‘কখনো লিখতে ইচ্ছে হয়নি, এমনটা মনে করতে পারি না’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২০

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের আজ জন্মদিন আজ। ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের যবগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মোহাম্মদ দোয়া বখশ ও মা জোহরা খাতুন। তার জন্মদিনে কথাসাহিত্যিক হামিদ কায়সারের নেয়া একটি কথোপকথন পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

তিনি রাঢ়ের সন্ত। সেই যে কবে একদিন কোনো এক কর্কশ রৌদ্রদিনে এসেছিলেন রাঢ়ের বুকে— পাশে বসেছিলেন রোদপোড়া ক্ষুধায় শীর্ণ হওয়া মানুষগুলোর, তারপর সারা দুপুর ঘুরে বেড়াতে লাগলেন রাঢ় কিশোরের হাত ধরে, তারপর কত রাত কত অন্ধকারের সাক্ষী হয়ে রইলেন, পার হয়ে গেল কত শীত-গ্রীষ্ম, বর্ষা-বসন্ত, সেখান থেকে আর সরলেনই না— আমৃত্য আজীবন থেকে গেলেন সেই সবুজ অন্ধকারে— সব লোভ-প্রলোভন, ঝকঝকে-চকচকে আধুনিক জীবনের সব টান, খ্যাতির মোহময় লিপ্সা— সব-সবকিছুই একে একে তার দৃঢ় ঋজু ব্যক্তিত্বের কাছে পরাভূত হলো আর বাংলা সাহিত্যের ভুবন সমৃদ্ধ হলো ক্রমাগত সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, আমরা অপেক্ষা করছি, নির্বাচিত গল্প, রাঢ়বঙ্গের গল্প, মা-মেয়ের সংসার— এর মতো এক-একটি যুগান্তজয়ী দিগন্তবিস্তারি ছোটগল্প গ্রন্থ, একমাত্র উপন্যাস বৃত্তায়ন এবং কথাসাহিত্যের কথকতা, অপ্রকাশের ভার, চালচিত্রের খুঁটিনাটি, সক্রেটিসের মতো ঋদ্ধ প্রবন্ধগ্রন্থে। একদিন মূল্যবোধের এই নিমজ্জনকালে শহরের আধুনিক জীবনের কাছে সমর্পিত এক সাহিত্যশ্রমিক ছুটে গেল রাঢ়ের সেই মানুষটির কাছে। তাকে কি আর শহরে খুঁজে পাওয়া যায়। স্বভাবতই তাঁর বাড়িটা রাজশাহী শহরতলির এক শান্ত-সৌম্য-নির্জন কোণে। সদাহাস্যময় হাসান আজিজুল হককে পাওয়া গেল তার আপন মেজাজেই।

হাসান আজিজুল হক: আত্মজা ও একটি করবী গাছের কথা বলছ তো! এটা ১৯৬৬ সালে লেখা।
হামিদ কায়সার: লেখার পটভূমিটা জানতে চাচ্ছি। কীভাবে কখন লেখা হলো?
হাসান আজিজুল হক: এই গল্পটা লেখার কিছুকাল আগে কোনো একটা বিয়ে-উপলক্ষে হায়াৎ মামুদ আর জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত— আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু— খুলনায় এসেছিল। খুলনায় এসেছি, অতএব হাসানের বাড়িতে যেতে হবে। আমার বাড়িটা শহর থেকে ১৪ মাইল দূরে ফুলতলাতে।

হামিদ কায়সার: পশ্চিমবাংলা থেকে এসে তো ওখানেই সেটেল করেছিলেন?
হাসান আজিজুল হক: ওখানেই সেটেল করেছি। বাড়িটা আমরা এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে পেয়েছিলাম। এখনো আছে। আমার ছোটভাই খুব যত্ন করে ও বাড়ির পুরনো চেহারাটা ধরে রেখেছে। গোল থামওয়ালা বাড়ি। আড়াই বিঘা জমির উপর। ভাঙা ঘাটওয়ালা পুকুর। জ্যোতি আর হায়াৎ সে-বাড়িতে গিয়ে এত খুশি হয়েছিল! ওরা দুজনই পাঞ্জাবি পরে গিয়েছিল— বরযাত্রী তো। বিয়েবাড়ি ফেলে চলে এসেছে আমার ওখানে। খুব আনন্দের সঙ্গে কাটালাম। তখন ওরা বলল যে, আমরা কালবেলা বের করছি। গল্প দিতে হবে। বললাম দেবো।

হামিদ কায়সার: তখন আপনি পুরোদস্তুর লেখক।
হাসান আজিজুল হক: তখন আমার সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য বেরিয়ে গেছে। ‘৬৪ সালে। আর এটা হলো ‘৬৬। আমি দৌলতপুর কলেজে চাকরি করছি। মাত্র ঢুকেছি আর কী! ওরা দুজন বেড়িয়ে-টেড়িয়ে আনন্দে সময় কাটিয়ে গল্প লেখার ভার দিয়ে চলে গেল আর ওরা চলে যাওয়ামাত্র আমি তখন তখনই লিখতে বসলাম।

হামিদ কায়সার: লেখার সব আয়োজন তৈরিই ছিল?
হাসান আজিজুল হক: কী লিখব ভাবতে বসলাম আর কী! আর উপকরণের কথা যদি বলো, কাগজও তখন কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়। কলম, যদ্দুর মনে পড়ে, চাইনিজ কলম খুব পাওয়া যেত। আর টেবিলটা ছিল তিন পা।

হামিদ কায়সার: টেবিল তো সাধারণত চার পায়ের হয়।
হাসান আজিজুল হক:  ওটার চারটা পা ছিল না। আর যে-দিকটায় ভর দেবো সে-দিকটা বসে যেত। এ-যে কী মুশকিল! বলো যে কীভাবে বেশি ভর না দিয়ে আলগোছে লেখা যায়। উপরটা ঠিক কাঠ ছিল না। একটা কাঠের মতো বোর্ড দিয়ে তৈরি করা ছিল। ওইখানে বসে, আমার ওই পড়ার ঘরে বসে, লিখতাম। আর এটা ঠিক গোটা প্রকৃতিটা পার্টিসিপেট করত। দরজাগুলো খোলা। দরজা যত বড় জানালাও তত বড়। জমিদারদের যেমন ছিল। শুধু গরাদ লাগানো আছে। এই যা তফাৎ। দরজা-জানালা খোলা। হু হু করে হাওয়া আসছে। সত্যি সত্যিই খুলনার ফুলতলা গ্রামের প্রকৃতি ও পরিবেশটা খুবই সুন্দর। কিন্তু এখন দুটোই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

হামিদ কায়সার: সব জায়গারই তো একই অবস্থা।
হাসান আজিজুল হক: আমি সেটাই বলি। জীবন ক্রমাগত জটিল হোক, আধুনিক হোক। কিন্তু জীবনের, জীবনযাপনের যে-আনন্দটা-সুস্থতা— তা কেন নষ্ট হবে? আমাদের খুব খুব ভুল ধারণা জীবন-সম্বন্ধে। আধুনিকতা মানে গলদ্ঘর্ম হওয়া নয়। নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে ইউরোপের সব থেকে বড় শহরগুলো, খুব ফাস্ট কিন্তু এত নিঃশব্দ এবং এত সিনক্রোনাইজড মানুষের হাঁটা। দ্রুত হাঁটছে যে মানুষ, দৌড়াচ্ছে যে মানুষ, সাইকেলে চড়ছে যে মানুষ— মনেই হবে না গলদঘর্ম হচ্ছে। বিকেলটা হয়ে গেল নিস্তব্ধ। দোকানপাট নিস্তব্ধ। বাড়িতে যখন এলো— অসীম নির্জনতা। আর তারাতো সিটি সেন্টার ফেলে দূরে বাস করে। নিউ ইয়র্কে যদি তুমি সাবাব দেখো কিংবা ম্যানহাটনের বাইরে গিয়ে দেখো তাহলেও দেখবে নির্জনতা কীরকম। আর আধুনিকতা সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণাটা হলো গলদঘর্ম হয়ে থাকতে হবে। আর এই ফ্ল্যাট! যখন থেকে এই ফ্ল্যাট চালু হয়েছে তখন থেকেই জায়গাগুলো নষ্ট হয়েছে। ফ্ল্যাট মানে কী? এতটুকু জায়গার মধ্যে প্রচুর লোক থাকতে দিতে হবে এবং কেউ কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে না। এই ফ্ল্যাট-লাইফ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারো ইচ্ছেমতন নয়। সব জায়গাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন এই হাসপাতাল, হাসপাতালের পাশেই দেখা যাচ্ছে বাচ্চাদের স্কুল। একদিকে রোগী বা লাশ নিয়ে আসছে আর একদিকে বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। ধানমন্ডি তো শেষ! পিলপিল করে যত দশতলা বিশতলা উঠছে, তত মানুষের মনুষ্যত্ব ক্ষয় হচ্ছে। আগে ঢাকাতে গাছ নেই বাসা দেখিনি। পেয়ারা গাছ, আম গাছ, আতা গাছ— গাছ ছাড়া মানুষ বাঁচে কীভাবে? এখন কী হচ্ছে! হাইরাইজ বিল্ডিং করে পুরো গাছটা ভিতরে ঢোকানো হয়— টবের গাছ, ক্যাকটাস, বনসাই। ভয়াবহ রকমের প্রকৃতিবিরুদ্ধ, স্বাভাবিকতাবিরুদ্ধ কৃত্রিম একটা ব্যাপার তৈরি হয়েছে।

হামিদ কায়সার: সেজন্যেই কি ঢাকা আপনাকে কখনো টানেনি?
হাসান আজিজুল হক: নেভার। তবে ঢাকায় থাকলে কী হতো আমি জানি না। একেক সময়ে মনে হয় অসাধারণ কিছু যদি হতো তাহলে হয়তো তার স্বাদ নেওয়ার জন্যে আমি ঢাকায় থাকতাম। ঢাকায় থাকলে আমি হয়তো আর্লি সিক্সটিজ থেকে গ্রোথ অফ ঢাকা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতাম। আমি সমস্ত সেটেলমেন্ট অফিস ঘেঁটে দেখতাম। দেখতাম ডিআইটি, দেখতাম কত মানুষ, কারা ছিল, কাদেরকে উৎখাত করা হয়েছে। এগুলো কিছুই আমাদের কেউ দেখল না। কীসের কষ্টে কী পাওয়া গেছে। আমার কাছে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কেমন করে এক-একটা এলাকার বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন শহর তৈরির জন্যে, তাদেরকেই কীভাবে রাজমিস্ত্রি হিসেবে, লেবার হিসেবে, ডেকে আনা হয়েছে। অ্যালিয়েনেশন কাকে বলে? অ্যালিয়েনেশন কী? মার্কস কী বলেছিলেন? কী নিয়ে যে আমরা লিখলাম জানি না। এখনো ম্যাজিক হেনতেন নিয়ে আছি— ইউরোপে কেউ মাথা ঘামায়? যাদের নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই যে এরা ম্যাজিক রিয়ালিজমের লেখক, তারা কি নিজেরা এসব নিয়ে মাথা ঘামায়? এই যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাচ্ছে একেকজন— এদের লেখাগুলো তো পড়েছি— এবার যে-অস্ট্রিয়ান মহিলা পুরস্কার পেল একটু হলেও তো পড়ে দেখেছি, অস্ট্রিয়া ছাড়া নিজের দেশ ছাড়া কিছুই নেই। তারা কীসের দিকে তাকায়? তারা নিজের দেশের দিকে তাকায়। আমরাই হতভাগা একেবারে। কিছু নেই। সেজন্যে কেবল নিয়ে এসে পেট ভরে খাই। হজমও করতে পারি না।

