্রয়াস নেয়া হয়েছিল সুনির্দিষ্ট একটা জাতীয় কবিতা পরিষদ সেমিনারে তার প্রতিবাদ করেছিলেন তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর মফিদুল হক।
বাংলা ভাষার, বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংয়ের চলমানতায় কায়েমি স্বার্থ যেমন বারবার অন্তরায় হয়েছে; সেরকম সেই কায়েমি স্বার্থকে নিজেদের অবস্থানগত কারণে ধারণ করেছে বাংলাদেশের আপাতবিরোধি রাজনৈতিক দলগুলো। এখানে ব্র্যান্ডিং হিশেবে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে প্রায় একটা অলিক শব্দ। আর যেসব শব্দ হবার কথা আধি দৈবিক এবং অলিক সেগুলো হয়ে গেছে বাস্তবিক। আর তা হয়েছে সেনাশ্রয়ী মৌলবাদী এবং কথিত মার্ক্সবাদীদের কল্যাণেই। মনিরা এমদাদ, অঞ্জু ঘোষ, মোমতাজ যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের পড়া না পড়েই বিশ্বায়িত বেশুমার ব্র্যান্ডিংয়ে নিজেদের যোগ করে নিয়েছে; সেরকম সাধারণ মানুষের সাধারণ জ্ঞ্বান থেকেই কাদের সিদ্দিকী, আওরংগ, অভিরা নিজেদের অবমূল্যায়িত করে তুলে দিয়েছে বেচাকেনার হাটে।
আর এই সাধারণ্যের হাটে আমরা জেনে গেছি যে, যাদের subaltern বলে ভুজুং দেয়া হচ্ছিল তারা কেউ ড. কামাল হোসেন, রাশেদ খান মেননদের বিশ্বাস করে না। কিন্তু বিশ্বাসহিনতার শূন্যতায় ব্র্যান্ড কি ব্যক্তি পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে না? বরিশালে তেমন একটা আয়াস না দিয়েই সন্ত্রাসী অভি হারিয়ে দিয়েছিল মেননকে।
যারা কামাল, মেননদের চিনে ফেলেছিল, তারা তা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েই। এই রিলে রেসের সহজিয়ারা আবার কিন্তু গোয়ার গোবিন্দও নয়। সারা দুনিয়ার সহজ মানুষের মতই স্বস্তারটা ছাড়বে না। আবার উদ্যোগ নেয়াতেও থামছে না। আবার উদ্যোগের ক্ষেত্রে এরা যা শুনল তাই বিশ্বাস করে বসে থাকলে মসজিদের ইমামদেরই বারবার নির্বাচিত করতো। ইমামদের এরা নির্বাচিত করছে, কিন্তু বারবার নয়। কারণ এরাও সস্তার জীবনের ভেতরেই ব্র্যান্ডের বদল চায়। সে ইন্দিরা এসে করে দিক আর টেলিনোর করুক। এবার ব্র্যাক এবং গ্রামিনের আলাপে আসা যাক।
বিনিয়োগ এবং ব্র্যান্ড
বাংলাদেশের যে সেবা শিল্পখাত তার বৃহদাংশ NGO এবং বেসরকারি খাত নিজেদের ভেতর ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে। সংখ্যাগুরু জনগণ কোনো না কোনোভাবে এ কর্মযজ্ঞে যোগানদার হলেও তার মুনাফা থেকে বঞ্চিত। যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ভারসাম্যের কথা বলে তারা চলক হিসেবে কেউ সেনাবাহিনীকে, কেউ NGO দের, কেউ ব্যাবসায়ী শ্রেণিকে গুরুত্ব দেন। যারা জনগণের সাথে যোগাযোগ রাখেন তারা আবার এই চলকগুলোর হয়েই প্রতিনিধিত্ব করেন। সুদ যাই নিক, টেলিনরকে যাই দিয়ে দিক; `গ্রামীণ` তার আয়ের একটা বিশাল অংশ বাংলাদেশে ব্যায় করছে। অধ্যাপক