ওশোর দুটি চিঠি

অজিত দাশ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯

মাওলা ব্রাদার্স থেকে বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে ওশোর নির্বাচিত কিছু চিঠির সংকলন ‘প্রজ্ঞাবীজ’। অনুবাদ করেছেন অজিত দাশ। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। পাওয়া যাবে প্যাভিলিওন ১৬, মাওলা ব্রাদার্সের স্টলে। এ বইটি থেকে দুটি চিঠি—

চিঠি ২

গতকাল রাতে কেউ একজন মারা গেছে। তার ঘরে সবাই কান্নাকাটি করছে। আমারও বাল্যকালের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল— আমি প্রথম শ্মশানঘাটে গিয়েছিলাম। একদিকে চিতার আগুন জ্বলছে, অন্যদিকে লোকজন জড়ো হয়ে গল্প করছে। গ্রামের এক কবি বলছেন, ‘মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না, মৃত্যু তো আমার বন্ধু।’ পরে এ কথাটি লোকের মুখে নানাভাবে শুনেছি। আমি সেই লোকগুলোর চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে লক্ষ্য করেছি, ভয় থেকেই তারা অভয়ের কথা বলছে।

মৃত্যুকে ভালো কোনো নাম দিয়ে দিলেও এর কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রকৃতপক্ষে ভয় মৃত্যুর জন্য নয়, ভয় হলো অজানাকে জানার। যা কিছু অজানা, তা আমাদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করে। তাই মৃত্যুকে আমাদের জানা প্রয়োজন। আর এই পরিচয় আমাদের ভয় দূর করে দেয়। পরিচয়ের পর যা জানা যায়, তার কোনো মৃত্যু নেই। যে ব্যক্তিত্বকে আমরা ‘আমি’ বলে জানি, সেটির মৃত্যু হয়।

চিঠি ৩
একবার মন্দিরে গিয়েছিলাম। সেখানে সবাই পূজা-অর্চনায় ব্যস্ত। ভক্তরা মাথা নত করে মূর্তিকে প্রণাম করছিল। আমার সঙ্গে একজন বৃদ্ধ ছিলেন, তিনি বললেন, ‘ধর্মে আর মানুষের তেমন শ্রদ্ধা নেই, লোকজন মন্দিরে আসাও ভুলে গেছে।’ আমি বললাম, ‘মন্দিরে ধর্ম কোথায়? মানুষ কেমন আত্মবঞ্চক! নিজের হাতে তৈরি মূর্তিকে ঈশ্বর মেনে নিজেকেই বঞ্চনা করছে। নিজের তৈরি শাস্ত্রকে সত্য মনে করে তৃপ্ত হচ্ছে।’

মানুষের হাতে তৈরি কিংবা বুদ্ধি দ্বারা রচিত কোনো কিছুই ধর্ম নয়। মন্দিরে স্থাপিত মূর্তিগুলো ঈশ্বরের প্রতিরূপ নয়, এগুলো মানুষেরই প্রতিরূপ। শাস্ত্রে যা কিছু লেখা হয়েছে, সেগুলো মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও বিচারের প্রতিফলন মাত্র। সত্যদর্শন নয়। সত্যকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সত্যের কোনো প্রতিরূপ নেই। কেননা সত্য অসীম, অনন্ত ও অমূর্ত। তার কোনো নাম নেই, রূপ নেই, আকার নেই। সত্যকে কোনো আকার দিলেই তা অদৃশ্য হয়ে যায়।

সত্যকে পেতে হলে সমস্ত মূর্তি, সমস্ত ধারণা পরিত্যাগ করতে হয়। মানুষের চেতনা তার মনের কারাগৃহ থেকে মুক্ত হলে সেই অসৃষ্ট সত্য প্রকাশিত হয়। প্রকৃতপক্ষে সত্যকে পাওয়ার জন্য মন্দির স্থাপন করার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং মূর্তি না তৈরি করে সেগুলো বিলুপ্ত করা উচিত। আকার ধারণাকে পরিত্যাগ করতে হবে, যেন নিরাকার আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। মন থেকে মূর্তি সরে গেলে অমূর্ত প্রকট হয়ে যায়।

অমূর্ত সবসময়ই আমাদের মধ্যে রয়েছে কিন্তু মূর্তের আড়ালে চাপা পড়ে আছে— যেমন মালপত্রে ঠাসা ঘরের মাঝে খালি জায়গাটুকু আমরা দেখতে পাই না। মালপত্র সরালেই খালি জায়গা যেখানে ছিল সেখানেই পেয়ে যাই। সত্যের প্রকাশও ঠিক তেমনি। মনকে শূন্য করলেই তাকে অনুভব করা যায়, যা রয়েছে।

একুশে বইমেলা ২০১৮