হামিদ কায়সার: স্যার, আমরা আত্মজা ও একটি করবী গাছে ছিলাম। আপনাদের ফুলতলার বাড়ির কথা হচ্ছিল।
হাসান আজিজুল হক: হ্যাঁ। চারপাশ খোলা। ‘সারা দুপুর’ গল্পে যেমন আছে আর কী! হরতকি গাছ একপাশে। শিরীষ গাছ একপাশে। ঝমঝম করে আওয়াজ হচ্ছে। মনে হতো যেন সবই আমার লেখার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে গেলেই দারিদ্র্য, দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনা, লোকজনের বদমায়েশি, সাম্প্রদায়িকতা— কী নেই? মানবিক জগৎটা অসম্ভব বিচ্ছিরি। প্রকৃতিজগৎটা খুব সুন্দর। কিন্তু প্রকৃতিজগৎটা অচেতন আর এই মানবিক জগৎটা চেতন। সেজন্যে ওই বিচ্ছিরির মধ্যেও ওইটার মূল আকর্ষণের জায়গা। মানবিক জগৎটাকে মূল আকর্ষণের জায়গা। ভীষণ মিক্সড।

হামিদ কায়সার: গল্পটা পড়লেই বোঝা যায়।
হাসান আজিজুল হক: কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখলাম যে হচ্ছে না। এক পৃষ্ঠা দুই পৃষ্ঠা লেখার পর মনে হলো, না হচ্ছে না। তো একদিন আমাদের ওই মফস্বলের ফুলতলাতেই সাধারণ একটা রেস্তোরাঁয় বসেছি। গল্প শুরু হয়েছে আমাদের, তখনই চারটি যুবক এসে বসল। এরাই সেই তিন চারটি।

হামিদ কায়সার: ইনাম, সুহাস এরা ?
হাসান আজিজুল হক: এরা। বসে চা চাইল। এটা-সেটা গল্প করতে     লাগল। ঘরে ফিরে আমি লিখতে বসে গেলাম। আর লিখতে গিয়ে দেখলাম যে, কেমন একটা সমরেশ বসু-মার্কা হয়ে যাচ্ছে। তিন-চারটা প্যারা লিখে ছেড়ে দিলাম। আমি সাধারণত খসড়ার কাজটা করিই না। যা লিখি একদম সরাসরি লিখি। ফলে কখনো লিখতে যদি অসুবিধা হয় একটা-দুটো বা তিনটা বিগিনিং— যেটা শুরু সেটা বাদ পড়ে। আবার নতুন করে লিখি। যখন পছন্দ হয়ে যায় টানা লিখি। সাধারণত খসড়া লেখা, ইমপ্রুভড লেখা এসব হয় না। মানে আমার কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই (হাঃ হাঃ)। কতদূর লিখে রেখে দিলাম। আমার যতদূর মনে পড়ে, আমি আরেকটা লেখা লিখতে চেয়েছিলাম। এই একই ঘটনা আবার হয়েছিল। হলো না। তারপর ভাবলাম ঠিক আছে থাক। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে দেখা যাবে। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া হলো বেশ। খাওয়া-দাওয়া খুব সুন্দর ছিল। ফুলতলাতে তখন সবকিছুই অঢেল। বাজারে গিয়ে মানুষ মাছ দেখত, কিনত আর কী যে তৃপ্তির সঙ্গে বলত কত শস্তা! যাই হোক, বিকেলবেলা মনে করলাম যে এখানে বসব না ছাদে বসব। একতলা ছাদ প্রায় দোতলা-সমান উঁচু। ছাদে গিয়ে বসেছি। ওই আগে যেমন ছাদগুলো হতো। কোনো কোনো জায়গায় ফাটল হয়েছে। সবুজ সবুজ একটা কার্পেটের মতো শ্যাওলা পড়েছে। ওই ছাদের উত্তরদিকে একটা বিশাল আমগাছ। আর ওই আমগাছের অর্ধেকটা পড়েছে ছাদের উপরে। তার তলায় চেয়ার নিয়ে বসা যেত। যখন আমার সময় হতো তখন একদম সোনার মতো তৈরি আমগুলি মাথার উপর ঝুলছে। গায়ে এসে লাগছে। খেতে অত ভালো নয়। তখন তো আমের সময় নয়। বিকেলবেলা ছায়াটা পড়েছে। আমার বেতের একটা গোল টেবিল ছিল। গেস্ট আসলে তাতে চাটা দেওয়া হতো। আর কিছু চেয়ার ছিল বেতের। একটা চেয়ার আর টেবিল উপরে নিয়ে গিয়ে লিখতে বসলাম আবার।

হামিদ কায়সার: আকাশের নিচে বসে...
হাসান আজিজুল হক: আকাশের নিচে বসে আমগাছতলার ছায়ায় ছাদে। ছাদের একপাশে চিলেকোঠাটা আর একপাশে আমার টেবিলটা। লিখতে শুরু করলামক, ‘এখন নিদয় শীতকাল। ঠাণ্ডা নামছে হিম।’ আমি জানি না কেন এমন হয়। প্রথম বাক্যটাই বাতিল। নিদয় আর কেউ লিখল না। সবাই নির্দয় লিখল। আমি শত চেষ্টা করলাম। বহুবার কারেকশন করেছি। কিছুতেই আর কিছু হলো না। এখন সবাই জানে ওটা নির্দয় শীতকালই। আসলে আমি লিখেছিলাম নিদয় শীতকাল।

হামিদ কায়সার: লেখাটি কি এক বসাতেই হয়েছিল?
হাসান আজিজুল হক: তুমি তো লেখো। তাই তুমি জানো ফার্স্ট বাক্যটা তোমাকে হয় ক্লিক করে নয়তো হতাশ করে। না। কন্টিনিউ আমি করতে পারি না। এক পৃষ্ঠা-দেড় পৃষ্ঠা করে তিন সিটিংয়েই বোধহয়... সে গল্পটাই আমি পাঠিয়ে দিলাম কালবেলাতে। ছাপা হলো।

হামিদ কায়সার: ছাপা হওয়ার পরপরই কি প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছিল?
হাসান আজিজুল হক: সঙ্গে সঙ্গেই। বেশির ভাগ লেখকরাই। একজন ছিলেন হুমায়ুন চৌধুরী। নশ্বর বলে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। কণ্ঠস্বরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমি তো তখন কণ্ঠস্বরেও লিখতাম। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে আমার অসম্ভব বন্ধুত্ব ছিল।

হামিদ কায়সার: আপনার গল্পলেখার পিছনে বন্ধুদেরও একটা তাগিদ কিংবা প্রেরণা থাকত।
হাসান আজিজুল হক: তখন পরিবেশটাই ছিল অন্যরকম। আমার যতদূর মনে পড়ছে ‘গুণীন’ এবং এরকম আরেকটা গল্প— নামটা ঠিক এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না— দুই বন্ধু জ্যোতিপ্রকাশ এবং হায়াৎ মামুদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম ঢাকায়, এটা আত্মজা লেখার অনেক আগে। জ্যোতি তখন থাকত গোবিন্দ দেবের বাড়িতে। আমি ও-বাড়িতে উঠতাম। অনেক সময়ে থাকতাম। সবসময়ে যে প্রশংসা জুটত তা না, ওই যে নাম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছিল। ‘গুণীন’ ও সে গল্পটি— যার নাম মনে করতে পারছি না— দুটোই সরাসরি আমার প্রথম গল্পের বই সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্যে গিয়েছিল, কোথাও ছাপা হয়নি। শুধু জ্যোতি আর হায়াতের কথা বলছি কেন, দ্বিজেনদাও ছিল আমার প্রতিটি গল্পের তাৎক্ষণিক পাঠক ও সমালোচক।

হামিদ কায়সার: ওঁর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল?
হাসান আজিজুল হক: ছিল না মানে! আমি শুধুমাত্র দ্বিজেনদার সঙ্গে দশ দিন কাটাব বলে দ্বিজেনদার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতাম। আমি গেলে দ্বিজেনদা সব ভুলে যায়। কোথায় মুড়াপাড়ার রাজবাড়ি! অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজের বাস্তব পশ্চাদ্ভূমি। দ্বিজেনদা বলে, যাবে নাকি হাসান? আমি বলি, চলেন। ডেমরা থেকে পুরানো ধরনের লঞ্চ ধরে সোজা মুড়াপাড়ায় চলে গেলাম। পড়ে-যাওয়া বাড়িঘর। বনবিড়াল বেরিয়ে আসছে। শেয়াল বেরিয়ে আসছে। খুব হইহই করে কাটিয়েছি। দেবী বৌদি খুব রাগ করত। একবার চলে গেলাম নাগরী। পুবাইল স্টেশন থেকে অনেকটা ভেতরে। মূলত খ্রিস্টানপল্লি। বাঙালি খ্রিস্টানপল্লি। এরা কিন্তু আমাদের দেশে অন্ত্যশ্রেণিভুক্ত লোক। নিজেরা হাড়ি, বাগদি, ডোম, যাদের গৃহপালিত পশু হচ্ছে শুয়োর। ওদের মাঝখান থেকে দু-একজন কিন্তু নটরডেম কলেজের শিক্ষকও হয়েছে। সে যে কী করেছি দ্বিজেনদার সঙ্গে! তার সঙ্গে অনেক কাটিয়েছি। ভীষণভাবে কাটিয়েছি। দ্বিজেনদাই ছিল আমার প্রতিটি গল্প প্রতিটি লেখার প্রায় প্রথম পাঠক এবং প্রথম লিখিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানাত। অদ্ভুত লাগে সমকালে কোনো কিছুই ঠিকমতো বিচার হয় না। মানে, যেভাবেই হোক না কেন ‘শকুন’ এবং ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ মোটামুটি অনেককাল পড়া হবে বলে মনে হয় আর কী। কিন্তু সেদিন দেখছি আমার তীব্র সমালোচনা করে দ্বিজেনদা লিখেছেন, হাসান, গল্পটা এইজন্য শেষ পর্যন্ত চিরকালীনতার মর্যাদা লাভ করতে বোধহয় পারল না...হাঃ...হাঃ...। আর খুব খুশি হয়েছিলেন আমার ‘খাঁচা’ গল্পটা পড়ে, যেটা প্রথম বেরিয়েছিল ‘আততায়ী আঁধার’ নামে। দেশবিভাগ হওয়ার পর কোনো একটা দাঙ্গায় উৎখাত ওখানকার মুসলিম একটি মানুষ, যেটা ‘পরবাসী’ গল্পে আছে, তার কাউনটারপার্ট এ-গল্প। এখানে একটা পরিবার ঠিক আটকে যাচ্ছে। এদেশে থাকা যায় না। শুধু দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নয়। অপমানটা ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে! পুরো পরিবারের আয়ের উৎসগুলো চলে গেছে। তারা মাস্টারি করবে কিংবা পুরুতগিরি এ-রকমই একটা পেশা ছিল। সেসব পেশা কোথায় চলে গেছে! নখ বাড়লেও মনে হয় এখানে থাক, ওইখানে গিয়ে কাটব। হ্যাঁ, দাড়ি, নখ কাটতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় চলেই তো যাবো এ-দেশ ছেড়ে। ওই গল্পটা পড়ে খুব ভালো একটা চিঠি লিখেছিল। আর চিঠি লিখত ওই লেখারই তলার দিকে। এটা চিরদিনের অভ্যাস দ্বিজেনদার। আছে চিঠিগুলো আমার কাছে। আমি যে এরকম চিঠি কত পেয়েছি! আহমদ নামে একজন ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি নতুন লেখা পেলে সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিতেন। প্রথম আমাকে দেখে তার প্রতিক্রিয়া, আমি ভেবেছিলাম যে আপনার চুল পাকা থাকবে। আরেকটু বয়স্ক ভারিক্কি, এখন দেখি আরো অনেকদিন তরুণ থাকবেন। তখন আমার লেখা পড়ে তার কী করে ধারণা হয়েছিল আমি একজন অসন্তুষ্ট, লম্বা, রাগী, কিছুতেই হাসে না এমন একজন মানুষ। দেখার পর বলল, এতো দেখি আরো বেশি সংসারী লোক। খুব কথা বলে। খুব মজার। আমি তো মজা ছাড়া কথাই বলতে পারি না।

হামিদ কায়সার: ভেবেছিল এত কঠিন জীবনসংগ্রাম, রূঢ় বাস্তবতা যার গল্পে..
হাসান আজিজুল হক: কোনো কোনো লোক বলে যে আমি খুব হতাশাবাদী। কেন বলছে আমি জানি না। মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, মানুষের জীবনের অপচয়টাকে দেখতে পেয়েছি বলে? জীবনের সম্ভাবনাগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে? বা যে সময়টাকে আমি পেরিয়ে এলাম এ-সমস্ত জীবনটায় মানুষের ক্রমাগত ধস নেমেছে বলে? সমাজজীবনে রাষ্ট্রীয় জীবনে এই চিত্রগুলো তুলে ধরেছি বলে? আমি নাকি হাসতে জানি না। অনেকে বলে আপনার জগতে কি কোকিল ডাকে না? ভিতরে ভিতরে আমার খুব হাসি পায়। এরা কেন যে আমাকে মিস-আন্ডারস্ট্যান্ড করছে!

