এহসান হাবীব

এহসান হাবীব

এহসান হাবীবের আত্মগদ্য ‘এই অবরুদ্ধ সময়ে’

প্রকাশিত : আগস্ট ১১, ২০২১

অনেকদিন হলো আমি বাড়ি ছেড়েছি। শীতের আমেজ শেষ হয়ে আসছে, ফাল্গুন আসি আসি করছে এরকম একটা হালকা কুয়াশাময় সন্ধ্যায় একটা লাগেজ সঙ্গি করে আমি নিঃশব্দে বাড়ি ছেড়েছিলাম। চাকরি চলে যাওয়ার একবছর পর আমি রুটি-রুজির গরজে অনেক দূরের শহরে একটা চাকরি নিয়েছিলাম। সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গা, অনাত্মীয় পরিবেশ, বন্ধু-বান্ধবহীন একটা জায়গা। সাগরের বিশালতা, পাহাড়ের উচ্চতা সবই সেখানে ছিল। কিন্তু আমি চিরকাল আত্মীয়-বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে থেকেছি, থাকতে চেয়েছি। একান্ত নিজের শহরে একটা জাদুময়তার ভেতর শেকড়-বাকড় গেড়ে বসে থাকতে চেয়েছি। কোনোদিন ভাবিনি এই জাদুর শহর ছেড়ে আমাকে একদিন অন্ধ অন্ধকারে অজানায় উড়াল দিতে হবে।

এই অবরুদ্ধ সময় আমাকে অনবরত কোথায় কোথায় না ছিটকে নিয়ে ফেলছে? কক্সবাজারে প্রায় দুই বছর ছিলাম। তারপর আজ আটমাস ধরে এই নতুন শহরে। এখানে কর্মস্থলের লাগোয়া একটা বাসায় আমি থাকি। বাসা আর অফিসের বাইরে কোথাও যাওয়া হয় না আমার। এখানে পুরনো দু’একজন বন্ধু আমার আছে বটে তাদের বিস্তর অভিযোগ আমার এই ঘরকুনো থাকা নিয়ে। কিন্তু আমি আসলে সাহস পাই না। মামলা, চাকুরিচ্যুতি, অপহরণ— জীবনে পরপর ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো আমাকে বিপর্যস্ত  করে ফেলেছে। আমি এখন কথা বলতে, জনসমাগমে যেতে খুব একটা স্পৃহা পাই না। ‌`অবরুদ্ধ সময়ের কবিতা` নামে আমরা যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, তাতেও বন্ধুদের নিস্ক্রিয়তা, বিপ্লবীদের থেমে যাওয়া, কারো কারো পিছুটান মেরে যাওয়া আমাকে আরো অধিক নিস্পৃহ করে দিচ্ছে।

সারাদিন ভাবি, আমি বোধহয় ফুরিয়ে যাচ্ছি। পড়াশুনাও খুব একটা হচ্ছে না। একদিন অনেকগুলো বই কিনে নিয়ে আসি, পড়বো বলে। বইগুলো স্তূপাকারে পড়ে আছে।  লেখালেখি তো দূর অস্ত। খুব ছোট্টবেলায় স্কুলে আরবি ক্লাসে একটা গল্প পড়েছিলাম। কার লেখা মনে নেই। গল্পটা এরকম, নবি দাবিদার একজনকে আরবের বাদশা জেলে পুরে রাখে, রাত শেষে সকালে বাদশা তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, আপনি তো নিজেকে নবি দাবি করেছেন, তো, রাতে আপনার কাছে কী ওহি এসেছে শুনি? লোকটি স্মিত হেসে জবাব দেয়, আরে বাদশা! আপনি তো জানেন না জেলখানায় ফারিশতারা আসে না। তাহলে আমার কাছে ওহি আসবে ক্যামন করে? হাসির গল্প ছিল মূলত। কিন্তু এই গল্পটি খুব মনে পড়ে আজকাল। নিজেকে প্রবোধ দেই, নিজের ভেতর আত্মগরিমা আনতে চেষ্টা করি, জেলখানায় আমার লেখারা আসে না। হা হা হা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব লিখতে ইচ্ছে করে। আমার লেখা হয় না।

একটা কবিতার পাণ্ডুলিপি তৈরি করার চেষ্টা করছি। কিন্তু একবই কবিতা হচ্ছেই না। সারাদিন বসে থাকি, শুয়ে থাকি, মেয়েদের সঙ্গে খেলা করি, ছোট মেয়েটা খুব বুড়িদের মতো কথা বলে। সারাক্ষণ ওর পাকনা পাকনা কথা আমার যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়। তবু মাঝে মাঝে আমার তৃষ্ণার্ত লেখকসত্তা জেগে ওঠে। আমাকে বিপন্ন করে দিয়ে যায়। তখন আমি বারান্দায় গিয়ে বসি। আমার বাসার আশপাশে অত বসতি নেই। সামনে হাইওয়ে সড়ক। লোকজনের তেমন আনাগোনা নাই। এখন বর্ষাকাল। সারাদিন থেমে থেমে বিষ্টি হয়। বারান্দায় বসে বসে বৃষ্টি দেখি। রিমঝিম বৃষ্টি পড়ে, দু’একটা গাড়ি এই লকডাউনেও বৃষ্টির মধ্যেও শাই করে চলে যায়। ভাবি, এসব দৃশ্য সিনেমা টিভিতে দেখতে কী সুন্দর লাগে! আমার সামনের বারান্দায় বসে এই দৃশ্য অতটা সুন্দর লাগে না।

আমি পেছনের বারান্দায় চলে যাই। পেছনের বারান্দাটা তুলনামূলক অনেক ভালো। বারান্দা থেতে তিতাস নদী দেখা যায়। দুরত্ব শ’দেড়েক ফুট হবে। নদীর অইপাড়ে একটা মস্তবড়ো ফসলের মাঠ। অনেকটা খোলা ময়দান জুড়ে সবুজ। নদীর উপর বিষ্টি পড়ে, সবুজের উপর টিপটিপ বিষ্টি পড়ে। প্রতিদিন একটু একটু করে দেখি। কয়েকদিন আগে হঠাৎ বাসার সকলেই একযোগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেলাম। শরীর খুব দুর্বল লাগে। বারান্দায় যাওয়ার শক্তিটুকুও তখন পাই না। অল্প অল্প যাই। কিছুক্ষণ থেকে চলে আসি। বাসার দরোজা  বন্ধ করে শুয়ে থাকি। টিভি দেখি, মোবাইলে গেমস নিয়ে পড়ে থাকি। বাইরে ঠিক কতটা বৃষ্টি হয়, টের পাই না। আজ হঠাৎ পেছনের বারান্দায় গিয়ে দেখি, নদীতে অনেক বৃষ্টির পানি জমেছে। নদীর কূল উপছে পড়ছে, পেছনের সবুজ মাঠটা পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। অথচ আমরা জানতেই পারি নাই ভেতরে ভেতরে কত জল জমে গেছে।

আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা অজানা পুলক অনুভূত হতে থাকে। আমাদের সকলের অগোচরে কোথাও কি এভাবে বিপ্লব জমে উঠছে?

লেখক: কবি