ইউনুসকে বামেরা যেভাবেই দেখুক, জেনারেল মঈনের সময় তাকে যেভাবেই আরোপ করা হোক, শেষতক মোদ্দায় দাঁড়াচ্ছে যে, এ ভদ্রলোক বাংলাদেশ ছেড়েও চলে যাননি, গোয়ারের মতো ব্যর্থ রাজনীতির দলও ধরে রাখেননি। যেটা পারেন ভালো করে, তাই করছেন। অর্থাৎ টাকা দিয়ে টাকা বানাচ্ছেন। আমি পারলে আমিও বানাতাম। এখানে কিন্তু আরেকটু কথা থেকেই যাচ্ছে। এই ভদ্রলোক শিবির করা লোকদেরও `আলোকপ্রাপ্ত` বলে বেড়াচ্ছে না। অর্থাৎ নিজের ব্র্যান্ডের দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের স্বার্থেই ব্র্যান্ড বিনাশি চলকগুলোকে তার চিহ্নিত করতে হচ্ছে। আর এই চিহ্নিত করণের জায়গাতেই চলে আসছে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ব্যাপারটা।
একটি কুড়ির চারটি পাতা
বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের সাথে সম্পর্কের ঐতিহাসিক দিকগুলোও দেখা দরকার। এখানে নিজেদের ব্র্যান্ডিংয়ের প্রতি জোর দেয়াটা যেমন জাতীয়তাবাদী মোড়কে করা ঠিক না, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশনাসহ অন্যান্য সেবাসামগ্রীর প্রতি নিস্পৃহতাও সাম্প্রদায়িকতা বলে গণ্য হওয়া ঠিক নয়। ভারতের আসাম অঞ্চলের চা আসাম টি, শ্রিলঙ্কার চা সিলোন টি হিশেবে পরিচিত হলেও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংইয়ের চা কিন্তু বেঙ্গল টি বলে পরিচিত নয়। দার্জিলিংযের চা যেমন সেখানের স্থানীয় নামেই পরিচিত, সেরকম সেখানকার স্থানীয়রাও এই ব্র্যান্ডিংইয়ের সূত্র ধরেই আরো স্বায়ত্বশাসন দাবি করছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সিলেট অঞ্চলের চাকে বেঙ্গল টি হিশেবে অনায়াসেই বাজারজাত করতে পারে। পণ্যটা এরই মধ্যে বাজারে। শুধু ব্র্যান্ডিংয়ের অপেক্ষা। নিজেদের ব্র্যান্ডিংগুলোকে সংহত করবার স্বার্থেই বাংলাদেশের খেয়াল করা উচিত, কেন পশ্চিমবঙ্গের আমলাতন্ত্রের সাথে দার্জিলিঙ্গের স্থানীয় গুর্খাদের সম্পর্ক ক্রমাবনতশীল। এই শিক্ষা থেকেই বাংলাদেশের দরকার চাকমাদের, মনিপুরিদের, গারোদের, বিহারিদের নিজস্ব ব্র্যান্ড বিকাশে উৎসাহিত করা।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে বাণিজ্যিক ঘাটতি, সেটা পশ্চিমবঙ্গকে কোনো ছাড় দিয়ে মেটানো যাবে না। বলিউডকে নাকি পশ্চিমবঙ্গকে ছাড় দেয়া দরকার, সেটা দেখলে বলিউডকে ছাড় দেয়াটাই সঙ্গত। তবে এর সাথে যদি এটা আদায় করা যায় ভারতের বাজারে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা যেতে পারে তাহলে তোফা। প্রতি ছবির বদলে দশটা বৃত্তি। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ, নেপালকে বেড়া দিয়ে ঘেরার সবচেয়ে জোরালো লবি পশ্চিমবঙ্গ আসছে। পশ্চিমবঙ্গের ওরা সদিচ্ছা দেখাক তারপর আনন্দবাজার পড়া যাবে। ওই সদিচ্ছার আগে আমাদের দরকার প্রবল attitude branding, attitude marketing!