হামিদ কায়সার: জীবন নিয়ে আপনার ভাবনাটা ঠিক কীরকম?
হাসান আজিজুল হক: একটু অন্যরকম। আমি জীবনের পজিটিভ দিকটা নিয়ে একটু চিন্তা করি। আজকাল এরকম মনোভাব অনেকের মাঝেই এসেছে সাধারণভাবে জীবনটা তিক্ত, বাসযোগ্য নয় এবং প্রায় মিনিংলেস। এগুলো তো আজকাল দর্শনে চলে এসেছে। কিন্তু আমার কাছে জীবনটা খুব এনজয়েবল মনে হয়। আমার নিজের জন্য বলছি না। যে-কোনো মানুষের জন্য এবং এই এনজয়েবল যে-জীবনটা, সেটা সবসময়েই যে বাঁচার নিত্যনতুন উপকরণপ্রাপ্তির উপর নির্ভর করে, তা নয়। মানুষের গভীরতম সুখ-দুঃখ-অনুভবের সঙ্গে দারিদ্র্য বা এর কোনো বিরোধ নেই। আমার কাছে মনে হয়, যে-মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ খাবার খাচ্ছে— খাক। তার যে-আনন্দটা সে-আনন্দটাকে আমি আলাদা একটা জায়গায় রেখে দিচ্ছি। আর বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে-কোনো একটা উপন্যাসে যার পুঁইশাকের সঙ্গে কচু দিয়ে যে-রান্নাটা তাও জোটে না, কিন্তু খুব খেতে ইচ্ছে করে, বাড়িতে এসে দুপুরবেলা খবর পেয়েছে যে, আজকে এটা রান্না হয়েছে, সেইটা খাচ্ছে। সেইটাতে তার যে-আনন্দ আর আমার ওই রেখে-দেওয়া আনন্দ— আমি এই দুটিতে যদি তুলনা করি, কী তীব্রতায় কী ঘনত্বের এই দ্বিতীয় আনন্দটাই বেশি উল্লেখযোগ্য। এখানে দারিদ্র্য অ্যাফেক্ট করেনি। সেজন্যে আমার মনে হয় যে জীবনের সঙ্গে শ্রমের সম্পর্ক আছে, উৎপাদনের সম্পর্ক আছে এবং বহুজনের অংশগ্রহণ আছে এবং বহুজন যে জীবনের সঙ্গে যুক্ত, সেই জীবন বেশি অর্থময়। আর কেমন করে জানি না, ইউরোপ আমাদের শিখিয়েছে, তাদের যে সভ্যতার, জীবনের পরিবর্তনশীলতা তো বটেই, মানুষকে ক্রমেই ঠেলতে ঠেলতে একেকটা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং তার সমস্ত উপভোগগুলোই, প্রাচুর্যের দ্বারাই এগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। জীবনে যে গাড়িতে চড়েনি, সে প্রথম গাড়িতে চড়েনি, সে প্রথম গাড়িতে চড়বে, মনে হবে যে জীবনে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী আছে! কিন্তু তোমার যদি অফিসে যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি থাকে, ক্লাবে যাওয়ার জন্য আরেকটা গাড়ি থাকে— তাহলে ওই গাড়িতে চড়ে মনে কোনোরকমের সাড়া লাগবে না।

হামিদ কায়সার: এ তো সাধারণের কথা হলো, কিন্তু লেখকের মানসজগতে তো এফেক্ট হয়?
হাসান আজিজুল হক: হ্যাঁ, কী করে যেন মানুষের জ্ঞানের সঙ্গে আর উপভোগের সমস্ত উপকরণগুলো পাওয়ার সঙ্গে আর মানুষের বোধের সঙ্গে, বেসিকালি একটা যোগ দর্শনে দেখতে পাই। তোমাদের কী ধারণা জানি না, ইউরোপের সমস্ত দর্শন যত অগ্রসর হয়েছে তত প্যাসিভের দিকে গেছে। পরবর্তীকালে যারা সাহিত্যে খুব নাম করেছেন তারা ওই প্যাসিভ সাহিত্যিক। এদের মধ্যে বোদলেয়ার আছে। এরা নতুন যুগের সাহিত্যিক। এদের মধ্যে এডগার অ্যালান পো আছে, কামু আছে, কাফকা আছে। এবং এরই পাশাপাশি যে-দর্শন যেভাবে ডেভেলপড হয়েছে ইন দ্য ওয়ার জার্মানি এবং ফ্রান্সে, এগুলোর সবগুলোতেই সাযুজ্য আছে। আমি এগুলো সবই যুক্ত করি আর ওদের জীবনযাপনের ধন-সম্পদ-অর্জনের পদ্ধতিটা উপনিবেশ— আমলে এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল— ফলে, ওদের মধ্যে চূড়ান্ত রকমের একটা বিতৃষ্ণা স্বাভাবিকভাবেই এসেছিল জীবনের প্রতি, তারই প্রভাবে, জার্মানিতে কী রকম আধ্যাত্মিক একটা দর্শন তৈরি হয়েছে, ক্লার্ক বলো, হেগেল বলো। সেখান থেকে শোপিনারের মতো একজন হতাশাবাদী বের হয়। আফ্রিকার জীবন-যাপন যেমন, ওরা একা কিছুই করত না। এখন তাদের লেখাগুলো পড়ে দেখো, এখন চিনুয়া আচিবি পড়ে দেখো— তাহলে বুঝতে পারবে তাদের রাগটা কোথায়? চিনুয়া আচিবি, উয়িংগু এদের লেখা পড়ে দেখো। তাদের রাগটাই হচ্ছে যে, ব্যক্তিকে আলাদা ব্যক্তিতে পরিণত করা, তাদের যৌথ লাইফ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা— কেন? গ্রামের তরফ থেকে মামলা-মোকদ্দমা করার জন্য একটা ছেলেকে চাঁদা দিয়ে, ‘আমাদের সকলের ছেলে গো যাও ইংল্যান্ডে যাও, ব্যারিস্টার হয়ে এসো’— চিনুয়া আচিবির গল্প— ব্যারিস্টার হয়ে আসার পর সে আর গ্রামে থাকতে পারে না। তার তো আর গ্রামে প্র্যাকটিস করার কোনো উপায় নেই। তাকে তো শহরে প্র্যাকটিস করতে হবে, তাকে তো ইংরেজি বলতে হবে। একসময়ে গ্রামের মানুষ বলল, কী সর্বনাশ করলাম! এদের যেই উন্নতি হলো সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এইসব জিনিস আমার মাথার মধ্যে খুব ঘুরপাক খায় আজকাল— ছোটবেলার কথা যদি ভাবি— আমি নিজেও তো ওভাবে তৈরি হয়েছি আর কী! ওই ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা মনে করো যদি, মানুষের সমাজটাকে যদি মনে করো, কৃষিসমাজটাকে যদি মনে করো, চল্লিশ-দশকের কথা যদি মনে করো তাহলে আমার সাহিত্যের, আমার সমস্ত মনোভাবের ব্যাখ্যাটুকু কিন্তু ওখান থেকে মিলবে।

হামিদ কায়সার: স্যার, খুলনার ফুলতলাতে আপনি ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ লিখেছিলেন। এ-জায়গাটা নিশ্চয়ই আপনাকে খুব প্রভাবিত করেছিল!
হাসান আজিজুল হক: ভীষণ। আত্মজা ও একটি করবী গাছের বাকি     গল্পগুলোও খুলনায় বসেই লেখা হয়। তারপর ‘খাঁচা’, ‘সারা দুপুর’, ‘সেই ছেলেটা’র কথা ধরো—

হামিদ কায়সার: সত্যজিতের পিকুর সঙ্গে যার অনেক মিল—
হাসান আজিজুল হক: হ্যাঁ, তার সঙ্গে খুব মেলে। এবং এ-নিয়ে বহুৎ কেলেঙ্কারি হয়েছে। আমি সে-কেলেঙ্কারির মধ্যে নিজেকে জড়াইনি। ওখানে অনেকেই চেয়েছিল, আমি এটা নিয়ে হইচই করি, কিন্তু এসব করার কোনো কারণ দেখতে পাইনি। ওটা কিন্তু পিকুর অনেক আগে লেখা হয়েছে। ‘সারা দুপুর’ও সেই ছাদে বসে লেখা। আমার যতদূর মনে পড়ে যে-সময় থেকে গল্পটা শুরু হচ্ছে, লেখার সময়টাও সেটা। বেলা দশটা-এগারোটা হবে। হেমন্তকাল। ওটা লিখতে তেমন কষ্ট হয়নি। চারপাশে তাকাই আর লিখি। তারপর ‘মন তার শঙ্খিনী’র সেই মেয়েটাকে পেয়ে গেলাম।

হামিদ কায়সার: কীভাবে পেলেন?
হাসান আজিজুল হক: কীভাবে যে পেলাম তা বলতে পারব না। গ্রামেও তো অবাঞ্ছিত নিষিদ্ধ জীবনের একটা প্রবাহ আছেই। নানারকম ক্লেদ আছে, অসুস্থতা আছে। আমার সে-রকমই মনে হয়। কোনো একটা ক্লেদকে নিয়েই লিখতে ইচ্ছে করছিল। এ-রকম গল্প আরো লেখা হয়েছে। নাগরিক নামের একটা কাগজে, সম্ভবত রবীন্দ্র-গবেষক আহমদ রফিকের পত্রিকা, ওটায় বেরিয়েছিল ‘আবর্তের সম্মুখে’— সেও কিন্তু গ্রামীণ মানুষের ভিতরে নানারকম যে-ক্লেদ— এসব নিয়েই লেখা। ‘সারা দুপুরে’ও মনে হয় এ-রকমভাবেই বালকটি এসে গেছে। বৃদ্ধ-চরিত্রটিতে অল্প করে হলেও আমার বাবার ছায়া আছে। যে-বাড়িটার কথা বলা হয়েছে সেটা হয়তো আমার ওই বাড়িটা। ফুলতলার পুরানো বাড়িটা। অনেকগুলো গল্পেই কোনো না কোনোভাবে তা ছায়া ফেলেছে। ‘উত্তরবসন্তে’ গল্পটা তো পুরোপুরি ওই বাড়িটার বর্ণনা করেই লেখা। ঝড়ো হাওয়া, অনেক দূরে বাস চলে যাওয়ার পথ— এটা ঠিক, পরিবেশটা আমাকে ভীষণ প্রভাবিত করেছিল। তাছাড়া আমি তো না দেখে, না শুনে কিছুই লিখতে পারি না। কিছু অনুভব করতে পারি না। আমার কল্পনাশক্তি বলে কিছু নেই। যা দেখি তাই লিখি। আমার কোনো বাছবিচার নেই। পড়ার ব্যাপারেও কোনো বাছবিচার নেই। আগ্রহের কতকগুলো ক্ষেত্র আছে। যেমন ধরো নতুন উপন্যাস, যা লেখা হচ্ছে গোটা পৃথিবীতে— যতটুকু পারি পড়ার চেষ্টা করি।

হামিদ কায়সার: তখন কী পড়া হচ্ছিল— ওই ফুলতলাতে?
হাসান আজিজুল হক: ফ্যান্টাসি পড়ছি। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো     পড়ছি। দুবার-তিনবার করে গোরা পড়ছি। সেইসঙ্গে মনে হয় বাইরের উপন্যাস-দর্শন-টর্শনও পড়ছি। ওই সময়ে বিখ্যাত একজন লেখক ছিলেন, তার নাম ছিল অনাসূন। লেপার্ড বলে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। এটা ছিল ইটালিয়ান লিবারেশন নিয়ে। এই উপন্যাসটা তখন পড়ছি। এই উপন্যাসটা আমি পেয়েছিলাম দ্বিজেনদার কাছ থেকে। অনেক বইই নিয়েছি, কোনো কোনো বই এখনো আমার কাছে আছে। দ্বিজেনদা একবার এসে বলেছেন, এই যে এই যে এখানে আমার বই, এখানে ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে... আমি বললাম, মারা যাচ্ছে না তো মৃত। এগুলোর দিকে এখন তাকাবেন না। দ্বিজেনদা বললেন, ঠিক আছে, তুমি এগুলো রাখো, আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু মোনা বইটা আমার খুব প্রিয়। এটা আমাকে ফিরিয়ে দাও, ভাই।

