এহসান হাবীব

এহসান হাবীব

এহসান হাবীবের গদ্য ‘আমার গানের বালিকারা’

প্রকাশিত : মে ০৪, ২০২৩

রস আস্বাদনের প্রেক্ষিতে আমার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পমাধ্যম হলো গান। বলা যায়, আমি গানের জন্য পাগল। গান আমার এতটা প্রিয় যে, গানের মধ্যে মজে গেলে আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে যাই। একটানা অনেকক্ষণ গান শুনতে শুনতে আশপাশের লোকজন বিশেষ করে স্ত্রী-কন্যার বিরক্তি ধরে গেলেও আমার কখনও বিরক্তি বা ক্লান্তি আসে নাই। কবিতা ও সাহিত্যের মতো গানের এই ঝোঁকটাও আমার ভেতর এসেছে আব্বার মাধ্যমে। আব্বা খুব গান শুনতেন। চাকরির কারণে আব্বা জীবনের অনেকটা সময় একা একা কাটিয়েছেন। সেই একাকিত্ব কাটানোর জন্যই কিনা আব্বা খুব গান শুনতেন।

 

আব্বার চাকরির বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে ভাটি বাংলায়। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় আব্বা চাকরি করেছেন। আমার মনে আছে, আমি যখন প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোইনি তখন আব্বা চাকরি করতেন কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার জাওয়ার নামের একটা এলাকায়। আব্বার অফিস ছিল বাজারের উপকণ্ঠে। জলাঙ্গীর বুক চিরে একটা মেঠোপথ, পথের দুই পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া। কৃষ্ণচূড়ার সারি একদম আব্বার অফিসের সামনে গিয়ে থেমেছে। গ্রাম এলাকায় অফিস থাকাতে আব্বা হয়তো নিঃসঙ্গতায় ভুগতেন। আব্বার একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডার ছিল। সেই টেপ রেকর্ডারে আব্বা শুনতেন হেমন্ত, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। আরো অনেকের ছিল।

 

তখন ফিতাঅলা ক্যাসেটের যুগ। একটা ক্যাসেটে ৬টা ৬টা ১২টা গান রেকর্ড করা থাকতো। এক ক্যাসেটে অনেকের মিক্সড গান থাকতো। আব্বা বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে আসতেন আবার শনিবার চলে যেতেন। যখন আব্বা শনিবার বাড়ি থেকে বেরুতেন অফিসের উদ্দেশ্যে আমি তখন তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য ভীষণ কান্নাকাটি শুরু করতাম। প্রায় সময়েই আব্বা আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতেন। সেকান্দর নগর পার হতেই জাওয়ারের মনোমুগ্ধকর রাস্তা আমার চিত্তকে আপ্লুত করতো। বিশেষ করে কৃষ্ণচূড়া ফোটার সময় তো জাওয়ারের রাস্তাটা অপূর্ব হয়ে যেত! আমি জাওয়ার গিয়ে একা একা ঘুরে বেড়াই, মাঠে মাঠে, জলের ধারে আর দুপুরের রোদে অফিসের ভেতর আব্বার থাকার কামরাটায় বসে বসে গান শুনি।

 

জানালার বাইরে নির্জন দুপুরের ভাটি বাংলা, সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার গাছ আর ভেতরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইছেন, মধুমালতি ডাকে আয়... গানের মর্মার্থ বোঝার সামর্থ নেই কিন্তু গানের সুরের ভেতর কখন যে বিহ্বল হয়ে পড়েছে তা জানতেও পারেনি সেই ছোট্ট বালকটি। সেই থেকে গান আমাকে আপ্লুত করে। পাগল করে। গানের সুর শুনলেই মন উচাটন হয়। কিন্তু বিধাতার কী খেলা, গান যার এত পছন্দ আল্লাহ তাকে সুর দেয়নি, গলা দেয়নি। আমার কর্কশ বেসুরো গলা। ফলে গান যারা গায় তাদেরকে মনে হয় যেন দেবদূত। যদি আচানক এরকম কোনও দেবদূতের দেখা পাই আমি তাকে যত্ন করি, ভালোবাসি, আগলে রাখার চেষ্টা করি। আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি গানের বিরাট কোনও সমঝদার। ব্যাপারটা এরকম না।

 

ক্ল্যাসিক্যাল গান আমার একদম পছন্দ না। আমি বাণীপ্রধান গানের ভক্ত। আধুনিক বাংলা গান, হেমন্ত মান্না দে, সতীনাথ, সন্ধ্যা, হৈমন্তী, পঞ্চ কবি, রবীন্দ্র, নজরুল, আমি মূলত এই টাইপের গানের ভক্ত। এমনকি অঞ্জন, সুমনেরও। আবার জেমস ও আইয়ুব বাচ্চুর গানও আমার পছন্দ। আমার এক বন্ধু আছে বাপ্পি। এসএসসি পড়ার সময় পাড়ায় ওরা ব্যান্ড গানের দল গড়েছিল। বাপ্পির গলা খুব ভালো ছিল। বাপ্পি আমাকে সন্ধ্যায় ব্রহ্মপুত্র পাড়ের নির্জনে জেমসের গান শোনাত। আমি ওর ভক্ত ছিলাম। কত কত দিন আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে বাপ্পির সঙ্গে হিপ্পি হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। শুভ্র ছিল। রঞ্জন শুভ্র এখন ডিবিসিতে খবর পড়ে। ওর গলাও খুব সুন্দর। শুভ্রকে অনেক অনেক অনুরোধ করলে পরে খালি গলায় সুবীর নন্দীর গান শোনাত।