এক হিশেবে বিশ্বব্যাঙ্ক ও EEC এর মতো পালোয়ানদের বাংলাদেশের সাথে লেন দেন না করলেও কিচ্ছু যায় আসবে না। এ পক্ষগুলো চীন ও ভারতের সাথে যোগাযোগ সেরেই বার্মার থেকে যা তেল নেবার তা সবার সামনে দিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং যাচ্ছেও। তাহলে বাংলাদেশের সাথে এরা যোগাযোগ রাখছে কেন? ভারত ও চীন অবশ্যই, আবার এ-শতকের ইতিবাচক প্রবৃধ্বির চলকে যে ১১টা অঞ্চলে `আসিতেছে` তকমা ঝোলানো হয়েছে তাতে বাংলাদেশও আছে। ওই প্রবৃদ্ধির লাভের গুড় খেতে সব ইঁদুরের দাঁতই কাটুস কুটুস করছে।
এখানে সব পক্ষ্যকেই benifit of doubt দেয়াটাই কি সঙ্গত নয়? যে রকমই পিং পং রাজনীতি একসময় হয়েছে; যেভাবেই উপনিবেশিক আমলকে বিভিন্ন তাত্ত্বিক সব নষ্টের গোড়া হিশাবে দেখিয়ে থাকুক; পরিস্থিতি বার্লিনের দেয়াল ভাঙার পর বদলেছে অনেক দ্রুত; বাজারে এসেছে ইয়াহু, aol, google। বাজার বাড়তে, বাড়তেই খোদ EEC এর ভেতর পুরো ফেল মেরে বসে আছে গ্রিস। এই ফেল মারাটা কিন্তু জুজুর ভয় নয়! সদিচ্ছার সাথে attitude থাকলেই এই বাস্তবিক জুজুটাকে এড়ানো যেতে পারে। এখানে attitude টাই ব্র্যান্ডিং।
এই attitude থেকেই যে coammand তৈরি হয় তার কারণেই শেখ হাসিনাকে এত চক্করে ফেলেও কমান্ডার মঈন গদ্দিনশীন হতে পারেনি। এ attitude branding এর দাবিদার খালেদা জিয়াও। কিন্তু তাও আবার বিবর্তিত এবং আরোপিত ব্র্যান্ডিংয়ের অবমূল্যায়নের ফলশ্রুতি। রিয়েল ব্র্যান্ডিং নয়।
শব্দদূষণ এড়াতে নতুন ব্র্যান্ডের শব্দকোষ
মনে আছে কি সেই ঘর পালানো বাহাদুরদের? attitude branding এর বাংলা হচ্ছে আলাউদ্দিন খান। attitude marketing এর বাংলা হচ্ছে অতিশ দীপঙ্কর। আর attitude এর বাংলা গোয়ার্তুমি না কি ওকি গাড়িয়াল ভাই? ব্র্যান্ডের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে চলে আসে সংরক্ষণ, বিবর্তন। নাবালকের আবদার, সাবালকের দাবি দুটাকেই যোগানের, চাহিদার ভারসাম্যে আনার আগে স্বস্তিকা ওলটানো সেই বিধ্বংসী ব্র্যান্ডটার কথা মনে রাখা ধরে নিতে হবে উলটো করে দিলেই যদি স্বস্তিকা অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে; ভাবডা উপস্থাপনাতেও তা মানবিক উচাটনগুলোর উপশম ঘটাবে না। উপশমের স্মরণ হলো আমরা যে অস্টশিলা ব্র্যান্ডটা চোখের আড়ালে নিয়ে যাই; চোখের মনিতে তা ধারণ এবং লালন। সনাতনের হরণ করে রামকিঙ্কর। অন্তর ব্র্যান্ডের ব্যান্ডপার্টি ঝমঝমায় বাজে সুলতানের ক্যানভাসে।
আমাদের হাতে মনিরা, অঞ্জু ঘোষ, মোমতাজ আছে। ইউনুস সাহেব টাকা বানাতে জানেন। নির্মলেন্দু গু্ণের সেই মাঠে পাতা চাদরই আমাদের চাদোয়া। কোন দেয়াল আমাদের আটকাতে পারবে না।