হামিদ কায়সার: এই যে বইয়ের প্রতি আপনার আকুতি, ভীষণ প্রেম, এটা শুরু হয়েছিল কখন... আপনার লেখালেখিতে বই পড়াটা কি প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে?
হাসান আজিজুল হক: বর্ধমানে আমাদের বাড়িতে লেখাপড়াটা মোটামুটি বরাবরই ছিল। এবং প্রচুর বইপত্র আসত। আমি তো ওইসব বই ছোটবেলাতেই পড়েছি। যেমন ধরো ভারতবর্ষ-র মোটা মোটা সেট, প্রবাসীর বড় বড় কালেকশনগুলো। ফলে আমি অনেক পুরানো লেখকের লেখা, যার অনেকই পরবর্তী সময়ে হারিয়ে গেছে, এমন প্রচুর লেখা আমি পড়েছি। যেমন মনীন্দ্রলাল। ওর কিছু চমৎকার উপন্যাস আছে যা দিয়ে পরে ছবিটবিও হয়েছে— এসব, কল্লোল-যুগের লেখক, এদের লেখা আমি পড়েছি। তারপর তারাশঙ্কর পড়েছি, বোধহয় যখন আমি নাইন-টেনে পড়ি। সেভেন-এইট-নাইনের সময়েই পড়া হয়ে যায় শরৎচন্দ্র-রচনাবলি। আমার মনে পড়ে, আমার  বোনকে আমার বাবা খুব অল্প বয়সেই মেঘনাদবধ কাব্য পড়তে দিয়েছিলেন। আমি তখন ক্লাস-সেভেন-এইটে পড়ি। কাজেই ওই সময়েই ওই কঠিন মেঘনাদবধের যে-সংস্কৃত, তৎসম শব্দপ্রধান এবং অপ্রচলিত শব্দ— এগুলোর খুব ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছি। মেঘনাদবধ আমাকে খুব কষ্ট করে পড়তে হয়েছে এবং আমি তা ঠিকই পড়ে ফেলেছিলাম। তখনই আমি কবিতার মতো এটা-সেটা লিখতাম। কবিতা দিয়েই তো সবাই শুরু করে। আমার যদ্দুর মনে হয়, আমার লেখালেখির ইচ্ছেটা খুব পুরানো। ওই নয়—দশ বছর বয়সেই লেখার জন্যে নিজের একটা আলাদা খাতা তৈরি করে ফেলি। আর প্রিয় দুটো জিনিস একসঙ্গে গড়ে উঠল। একটা হচ্ছে বাইরের জগতের কাছে নিজেকে একদম সম্পূর্ণ মেলে দেওয়া। মানুষের জগৎ এবং প্রকৃতির জগৎ তো বটেই সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ জায়গাটাকে নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে সময় কাটানো। দুটোই আমার কাছে সমান ভালো লাগে। এখনো কেউ যদি না থাকে দিনের পর দিন আমি খুব চমৎকারভাবে কাটাতে পারব। নিজেকে নিয়ে, বই পড়ে থাকতে পারব। আবার তুমি যদি বলো, দিনের পর দিন আপনি লেখালেখির মধ্যে যাবেনই না, শুধু হইহই করে ঘুরে বেড়ান, কেবলমাত্র মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ান, যে-কোনো রকমের মানুষের সঙ্গে, সে হতে পারে কৃষক, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে আমার জমে ভালো। আমার খুব ইচ্ছে করে যে, কামার কাজ করছে ওখানে অনেকক্ষণ বসে থাকি।

হামিদ কায়সার: বর্ধমানই আপনার এই মানস-জগৎটা তৈরি করে দিয়েছিল?
হাসান আজিজুল হক: আমার সেই শৈশব। করাত দিয়ে কাঠ কাটছে, দুপুররৌদ্রে বসে আছি। রুক্ষ-খটখটে দুপুরবেলায়। গাছপালা খুব কম। যা আছে খুব বড় বড়। ছায়াওয়ালা গাছ। বাকি সবই ঝোপঝাড়। ছায়াটা যেন রোদেরই আরেকটা সংস্করণ বলে মনে হতো। সেখান থেকে পিপাসার্ত সাপ যাচ্ছে। ঘুঘু ডাকছে। একটা অদ্ভুত পরিবেশে সমস্ত দুপুরটা ঘোরের মতো— আমি এগুলো খুবই এনজয় করতাম। বর্ষাকালে দুমকা জেলার দিক থেকে আসত সাঁওতালরা। বিভিন্ন বাড়িতে, গোয়ালঘরে অথবা বৈঠকখানায় তারা একমাস-দুমাস করে থাকার জন্যে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে আসত। ওইখানে গিয়ে বসে থাকা, সন্ধেবেলায় তাদের গান শোনা। তারপর পাখমারা বলে একটা জাতি আসত। তাদের কাজ হচ্ছে পাখি মারা। সাতটা নল দিয়ে কী যে অদ্ভুতভাবে পাখি মারত। পাখি দেখা যাচ্ছে কত উপরে। নিশ্চিন্ত মনে বেচারা ডাকছে। আর ও লম্বা একটা শর, তার উপরে আর একটা শর গেঁথে দিল। তার তলায় আর একটা দিল— এভাবে একদম  মুহূর্তের মধ্যে পুরো শরগুলোর একটা বল্লম তৈরি হয়ে পাখিটার একদম পেটের কাছে চলে গেল এবং তারপর গেঁথে নিয়ে নামিয়ে নিয়ে এলো। তারপর আসত বাজিকর। এরা কিন্তু জাদুকর নয়। এদেরকে বাজিকরই বলা হতো। এরা একটু অন্যরকমের। যেমন এরা মানুষকে উড়িয়ে দিত, কিংবা নিজেরা মাটি গর্ত করে কবরে থাকত। আধ ঘণ্টা এক ঘণ্টা  করে কবরে থাকত। কিংবা অন্যদেরকে দিয়ে এরা নিজেদেরকে বড় রশিতে বেঁধে রাখত তারপর মাথার চুল ঘষে রাক্ষসে পরিণত হতো। তাদেরকে একটা বড় হাঁস কিংবা একটা মুরগি দিলে ছিঁড়ে পালক-টালক শুদ্ধ খেয়ে ফেলতে পারত। এই যে বিচিত্র কর্মের জগৎ আর চাষবাসের জগৎ, আমি খুব ভালোভাবে দেখেছি। চারপাশ খুব ভালোভাবে দেখেছি। আবার এসব বাদ দিয়ে হঠাৎ করেই দেখা যেত দরজা-টরজা বন্ধ করে দিয়ে মাটির মূর্তি গড়ছি কিংবা মাটি গোল করে গুলতি মারবার জন্যে মার্বেল তৈরি করছি, সেটাকে পোড়াচ্ছি। আবার ছোট্ট একটা খাতা কুড়িয়ে কবিতা লিখছি। এটা খুব একটা নির্জন জগৎ, খুব নির্জন জগৎ। এটা আমার জগৎ।

হামিদ কায়সার: আপনার শৈশবের ভা-ারটা সত্যিই খুব সমৃদ্ধ। ফ্যামিলির ভূমিকাটা কেমন ছিল?
হাসান আজিজুল হক: বড় ফ্যামিলি ছিল আমাদের। খুব বড় ফ্যামিলি। বাবার সাথে তেমন দেখাসাক্ষাৎ হতো না। মাকে তো পাত্তাই দিতাম না। এক ফুফু ছিলেন। তিনিই খেতেটেতে দিতেন। যা কিছু  বলতেন। মায়ের কোনো সন্ধান ছিল না।

হামিদ কায়সার: সুখের স্মৃতিই তো বেশি।
হাসান আজিজুল হক: খুব খারাপ সময়ও দেখেছি। আমার ওই বয়সটার সঙ্গে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা— সবকিছুই জড়িয়ে। কাজেই নিদারুণ কঠিন সময়টা আমি দেখেছি। ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া হচ্ছে— ছমাস স্থায়ী। সেই অঘ্রানে হয়েছে, ফাল্গুনেও যাচ্ছে না। কিংবা হঠাৎ করে ফাল্গুনেও আসছে কলেরা। গ্রাম উজাড় করে দিচ্ছে ছোট বসন্ত। ওষুধ নেই, ডাক্তার নেই। এগুলো নিয়ে আমি বহু লিখেছি। হোমিওপ্যাথি, অ্যালাপ্যাথি, বাচ্চাদের নিয়েও আমি লিখেছি। সে-এক অদ্ভুত জগতের ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠেছি, সে-জগৎটা আমাকে গঠন করেছে বলতে পারো। খেলাধুলাও করতাম ওইভাবেই। কড়ি খেলা খুব চালু ছিল আমাদের মধ্যে, কড়ি মহাসম্পদ বলে গণ্য হতো। আর ভীষণ ভায়োলেন্ট খেলা, সেগুলোও আমি খেলতাম। ফুটবলে দুর্ধর্ষ প্লেয়ার বলে নাম ছিল। হাডুডু-লাঠি-দাঁড়িয়াবান্ধা— মুক্তির কোনো অন্ত ছিল না। তারপর আমার বাবা, যেমন রুচিমান সংস্কৃতিমান, যেমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তেমনি অসম্ভব রকমের বদমেজাজিও ছিলেন। এতটুকু যদি কোনো অপরাধ করে ফেলতাম কোনোরকম নিস্তার ছিল না। আমাদের বাড়িতে গ্রামের তুলনায় অনেক শহুরে জিনিস থাকত। যেমন চেয়ার-টেবিল। কোনো বাড়িতে ছিল না। আমাদের বাড়িতে ছিল। কাগজ চাপা দেওয়ার মতো শৌখিন জিনিসও ছিল কিংবা যাত্রার ফ্লুট বাঁশি, বেশ দামি। বাবার ওটা শখের জিনিস ছিল। বড়লোকের মতো নিজস্ব পালকি ছিল, সে-পালকি পরবর্তীকালে পড়েই আছে। ও আর ধরছে না কেউ। বৃষ্টিতে ভিজছে রোদে পুড়ছে। বাবার একটার পর একটা ঘোড়া ছিল। সব মিলিয়ে আমার কেন যেন মনে হয় যে, জীবনযাপনটা আমার মধ্যে খুব প্রবলভাবে এসেছে। তাছাড়া নাইন-টেনে পড়ার সময়ে— যে-আমাদের গ্রামের ৯০ ভাগের বেশি হচ্ছে হিন্দু, বর্ণ হিন্দু এবং সাধারণ হিন্দু, মুসলমান হচ্ছে ১০ ভাগ, মাইনরিটির মাইনরিটি, আমাদের গ্রামে মানুষ হিসেবে ১০০ জন মুসলমান— তার মধ্যে স্কুলে যেতাম আমি আর আমার চাচাতো ভাই। হিন্দু সমাজের ভিতরে কতটা সাম্প্রদায়িকতা, উপরটার কথা ছেড়ে দাও, তাদের ভিতরটা দেখলেই তো বুঝতে পারবে। এইরকম একটা অবস্থা থেকে আমাকে বড় হতে হয়েছে। কত ধাক্কা চারদিক থেকে এসেছে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা আমার মনে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় পায়নি।