 

জয়নুল পার্কে রাত বাড়লে শুভ্র আমাকে শোনাত সুবীর নন্দীর গান, ফুটে না কেন ফুল কদম ডালে/বহে না উজান কেন যমুনা জলে/ওরে ও সুবল, কী যে করি বল/মন যে পুড়ে কোন আগুনে... আমি তন্ময় হয়ে শুনি। কী করে গায় এত সুন্দর! ইচ্ছে করে নিজের গলা চিরে ফেলি। এই আমাকে একদিন দুপুর বেলায় পরিচয়ের অল্প কিছুদন পর রাখি চর শিরতার বিরান এক শিমুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে শুনিয়েছিল, যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়/যে ছিল হৃদয়ের আঙ্গিনায়/সে হারালো কোথায় কোন দূর অজানায়... গান শুনে আমি তো শ্যাষ। মনে হয়েছিল, এই মেয়েটিকে ছাড়া জীবন অসম্ভব। একজনম ওর কাছে থেকে শুধু গানই শুনে যেতে হবে। বহু বহুদিন রাখি আমাকে গান শুনিয়েছিল। আমি কান পাতলেই এখনো ওর গানের গলা শুনতে পাই।

 

রাখি চলে যাওয়ার পর আনন্দ মোহন কলেজের একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে লিপি একদিন চুপিচুপি আমাকে গান শুনিয়েছিল, সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে... এরপর আমি লিপির প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু লিপি আর কোনো দিন আমাকে গান শোনায়নি। আমি অনেকবার লিপিকে অনুনয় বিনুনয় করেছি, অনেক পাগলামি করেছি, আমার অন্য অনেক আবদার মেনে নিলেও অজানা কারণে মেয়েটা আমাকে আর গান শোনায়নি। এই যে গান শুনে প্রেমে পড়ে যাওয়া, এইটা একটা মারাত্মক অসুখ। আমি বিয়ের পর বউকে নিয়ে ভালুকার বনে বেড়াতে গেলে মাঝে মাঝে আমার বউকে গান শুনাতে বলতাম। বউ টিলাবাড়ির দাওয়ায় বসে আমাকে সন্ধ্যার গান শুনাতো। আমার গানপ্রীতির কথা তার জানা আছে।

 

মাঝে মাঝে সে গান রেকর্ড করে আমার ইনবক্সে পাঠাতো। অফিসে বসে বসে সে গান শুনে আমি বউয়ের প্রতি প্রেম জাগিয়ে রাখি। এখন বহুদিন হয় এ্যানি আর আমাকে গান শোনায় না। যেহেতু আমি জেনে গেছি, গান শুনে প্রেমে পড়া একটা অসুখ, সেই হেতু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেচে পড়ে কোনো মেয়েকে গান শুনাতে অনুরোধ করবো না। ফলে এ্যানিকেও আর গান শুনাতে বলি না। তবে, একদিন অনেক রাতে আমার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে যে নজরুল সঙ্গীত শিল্পী সে আমাকে ফোন করে কিচ্ছু না বলে শুধু গাইতে লাগলো, বলেছিলে তুমি তীর্থে আসিবে/আমারো তনুর তীরে/তুমি আসিলে না/তুমি আসিলে না হায়/আশার সূর্য ডুবিলো/ডুবিলো সাগর নীড়ে... আমি গান শুনে বিবশ হয়েছিলাম।

 

গভীর রাত্রে আমি সেই স্বল্প পরিচিত মেয়েটির প্রেমে পড়ে যাই। অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহায়ে সে যাত্রায় রক্ষা পাই। এরপর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, এইরূপ ঝামেলায় আর নিজেরে জড়াবো না। কিন্তু জীবন কি আর সব সময় সিদ্ধান্ত মিলিয়ে চলে। আমার এক অফিসের কলিগদের নিয়ে একটা প্রোগ্রাম ছিল। সেখানে এক কলিগ রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলো। মেয়েটার গলাটা ভালো ছিলো। গানের রেওয়াজ করতো মনে হয়। ভালো গাইলো। আমি ইম্প্রেজড। কথায় কথায় সেখানে আমি তাকে উৎসাহ দিতে গিয়ে আমার গানপ্রীতির কথা বলেছিলাম। তো সেই অফিসে ছিল এক মহা ধড়িবাজ মেয়ে, ফাঁকিবাজের উস্তাদ। নানা কারণেই আমি তার ওপর বিরক্ত ছিলাম। সে বোধহয় এইটার সুযোগ নিতে চেয়েছিল।

 

একদিন ফোন করে হঠাৎ বললো, স্যার একটা গান শোনাই? আমি কিছু না ভেবেই শুনাতে বলি, খুব আগ্রহ নিয়ে সে আমাকে শুনাতে লাগলো, কী জাদু করেছো বলো না/ঘরে আর থাকা যে হলো না... একটা মেয়ের গলা থেকে বেসুরো কর্কশ কণ্ঠে বাংলা সিনেমার এই গান শুনে আমি কতক্ষণ থ মেরে বসে থাকলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে শুধু খোদাকে বললাম, শেষ পর্যন্ত এই রেখেছিলে আমার কপালে!

 

লেখক: কবি