হামিদ কায়সার: আর এর মধ্যেই আপনার লেখকসত্তা গড়ে উঠছে?
হাসান আজিজুল হক: হ্যাঁ। এসবের ভিতর দিয়েই আমি তৈরি হচ্ছি। বাবা বহুদিন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তার একটা আদালত ছিল। আমার একটা অবসর সময় কাটত ওই আদালতের মামলাগুলো পড়ে। কত ধরনের মামলা! আজকের সঙ্গে তার কোনো তুলনা হয় না। সে-অপরাধ— কেউ কাউকে একটা খামচি কেটেছে। অপরাধ— আসামি এইরূপ হীনস্থ প্রকৃতির লোক যে আমারে ধরিয়া পিঁপড়ের গর্তের মধ্যে ঠেসাইয়া ধরিয়াছিল। কিংবা জোর করিয়া আমার তিনটি বাঁশ কাটিয়া নিয়া চলিয়া গেল। আমাদের তিন চারটি কেরানি ছিল। ওরাই সেইসব কাগজ সাপ্লাই দিত। আমার একটা অবসর সময় কাটত সেই মামলাগুলো পড়ে। সেই নথিপত্রের উলটো দিকটা পুরোটাই সাদা। ওইগুলোতে ছিল আমার অঙ্ক-কষা, ট্রান্সলেশন করার দায়িত্ব। আমার বাবা আমাকে সহজে কাগজ কিনে দিতেন না। ওই উলটো পিঠে এটা-সেটা লিখতাম। আর বাবার এ-আদালত থাকাতে একটু আধুনিক সরঞ্জাম, যেমন চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি ছিল। সেজন্যে লেখাপড়ার পরিবেশও ছিল। প্রচুর বইপত্র কিনতেন, সেজন্যে আমি পড়তে পেরেছি। জানি না তোমাদের হয়েছে কিনা, পরে স্কুলজীবনে, আমি যখন বুঝতে শিখলাম বহুদিকে আগ্রহ গেল। এমনকী টেক্সট বুক, যেগুলো বড়দের, সেগুলোর দিকেও আমার ঝোঁক, রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’ ছিল বড় ভাইয়ের, তারপর ‘প্রেমের ঠাকুর’ একটা গল্প ছিল, শরৎচন্দ্রের মেজদিদি ছিল। আমি কি একশবার পড়েছি! বলতে পারব না, দুপুরে কিছু করার নেই, ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে আর-একবার মেজদিদি পড়লাম। আর-একবার ‘কাবুলিওয়ালা’ পড়লাম। আরেকটা বিষয় ছিল দুই গ্রাম দূরে অমুক লোকের কাছে একটা বই আছে, বইটা নিয়ে এসে পড়া, আবার তাকে ফেরত দেওয়া। এজন্যে অদ্ভুত সব বই পড়েছি। কোথায় পলাতকা, টোরিস্ট-আন্দোলনের বই। ওই সময়েই কবিতা কিছু লিখেছি। প্রশস্তি লিখেছি। কখনো বিয়েতেও লিখতে হয়েছে। তাছাড়া জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কখনো লিখতে ইচ্ছে হয়নি বা লিখব না এমনটা মনে করতে পারি না। সেজন্যে কী করে লেখক হলাম বলাটা মুশকিল। একেবারেই যখন খুব ছোট, পাঠশালায় যখন যাই, পাঁচ কী ছয় বছর বয়স, তখন কিছু লিখি না। কিন্তু পাঠ্য যে-লেখাগুলো, সেগুলো আমাকে যে কীভাবে আকর্ষণ করত! ওইরকম লেখা— আমি একজায়গায় লিখেছিও যে, বাঁশবনে চাঁদ উঠেছে, দেখ, শিয়াল ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা হাঁস তুলে নিয়ে চলে গেল। এই যে চিত্রগল্পটা— এটা কোন সময়কার পাঠ্য বুঝতেই পারছ। অথচ কী ডিসটিংকট মনে হয়েছে এবং কেমন করে এনজয় করেছি। তার মানে যে-লেখা পিকটোরিয়াল, যে-লেখা ছবি সামনে তুলে ধরে, সেই লেখা কত আগে থেকে আমাকে আকর্ষণ করে আমি বলতে পারব না। বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপুর পাঠশালা— পথের পাঁচালী থেকে ওই অংশটা নিয়ে, যে-অংশটা তোমরা সবাই পড়েছ, তখনই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।

হামিদ কায়সার: লেখার সূত্রপাতটা...
হাসান আজিজুল হক: এইটে এসে। তখন খুব ডিটেকটিভ গল্পটল্প পড়তে শুরু করলাম। পড়ে পড়ে আমারও খুব লিখতে ইচ্ছে হলো। তখন একটা কিশোর-উপন্যাস লিখলাম। সেটা বোধহয় শেষ হলো না। আর একটা লিখলাম যৌথভাবে আমি আর আমার এক সিনিয়র বন্ধু। যতরকম উদ্ভট কাহিনী। ধারণা কিছু নেই। জঙ্গল কেমন হয় তাও জানি না। আন্দাজে সব লিখতে হলো। আর একটা লিখেছিলাম বহু শিকার-কাহিনী পড়ার পর— ‘কি হলো না’। সেটা সম্পূর্ণ আমার নিজের লেখা। আমার বন্ধু ছিল পৃষ্ঠপোষক। সে আমার কাছে খুব গল্প শুনতে চাইত। আর আমি মাথা থেকে শুধু গল্প বলেই যেতাম। দিনের পর দিন গল্প বলে যেতাম। ও বলল, এগুলো লেখো। তা লিখলাম। গল্পের সেই খাতাদুটো এখনো নাকি ওর কাছে আছে।

হামিদ কায়সার: সেই বর্ধমানে?
হাসান আজিজুল হক: হ্যাঁ। কী যে লিখেছি, সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। আমি বলি, একবার দেখাস তো। হাতের লেখা কেমন ছিল, কেমন করে লিখতাম, কী লিখেছি, ভুল লিখেছি কিনা। তারপর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তো দৌলতপুরেই চলে এলাম।

হামিদ কায়সার: এই যে শৈশবের বন্ধন ছিন্ন করে চলে এলেন বর্ধমান থেকে খুলনার দৌলতপুরে, এর প্রভাব কি পড়েছিল আপনার জীবনে?
হাসান আজিজুল হক: বর্ধমান থেকে কি এসেছি? এলাম কখন? নিশ্চয় শৈশবকালে! পুরো মানুষটাই তৈরি হয়ে যাওয়ার পর ওখান থেকে এসেছি। পুরো মানুষটা তৈরি হতে ১৬ বছরের বেশি সময় লাগে না। ১৬ বছরেই মানুষ তৈরি হয়ে যায়। তারপর যেটা হয় আস্তে আস্তে আরো সংগ্রহ করা, বড় হওয়া। ফর্মেটিভ থেকে যেটা, মনোভাব মনোভঙ্গি— কী পছন্দ করবে কী করবে না, কোন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকাবে, হিউম্যানিস্ট হবে নাকি মনুষ্যবিদ্বেষী হবে— এ-সমস্ত ঠিক হয়ে যায় প্রথম ২০ বছরেই। তো ১৫ বছর বয়সে ওখান থেকে স্কুল-ফাইনাল পাশ করে আমি চলে এসেছি, ১৯৫৪ সালে। যখন দেশ ব্রিটিশ-শাসনের অধীনে ছিল, তখন থেকেই আমি ওখানে। তখনই আমার জন্ম। তারপর যা কিছু হচ্ছে— যেমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তান-আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন— এ-সবকিছুই আমি ওখান থেকে দেখেছি। সব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছি। এক ধরনের চোলাই হওয়ার মতো জিনিস। তারপর ৪৭ পার হয়ে গিয়েছে। তারপরও আমি সাত বছরই ভারতে। সহজেই বর্ধমানের কোনো একটা নামকরা কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে পারতাম। আর মাত্র তিন-চারদিন দেরি করলেই। তখনই একটা চিঠি এলো আমার বোন আর ভগ্নিপতির কাছ থেকে, দৌলতপুর কলেজে ভর্তি হবো কিনা। আমার বাবারও একটা অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি ঝোঁক, বাবা একবারও বিবেচনা করলেন না যে, এই একটা ঘটনা থেকে বংশের ধারাটাই বদলে যাবে। বলল, তুমি যাবে? বললাম, হ্যাঁ যাবো। এসে দৌলতপুর কলেজে ভর্তি হলাম। পাসপোর্ট ইন্ডিয়ান। যাওয়া-আসা হতো। ’৬১-র পর পুরো ফ্যামিলিই চলে এলো খুলনায়। সে-অনেক ঘটনা। থাক।

হামিদ কায়সার: বর্ধমান থেকে খুলনায়। এখানে এসে কি লেখালেখি বা পড়াশোনার ধারাটা আগের মতোই রইল?
হাসান আজিজুল হক:  দেখো, বর্ধমানে থাকতেই  ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর, অমূল্য দাশগুপ্ত বলে একজন লেখক আমার পলিটিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষক ছিলেন, তাকে ‘মাটি ও মানুষ’ নামের আমার লেখা একটি অসমাপ্ত উপন্যাস, দেখিয়েছিলাম। পথের পাঁচালী দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়ে সেটা আমি শুরু করি। খারাপ হয়নি। এখনো আছে বোধহয়। সেটা কখনো ছাপব বলে মনে হয় না। শামুক বলে একটা উপন্যাস সমাপ্ত করেছিলাম। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি-উপন্যাস প্রতিযোগিতায় সেটা আমি দিয়েও ছিলাম। সেটা একবার কী দুবার সিলেকটেড হলো তারপরে বাদ গেল। সেখানে প্রথম পুরস্কার পেল মতি নন্দী, তারপরে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপরে পূর্ণেন্দু পত্রী—এরা সবাই সমবয়সী। ‘শামুক’ লেখাটা থাকলেও থাকতে পারে। এই লেখাগুলোকে আর কিছু করব না। ওগুলো ওভাবেই থাকবে। এ-রকম অসমাপ্ত উপন্যাস আমি প্রচুর লিখেছি। এ-ধারাবাহিকতা খুলনায় এসেও চলল। দৌলতপুর কলেজে যখন পড়ি তখন তো বেশ লিখি। নওয়াপাড়া থেকে একটা পত্রিকা বের হতো— মুকুল নামে। নাসিরউদ্দিন বলে একজন বের করতেন। একটার পর একটা লিখি আর দিই। দৌলতপুর কলেজের পত্রিকায়ই তো ৪/৫টা গল্প ছাপা হয়েছিল। সম্বুদ্ধ আমাদের শিক্ষক ছিলেন, আমাকে এত ভালোবাসতেন যে, উনি যে-বছর কলেজ-পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, আমার তিনটা লেখা একত্রে ছেপেছিলেন।

হামিদ কায়সার: তিনটা গল্পই কি চেয়ে নিয়েছিলেন?
হাসান আজিজুল হক: না। আমি তাকে তিনটা গল্প এ-কারণে দিয়েছিলাম যে, তার মধ্য থেকে যেন তিনি একটা বেছে নিতে পারেন। অদ্ভুত ব্যাপার যে তিনটাই ছাপলেন। ছেলেদের তো ভীষণ আপত্তি। যা হয় আর কী! অনেকের তো একটা লেখাও ছাপা হয়নি। আর আমার তিনটা। যেদিন পত্রিকা ডিস্টিবিউট করা হয়েছিল, আমার মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, আজিজুলের তিনটা লেখা ছেপেছি। ও যদি আরো একটা দিত, সেটাও ছাপাতাম। তোরা কী করতে পারবি?

হামিদ কায়সার: চিনতে পেরেছিলেন।
হাসান আজিজুল হক: এবং একটা কবিতাও ছাপা হয়েছিল। ‘সাগরপাড়ের পাখি’ বলে একটা কবিতা বেরিয়েছিল। তারপর পাট-শ্রমিকদের নিয়ে, পাটকল নিয়ে গল্প, তখন নানারকম জিনিস মাথায় খেলত আর কী! আর ওই মুকুল পত্রিকায় ছাপা হতো। এটা একটা ফেজ...আমার যদ্দুর মনে হয়, জীবনানন্দ দাশ তখন আমি খুব ভালো করে পড়তে শুরু করি। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে।...তখনই মনে হয় একী কাণ্ড! চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা...মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য... এ-কোন ভাষায় লেখা? তারপর ওই হাজার বছর ধরে... একটা নতুন আবিষ্কারের মতো মনে হলো। ওই যে চিরকালের জন্য জীবনানন্দের ভক্ত হয়ে গেলাম, এখনো আমি জীবনানন্দ দাশ মুগ্ধ হয়ে বিভোর হয়ে পড়ি।

হামিদ কায়সার: আর কার কবিতা পড়েন, ভালো লাগে কার কবিতা?
হাসান আজিজুল হক: বাইরের কবিতা বেশি পড়ি। কখনো ইংরেজিতে সরাসরি। কিংবা কখনো ইংরেজিতে অনুবাদ কিংবা কখনো সরাসরি বাংলায় অনুবাদ বেশি পড়ি। দেশের কবিতা পড়ি, এটুকু বলা যায়, তার বেশি এক ফোঁটাও উত্তেজনা অনুভব করি না। শক্তি এখনো আমার প্রিয়। কিন্তু শক্তি ততটা পপুলার হয়নি, যতটা সুনীল হয়েছে। বিবৃতি-বিবরণমূলক কবিতা আমার ভালো লাগে না। সেজন্যে নীরেন চক্রবর্তী, সুনীল এদের কবিতাকে খারাপ বলছি না, তবে আমার পছন্দের টাইপ এরা নয়, আমার টাইপটা শক্তির মতো, কী অসামান্য টুকরো-টুকরো দিয়ে, কী অসামান্য ভাষা দিয়ে... ভাষাটাকে কীরকম বার-বার কেটে দেয়, ভেঙে দেয়, প্রবণতা ওই অর্থে রাখে না। কিন্তু যদি বলি সুনীলের কথা, কেউ কথা রাখেনি, লম্বা বলে যাচ্ছে। অনেকটা আবেগের কাছে আবেদন আছে। শামসুর রাহমানের কবিতাও তাই। পড়তে গেলে প্রায় গল্পের মতো করে পড়া যায়। আবেগকে স্পর্শ করে। কিন্তু আমার পছন্দটা অন্য। বিষ্ণু দে-কে আমার ভালো লাগে। বুদ্ধদেবকে ভালো লাগে না। আমি কবিতা সম্বন্ধে কোনোদিন কিছু বলি না। কেননা কবিতা সম্বন্ধে আমার তেমন বিদ্যা-বুদ্ধি কিংবা মূল্যায়ন করার মতো ক্ষমতা নেই। জাস্ট আমার কেমন লাগে, এটুকুই বলতে পারি। আমার মন্তব্য সিরিয়াসলি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

হামিদ কায়সার: বর্ধমানের মতো দেখা যাচ্ছে খুলনাতেও আপনার লেখালেখি এবং পাঠ নতুন নতুন ভুবনের উন্মোচন করে যাচ্ছে—
হাসান আজিজুল হক: তখনই মানিক পড়েছি। খুব বেশি নয়। ধরো ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটি। এত অসাধারণ লেগেছে, এত নতুন মনে হয়েছে। মানিকের চাইতে আগেই কিন্তু আমি তারাশঙ্কর পড়েছি। পদ্মানদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা পড়েছি একটু পরে। পুতুল-নাচের ইতিকথা বারবার পড়েছি। তারাশঙ্কর-মানিক বোধহয় সবই পড়া। হয়তো তারাশঙ্করের শেষের লেখাগুলো আমি পড়িনি। আমার পড়তে ইচ্ছে করেনি।

হামিদ কায়সার: বিভূতিভূষণের ক্ষেত্রে তো এটা হয়নি?
হাসান আজিজুল হক: বিভূতি আমি আগাগোড়া পড়েছি। কিছু বাকি আছে বলে মনে হয় না। তবে মানিক আমি আবার পড়ব— দর্পণ, শহরতলী, চতুষ্কোণ, যদিও অনেকবার পড়েছি। বাংলা সাহিত্যটা  আমার খুব ভালো করে পড়া। বঙ্কিমচন্দ্র আমার খুব ভালো করে পড়া হয়েছিল। সতীনাথ পড়ি একটু পরে। বাকিটা তোমরা সবাই যেমন পড়েছো পঞ্চাশের সব লেখকের— জ্যোতিরিন্দ্র থেকে শুরু করে সবই।

হামিদ কায়সার: এই যে কলেজ-জীবন, শুধু পড়াশোনা নিয়েই থাকলেন? রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি?
হাসান আজিজুল হক: সেটা রাজশাহী থেকে।

হামিদ কায়সার: রাজশাহী...
হাসান আজিজুল হক: রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে পড়ি। অনার্সে। তখন ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলাম ভীষণভাবে। ছাত্র ইউনিয়ন করতাম আগাগোড়াই। পরবর্তীকালে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে। অবশ্য যোগাযোগ ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির আত্মগোপনকারী লোকদের সঙ্গেও। তারা এলে সঙ্গে যেতাম। মার্কসের লেখাটেখা পড়তাম। সহজ করে লেখা নীহাররঞ্জন, মার্কসের দ্বান্দ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি। তারপর কুদ্দুসের উপন্যাসটা, মরিয়ম, ওগুলো কিন্তু ওই সময়ে পড়া। তা ওটা একটা ধারা গিয়েছে। কোনো কোনো লেখা ছাপও ফেলেছে।

হামিদ কায়সার: আপনার গল্পে সমাজবাস্তবতা সবসময়েই মেলে, সেটা ওই প্রথম গল্প ‘শকুন’ থেকেই। সেই অর্থে ‘শকুন’ই তো আপনার প্রথম গল্প?
হাসান আজিজুল হক: যেটাকে লোকে বলে সাহিত্যে প্রবেশ। ১৯৬০ সালের মার্চ মাসে লেখা। লিখে সোজা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সমকালে সিকান্দার আবু জাফরের কাছে। গল্পটা কিন্তু উনি ছাপেননি। এরপর আরেকটা গল্প পাঠিয়েছিলাম, সেটাও ছাপেননি।

হামিদ কায়সার: না ছাপানোর কারণ?
হাসান আজিজুল হক: এখনো বুঝতে পারি না কেন ছাপেননি। বোধহয় ভুল পথে গিয়েছিলাম। অসম্ভব সাহিত্যবোধ ছিল তার, নতুন সাহিত্য চেনার ক্ষমতা ছিল। তাকে তোমরা দেখোনি। কুলপতির মতোই আর কী! অসাধারণ বক্তা। বৈঠকে এবং মজলিশে একাই কথা বলতেন। বহু বছর পর আমাকে বলেছিলেন, তোমার প্রথম গল্প আমি ছাপি। তাকে মনে করিয়ে দিইনি যে আমার প্রথম গল্প উনি ছাপেননি এবং দ্বিতীয় গল্পটিও ছাপেননি। সেই অভিমানে আমি আর কখনো সমকালে লিখিনি।

হামিদ কায়সার: আপনার তো লেখার অনেক জায়গা ছিল।
হাসান আজিজুল হক: পরিক্রমে লিখেছি, নাগরিকে লিখেছি, কণ্ঠস্বরে লিখেছি, পূর্বমেঘে লিখেছি। আরো অনেক পত্রপত্রিকা ছিল। তারপর দৈনিক পত্রিকাগুলোতে, যখন সাহিত্যের পাতা বেরোতে শুরু করল। আহসান হাবীব যখন দৈনিক পাকিস্তান এবং দৈনিক বাংলায় ছিলেন— আমাকে খুবই প্রশ্রয় দিতেন, খুবই ভালোবাসতেন। এবং মনে করতেন যে আমি এককালে ভালো লিখব। তিনি আমার অনেক গল্প ছেপেছিলেন।

হামিদ কায়সার: ‘শকুন’-এর পর কী লিখলেন?
হাসান আজিজুল হক: ‘একজন চরিত্রহীনের সপক্ষে’। পূর্বমেঘে বেরিয়েছিল। তারপর বেরিয়েছিল ‘একটি আত্মরক্ষার কাহিনী’। কোথায় মনে নেই। ‘আমৃত্যু আজীবন’ বেরিয়েছিল পূর্বমেঘে। ‘জীবন ঘষে আগুন’, বেরিয়েছিল পূর্বমেঘে। কণ্ঠস্বরেও ছাপা হচ্ছিল। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও ছিল ঘনিষ্ঠ। যদিও আমাদের চিন্তা বলা যায় একেবারে বিপরীত দিকে ছোটে আর কী। শুনি, পরবর্তীকালে যে-লেখাগুলো আমি অস্বীকার করেছি এবং যেদিকে যাইনি, উনি আমার সে-লেখাগুলো বেশি পছন্দ করেছেন। ওই যে সাম্প্রতিক ধারার গল্পতে ‘বৃত্তায়ন’ উনিই প্রথম ছাপেন। ‘বৃত্তায়ন’ বেরিয়েছিল তিন সংখ্যায় পূর্বমেঘে। আমি সেই লেখা সম্পর্কে অনেক মন্তব্য করেছি। পরবর্তীকালে আর ঠেকাতে পারিনি। পরে সেটা উপন্যাস হিসেবে বেরিয়েছে। আমার নিজের ধারণা যে আমি আর ওই পথে হাঁটিনি। আর ওই লেখার জন্যেই উনি মনে করেছিলেন যে, এটা একজন রাগী আধুনিক লেখকের লেখা। এই যে এতক্ষণ যে-আধুনিকতার কথা বলছিলাম, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে যেটাকে আমরা বলি, সিনিস্টার একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জীবনকে দেখা, সেইসব জিনিস ছিল। উনি ওইসব খুব পছন্দ করতেন। ফলে আমার অনেক লেখাই, যেমন মুক্তিযুদ্ধের পর ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ কণ্ঠস্বরেই ছাপা হয়েছে। আরেকটা খুব পুরানো গল্প ছাপা হয়েছিল, সেটাকে এক জায়গায় উল্লেখ করে উনি বলেছিলেন যে হাসান আর এই পথে গেলেন না, হাসান মার্কসীয় লাইনে চলে গেলেন।

হামিদ কায়সার: কী বিষয় ছিল গল্পটার?
হাসান আজিজুল হক: খুব মরবিড একটা গল্প। বিয়ে না করে একটা ছেলে আর মেয়ে এক জায়গায় চলে গিয়ে থাকছে। আজকাল তোমরা যে-সমস্ত জিনিস খুব অন্যরকম করে লেখো আর কী। আমি ওইদিকে আর যাইনি। তো উনি ওটাকে খুব পছন্দ করেছিলেন। সাধারণভাবে তখন মনে করা হচ্ছিল যে, ষাটের দশকে নতুন সাহিত্য-তৈরি হচ্ছে পঞ্চাশের দশককে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। সাহিত্যের নতুন নতুন আন্দোলন হচ্ছে, নানান পত্রিকার পরিকল্পনা হচ্ছে, নতুন রীতির গল্প হবে। তখনই রিলকের অনুবাদ বের হয় বুদ্ধদেব বসুর। মেঘদূতের অনুবাদ, বোদলেয়ার, লোরকা এদের কবিতার সঙ্গে তখন কেবল পরিচয় হচ্ছে। নতুন সাহিত্য-তত্ত্বগুলোর সঙ্গে, নতুন দর্শন— পশ্চিম বাংলায় তখন হাংরি জেনারেশন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের। তাদের যে পুলিশে ধরেছে সে-ছবি নিয়ে টাইম পত্রিকায় প্রচ্ছদ-কাহিনী হয়েছিল। সে-একটা হুলস্থুল কাণ্ড। কিন্তু আমি দূরে বসে আছি। রাজশাহী থেকে নিজের মতো লিখছি।

হামিদ কায়সার: এই যে এত আন্দোলন, নতুন মত নতুন দর্শন, এত ডামাডোল— এসব আপনাকে আলোড়িত করেনি?
হাসান আজিজুল হক: আমি নিজের জায়গাটা ঠিক করেছি এবং লিখব নিজেই। আমি বিদেশ থেকে যা-ই নেব, আমাকে হজম করে নিতে হবে। আমার দেহের রসের সঙ্গে তা মেলাতে হবে। আলাদা করে কাজ করব না। যদিও একবার উত্তেজিত হয়ে একটা-দুটো কাজ করে ফেলেছিলাম। যেমন বৃত্তায়ন। এটা আমি স্বীকার করি যে, তখন কেবল জাঁ পল সার্ত্র পড়েছিলাম। এটা ভীষণভাবে আমাকে আকর্ষণ করে। কিন্তু আমার একটা স্ট্যান্ড ঠিকই ছিল। আর ওরা যে কত রকমের হুলস্থুল লাগিয়েছে, কত রকমের বিদ্রোহ! আমি কনফিডেন্টলি সাহিত্যচর্চা করেছি। আমি মনে করেছি এইটাই ধারা। একদিন এইখানেই ফিরতে হবে। ষাটের দশকে ওরা লিখুক না কেন থাকতে পারেনি। স্যাডওয়ালারাও থাকতে পারেনি, হাংরিওয়ালারাও থাকতে পারেনি । আর বাংলাদেশে তো বিলাসিতার কোনো জায়গাই ছিল না।

হামিদ কায়সার: কেন?
হাসান আজিজুল হক: মুক্তিযুদ্ধ এবং গণ-অভ্যুত্থান এমন থাপ্পড় মারল। মানে, যাকে বলে আর্ট ফর আর্ট’স সেক, নন্দনতত্ত্ব, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রচনা, আধুনিক মানুষের যুগ-যন্ত্রণা, এই সমস্ত জিনিস খুবই হাস্যকর এবং লিখলে মনে হতো লোকে মার দেবে। ৬৯-এ যে-অবস্থা হয়েছিল দেশের— তখন কিন্তু ‘আমৃত্যু আজীবন’, ‘শোণিতে সেতু’, ‘জীবন ঘষে আগুন’ ভীষণভাবে— আমার গৌরব করার কিছু নাই, কিন্তু কী ভীষণভাবে— ধারণ করছে সমাজের ওই আগুনগুলোকে। ‘জীবন ঘষে আগুন’ আগুনই বলব। ‘শোণিতে সেতু’ খুবই মোটা দাগের গল্প। কিন্তু কী ভীষণভাবে চেষ্টা করেছে সমাজের ভেতরে যে-আগুনটা তৈরি হচ্ছে সেটাকে ধরে রাখতে, কাজেই আমার তখন আফসোস হয়নি। আমার মনে আছে, আমাকে বলাই হতো, আপনি যথেষ্ট আধুনিক নন। যেটা এখনো কেউ কেউ বলে। আমি তখন হেসেছি। আমার খালি মনে হয়, কায়দা করে কোনো লাভ নেই। যদি নিজে কিছু তৈরি করার না থাকে শুধু তাকিয়ে দেখতে হয়। আমি লিখে যাচ্ছি গ্রাম নিয়ে, অসহায় মানুষ নিয়ে, দশদিন খায় না। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত অবশ্য স্বধর্মচ্যুত হয়নি। যতই আধুনিক হোক, সে নিজের ভিতর থেকেই লিখত। তাকে আমি অন্য একটা জায়গায় রাখব। সে ওরকম স্রোতে ভাসেনি। ইলিয়াস বেশ পরে এসেছে। ও কিন্তু অনেক জুনিয়র। যদিও দুটো-একটা লেখা তখন লিখেছে, ইলিয়াসও কিন্তু মাতেনি। আহমদ ছফারও একটা নির্দিষ্টতা ছিল। মেতেছে যারা আজকে তাদের নাম সম্ভবত তেমন করে পাবে না।

হামিদ কায়সার: লেখক হিসেবে আপনি কি সন্তুষ্ট?
হাসান আজিজুল হক: এটা আমার জীবনে কোনোদিন হয়নি। কোনোদিন হয়নি, আজও হয় না। আমি লিখে যাই। লিখে যাই। কখনো কখনো মনে হয়, আচ্ছা ঠিক আছে, এই জায়গাটিই ঠিক হয়েছে। কিন্তু আমার বেশির ভাগ লেখার পরেই এই অক্ষমতা এবং অসহায়ত্বের ফিলিংসটাই আসে। কেউ যেন মনে না করে আমি খুব গর্বিত হয়ে পড়ি। মোটেই না। গর্বিত হয়ে পড়ি না। আমি নিজেই নিজের লেখা পড়ি না। ছাপা হলে ভুলটুল আছে কিনা একবার জাস্ট দেখি। হ্যাঁ। এবং যতবারই পড়ি ততবারই, আরে এই লেখা অন্যে কেন পড়বে, অন্যরা কেন পড়বে, এইটা আমার মনে হয়। আমি সত্য কথাটাই বললাম।

হামিদ কায়সার: কিন্তু যখন আপনার কানে আসে, কেউ বলছে হাসান আজিজুল হক ফুরিয়ে গেছেন তখন আপনার কী মনে হয়?
হাসান আজিজুল হক: আমার অত তাড়াতাড়ি মরবার ইচ্ছা নেই এবং অত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবারও ইচ্ছা নেই। কেউ ফুরিয়েছে বললে আমার কিছু আসে যায় না। কারণ আমি জানি ফুরিয়েছি কী ফুরাইনি। অন্যে বলে আমার কী করবে? আমি যখন বুঝতে পারছি হচ্ছে না, তো আমি নিজেই বুঝতে পারব যে আমার আর লেখা-টেখার দরকার নেই। গল্প লিখি না, তা তো না। লিখছি তো। চেষ্টা করছি নতুন করে গল্প লেখার। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা বড় গল্প লিখেছি। এখনো বের হয়নি। নিরন্তরে বের হবে। ওই যে যেখান থেকে তরলাবালা বের হবে।

হামিদ কায়সার: তরলাবালা কতদূর এগোল?
হাসান আজিজুল হক: তরলাবালা আমি যাতে ভালোভাবে শেষ করতে পারি সেজন্যে আমি সশরীরে বেশ কিছুদিনের জন্যে কুমিল্লা যাবো। আর কুমিল্লার একজন খাস লোকের সঙ্গে আলাপ করব। দেশের ওই অংশটাতেই আমার এখনো যাওয়া হলো না।

হামিদ কায়সার: সমকালীন লেখালেখি বিশেষ করে কথাসাহিত্যের বর্তমান অবস্থাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
হাসান আজিজুল হক: আমি তোমাদের লেখাও পড়ি। বলতে গেলে অনেক লেখাই পড়ি। অনেক ভালো লেখাও আছে। কিন্তু সাধারণভাবে আমি যেটা বলছি সেটাকে অভিযোগ হিসেবে নিও না। আমার মনে হয়, আমরা আমাদের পসিবিলিটি এক্সপ্লোর করছি না, ভাবছিও না। আমাদের অভিনিবেশগুলোর বাইরে এগুলো রেখে দিয়েছি এবং যেখানে অভিনিবেশগুলো রেখে দিয়েছি সেখানে হওয়া মুশকিল আছে—অন্তত কথাসাহিত্যে।

হামিদ কায়সার: আপনি নিজে এ-চেষ্টাটা করেননি কেন?
হাসান আজিজুল হক: হয়তো অপারগ। হয়তো অত বড় ক্ষমতা আমার ছিল না। সেজন্যে পারিনি। আমি জানি না। কিন্তু তাই করতে চেয়েছিলাম। সমস্ত জীবনে সেটা করার জন্যেই সাহিত্যকে বেছে নিয়েছিলাম। আর কিছু না। আমি অন্য সমস্ত প্রফেশনকে ত্যাগ করেছি। ইচ্ছে করেই ত্যাগ করেছি। অনেক সময় দরকার এবং অনেক সময় পাবো বলে এই অধ্যাপনা এবং মাস্টারিতে যাওয়া। অন্য কোথাও গেলে যদি আমার কোনোরকম মতিভ্রম হয় বা বিক্ষিপ্ততা দেখা দেয়, আমি কাজ করতে পারব না। আমি সেজন্য সেটা করিনি। কিন্তু সে-দুঃখ আমার যেটুকু সশংয় অবশিষ্ট আছে আমি এটাই করব, এই প্রতিজ্ঞা সবসময়ে নিজের মধ্যে রেখেছি। আমি সে-রকম করতে পারব কিনা জানি না। কিন্তু সে-রকমই চাইছি। যেমন আত্মজীবনীটা সে-রকমেরই একটা চেষ্টা। যদি উপন্যাসটি ওভাবে লিখে ওঠা না হয় তাহলে সেই লেখার কিছুটা পূরণ যেন এই আত্মজীবনীটার মধ্যে হয়। তোমাদের সঙ্গে যে-কথাটা বললাম যে-কালটার কথা বললাম, এই সবটাকে যদি আমি ঢোকাতে পারি। যে-বাল্যকাল মিলিয়ে উপমহাদেশ মিলিয়ে, আমার বড় হওয়াটা মিলিয়ে, সমস্তটাই যদি আমি ঢোকাতে পারি, যার মধ্যে দেশত্যাগ থাকবে, দাঙ্গা থাকবে, রাজনীতি থাকবে।

হামিদ কায়সার: গদ্যসাহিত্যের সামগ্রিক অবস্থাটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
হাসান আজিজুল হক: নেগেটিভ হোক পজিটিভ হোক, একটা বাস্তব সত্য হচ্ছে, প্রচুর গদ্য আজকে বাংলায় লেখা হচ্ছে। পশ্চিমবাংলায়ও এত গদ্য লেখা হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। এত ডেইলি খবরের কাগজ। এখন ডেইলি কাগজের জন্যে গদ্য লিখতে গেলে গদ্যটাকে স্বচ্ছন্দ করতেই হয়। কাজেই এটা ভালো গদ্য। কী গদ্য সেটা আলাদা কথা। হঠাৎ ভালো গদ্য চোখে পড়ে। প্রায়ই ভালো গদ্য চোখে পড়ে না। এবং ক্রিয়েটিভ লোকদেরও হয়তো প্রশংসা করব তার ক্রিয়েটিভিটির, কিন্তু গদ্যের প্রশংসা করতে পারব না। অনেকেই, আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, খুব ভালো লেখক বা লেখিকা, চমৎকার লিখেছে, খুব দামি কথা খুব দারুণ কথা লিখেছে। অনেকেই এটা পারছে এখন। মহিলাদের মধ্যেও এখন অনেকেই পারছে। কিন্তু গদ্য নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে। নানারকম দুষ্ট গদ্য লিখে সে বসে আছে। এমনিই চলতি কাজ চলার জন্য গদ্য লিখে দেওয়াটা, এটা কিন্তু এখন চালু হয়েছে। প্রচুর প্রোজ এখন লেখা হচ্ছে এবং আমার মনে হয় এটা করতে এক সময় স্ট্যান্ডার্ড প্রোজ দাঁড়িয়ে যাবে। এখনকার লেখকদের হাতে গদ্যটা আছে।

হামিদ কায়সার: তরুণ লেখকদের সম্পর্কে আপনার কী দৃষ্টিভঙ্গি?
হাসান আজিজুল হক: নতুনরা তো এখন খুব ভালো লিখছে। একটা     কথা আমি বলব যে, গদ্য এখন অনেক স্বচ্ছন্দে আমাদের লেখকরা লিখছে এবং সেটা তাদের ক্রিয়েটিভ সাহিত্যের বাইরে। তাও বটে। অর্থাৎ শিল্প নিয়ে, সমাজ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে হাতে লেখা এসেছে। ভালো-মন্দের চাইতে বলব জোর করে, লেখার ভলিউম যেটা, সেটা কল্পনাতীত বেড়েছে। আমাদের সময়ে তো কোথায় কাগজ, কোথায় কী, কিছুই ছিল না। গদ্য খুব কম লোকই লিখত। তুমি পুরানো লোকদের লেখার পরিমাণটা দেখলেই বুঝতে পারবে— কিচ্ছু নেই। তরুণদের প্রতিও আমার সেই একই কথা। তবে, আমাদের সমাজটাতে তরুণদের জন্যে কী আছে?  কী আছে? খুব প্রতিভাবানদের জন্যে কী আছে? বড় বিজ্ঞানীর জন্য বাংলাদেশ কী আছে? সাধারণ গৃহের মানুষদের জন্যে বাংলাদেশে কী আছে? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা বেরিয়ে আসছে তাদের জন্যে কী আছে? তাদের সামনে, তাদের পরবর্তী জেনারেশন যারা আসবে, তাদের সন্তান যারা হবে, তাদের জন্যে কী আছে? আমাকে তো সোক্ করতে হবে। আমার ব্লটিং পেপার দিয়ে তো আমাকে কালি শুষতে হবে। সমাজ থেকে তো আমার প্রতিভাগুলোকে শোষণ করে ব্যবহার করতে হবে। যদি একেবারেই রিজেক্ট করি, বদহজমের মতো, তাহলে জীবন তো বৃথা যাবে না। তাহলে কেন তারা ইতরের জীবন, ক্রীতদাসের জীবন, অধস্তনের জীবন, অধমর্ণের জীবন, গোটা দেশে ছন্নছাড়া জীবন কেন কাটবে? ব্রিলিয়ান্ট যদি কেউ হয় সে বিদেশেই হবে। ফলে কী হবে? এককভাবে কোনো এক ফজলুর রহমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতম ভবনটি  বানিয়েছে। তাহলে ভাবব যে, আমাদের তরুণদের জন্যে আমরা কী রেখেছি। তারা হঠাৎ করে খুব খুব ওয়েলমিনিং যুবক হবে, এ তো আশা করা যায় না।

হামিদ কায়সার: যেভাবে আকাশ-সংস্কৃতি সব দখল করে নিচ্ছে, ভোগসর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে সমাজ, রাজনীতি সবকিছু, আপনি কি আশংকা করেন শিল্প-সাহিত্যের আবেদন ক্রমাগত হারিয়ে যাবে?
হাসান আজিজুল হক: আমাদের সমস্ত ভাবনাকে, কল্পনাকে, চিন্তাকে, চিন্তার গভীরতাকে উজ্জীবিত করাতে যে তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তার একটা রেডিমেড ডিশে যেমন তৈরি করে রান্না-করা খাবার সামনে দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি করেই আজকের শিল্পবস্তু, শিল্পকর্ম দৃশ্যগ্রাহ্য করে স্পর্শগ্রাহ্য করে আমাদের সামনে প্রত্যক্ষ করানো হচ্ছে এবং সেটা উপভোগের ক্ষেত্রে আমাদের কল্পনার, বুদ্ধির, অনুভবের, ভাবনার, সক্রিয়তার আর কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না। এটাই তো কথাই। কথা তো এখানটাতেই। এবং মানুষ যেহেতু সবসময়ে সহজভাবে সময় কাটানোর দিকে যেতে চায় অর্থাৎ তার যাবতীয় বাঁচবার জন্য নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলো সে দ্রুত বদলায়, সেটা যতটা না প্রয়োজনীয় তার চাইতে অনেক বেশি হচ্ছে যে, আমি অত জটিলতার দিকে ঝামেলার মধ্যে যাবো না। দাড়ি কাটার জন্যে আগে তলোয়ার থেকে শুরু করে কী ঝামেলাতেই না পড়তে হতো? এখন কী অসাধারণ ব্যবস্থাই না হয়েছে! এরপর হয়তো দাড়ি আর আমার কাটার প্রয়োজনই হবে না। যন্ত্রই হয়তো সকালবেলা আমার দাড়িটা কেটে দিয়ে চলে যাবে। আমি এটাই এক্সপেক্ট করব। তার মানে মানুষ একদিক থেকে তার যে শ্রমবিমুখতা বা একেবারে কিছুই না করে সমস্ত সুযোগ-সুবিধাগুলো পাওয়া— এই দিকেই আমাদের প্রযুক্তিটা আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে। জীবনযাপনটাকে অনেক সহজ করে ফেলেছে। কিন্তু যাচ্ছে বলে যে আর উপভোগ্যতা বাড়ছে এমন বলা যাবে না। আমার মনে হচ্ছে যে, যত উপভোগের সামগ্রী আমাদের সামনে প্রদত্ত হচ্ছে বা আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে, ততই আমাদের উপভোগের ক্ষমতাটাও তীব্রতা, নতুনত্ব, অভিনবত্ব— এই জিনিসগুলো টানাটানির উপর। কিন্তু উপভোগ যখন একটা বিরাট আকার ধারণ করে আমাদের সামনে চলে আসে, তখন উপভোগের তীব্রতা, উপভোগের বিশুদ্ধতা সব নষ্ট হয়ে যায়। এইদিক থেকে তুমি যে-আশংকাটা করছ, সেটা বাস্তব প্রমাণিত হচ্ছে। এখনকার ছেলেমেয়েদের গ্রন্থবিমুখতা, মুদ্রিত জিনিসের প্রতি এক ধরনের এভারশন, সেটা এখন দেখা যাচ্ছে। এবং সেই কারণেই তাদেরকে টানবার আমাদের যাবতীয় ইচ্ছা মার খেয়ে যাচ্ছে। মার খাচ্ছে বলে ও কিন্তু আবার সেটা, শিল্প-সাহিত্যে যেটা হচ্ছে, তা অনেকটা মনের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছে। এখন যে নানারকমভাবে বাংলা গদ্য, গল্প নতুন করে লেখা হচ্ছে, এখন এই নতুন বলতে কী বুঝি? এই জিনিসগুলো যে প্রচণ্ড রকমের বাড়াবাড়ি এবং এইগুলো করার একটা কারণ হচ্ছে যে, সর্বসাধারণ উপভোগ করতে গিয়েই এগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। জানি না আমার এ-কথাটা কতটা গ্রাহ্য হবে। এ-সর্বসাধারণের উপভোগের ক্ষেত্রটা যদি বাস্তবে থাকত, তাহলে আমাদের এ-রকমভাবে শুধু ভাষা নিয়ে, বা শুধু প্রকরণ নিয়ে, কৌশল নিয়ে, এত তত্ত্ব নিয়ে আমাদের ভাবতে হতো না। কিন্তু আমরা দেখি, আরে বাবা এ-জিনিস ক্রমেই তো পিছিয়ে চলেছে, এবং একান্ত আমার, আমার বন্ধুদের জিনিসগুলো হারাচ্ছে, তখন আমার আর কিছু করার ছিল না। তখন আমি হাঁটু পানিতে দুমদাম সাঁতার কাটছি। তখন আমার অগাধ পানির কিন্তু দরকার নেই। আমার কাছে মনে হয়, এই রং, ফেনা এবং প্রচুর রকমের অনাবশ্যক লম্ফঝম্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে, শিল্পের ক্ষেত্রে, এই কারণেই হচ্ছে। আর যতই এগুলো হচ্ছে, ততই সার্বিক উপভোগ্যতাকে তাড়িয়ে আকাশ-সংস্কৃতি বাংলা-জগতে হাজির হচ্ছে। এভাবেই হয়তো এক্সপ্লেইন করা যায় আজকের অবস্থাটা এবং সেই কারণেই বলা যেতে পারে, তুমি আগে যেমন বললে, একটা থেকে আরেকটা, আরেকটা থেকে আরেকটা, ছোট গ-ি থেকে বড় গণ্ডি, বড় গণ্ডি থেকে আরো বড় গণ্ডি, আমরা সাহিত্যে এভাবে বড় হয়েছি। শিশুপাঠ্য বই পড়েছি। তারপর সেখান থেকে হয়তো আন্তর্জাতিক সাহিত্য-শিল্পের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। সাহিত্য থেকে হয়তো চিত্রকলার দিকে গিয়েছি, সাহিত্য থেকেই হয়তো শিল্পের দিকে, গানের দিকে, গিয়েছি। একটা থেকে আরেকটা আগুন জ্বালিয়েছি।

হামিদ কায়সার: দিয়াশলাইয়ের মতো।
হাসান আজিজুল হক: শিল্প অনেকটা দিয়াশলাইয়ের মতো। একটাতে ধরেছে, সেটা থেকে আরেকটাতে ধরেছে। এটা হয়েছে। আজকে এটা হওয়ার যে-বাস্তব পরিস্থিতিটা সেটা অনেক কমে যাচ্ছে। কমে যাওয়ার ফলে আমি যে ছুটোছুটি করব, আমার জন্য যে-তৃষ্ণা তৈরি হবে, আমরা যেটা করব সেটা সৃষ্টি হওয়ারই আর জায়গা থাকছে না। কারণ তৃষ্ণাটা অন্যভাবে মেটাবার ব্যবস্থা থাকছে। এই কারণেই পুরো ঘটনাটা ঘটছে। এটা একটা দিক। কিন্তু অন্যদিক থেকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জিনিসটার দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে মনে হয় যে, আচ্ছা যখন মুদ্রিত জিনিস মুদ্রিত হয়নি, মুদ্রিত জিনিস ছিল না, হোমারের কাব্যদুটো কিংবা তারও আগে মৌখিকভাবে কবি ঘোষণা করতেন, চারণ কবিরা গেয়ে বেড়াতেন, ছাপাই হতো না, ছাপা কেউ চাইলেও পেত না আমাদের সমস্ত মধ্যযুগে বলা যেতে পারে যখন মুদ্রণের আবিষ্কার হয়নি, তখন সাহিত্য উপভোগ করার ক্ষেত্রটা কত ছোট ছিল। শিক্ষিত লোকেও কিন্তু পারত না। কারণ বই নেই। এটা একটা পা-ুলিপি। বই যে করাবে তাকে তো পয়সা খরচ করতে হবে, কাজেই একটা বইয়ে যদি একশটা কপি হতো তাই বিরাট ব্যাপার। একশটা কপি হতো না। তাহলে বিদ্যাপতি, চণ্ডিদাস এইসব জিনিসের যে-চিরকালীনতা— এই চিরকালীনতার প্রচারের কোনো বন্দোবস্ত কিছুই ছিল না। কিন্তু অস্বীকার কি করা যাবে যে এগুলো চিরকালীন জিনিস অর্থাৎ সমস্তরকমের সাম্প্রতিকতাকে অতিক্রম করে ইলিয়াড কিন্তু থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ এদিক থেকে বলা যাবে ইলিয়াড এদিনেও যেমন একশ বছর আগেও তেমন, তার একশ বছর আগেও ঠিক তেমনই। যখন সেটা রচিত হয়েছে এবং গৃহীত হয়েছে তখনকার অবস্থাটা অন্যরকম ছিল। কিন্তু তারপর থেকে ওটা একটা সম্পদ। সেখানে কিন্তু তোমার ওই আকাশ-সংস্কৃতি স্পর্শ করতে পারছে না। সেটা যদি না পারে, তাহলে যা কিছু সত্যিকারের শিল্প হিসেবে গোটা ম্যানকাইন্ডকে অ্যাড্রেস করতে পারে, সেটা একটা শিল্পের শর্ত হওয়া উচিত। কোনো না কোনোভাবে মাস্ট অ্যাড্রেস যদি হোল ম্যানকাইন্ড, এটা যদি করতে পারি, তাহলে ওই যে ব্যবহৃত হোক বা না হোক, তার মূল্যটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে। থেকে যখন যাচ্ছে অর্থাৎ সে তখন সবসময় অনন্য একটা ভূমিকা নিয়ে হাজির থাকছে। অনন্য মানে কী? ওই যে শিল্প-সাহিত্য চিরকালীন যেটা সেটা যা দিতে পারবে সেটা দেওয়ার জন্য কোনো বিকল্প নেই। তোমার এই আধুনিক সভ্যতায়ও নেই। ওটা কিন্তু ওভাবেই থেকে যাবে। থেকে যদি যায় তাহলে বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ  ওখানে যাবে। যাক বা না যাক তবু ওটা ওখানে থাকবে, ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম ওখানে যাবে। অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্যের মার নেই। সেজন্যে আমার মনে হয়, হ্যাঁ, আজকাল হয়তো পথের পাঁচালী পড়বার ধৈর্য কারো নেই। আজকাল হয়তো গোরা উপন্যাস পড়বার ধৈর্য কারো নেই। আজকাল হয়তো শেক্সপিয়রের নাটক পড়ার ধৈর্য কারো নেই। কিন্তু ওই জিনিসগুলোর মূল্যটা যে ক্ষুণ্ণ হয়েছে তা তো নয়। কাজেই এ-যুগেও যদি সে-রকম কিছু লিখতে পারা যায়, বলতে পারা যায়, আর সেটারও যদি সে-রকম অ্যাড্রেস করা যায়, সেটা কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। থেকে যায়। থেকে যখন যাচ্ছেই তাহলে তার ভোক্তা মিলবেই। এই গর্ব দিয়েই কিন্তু আমাকে লিখতে হবে। এই কাজটা আমি আমার জীবনের সমস্ত কাজ বাদ দিয়ে করেছি। জানি যে তার ডিমান্ড এই মুহূর্তের, নগদ মূল্যটা এই মুহূর্তে নেই। আমি জানি যে এটা মানুষকে একদম ভিতরে গিয়ে স্পর্শ করার মতো জিনিস আমি দিয়ে গিয়েছি। ওইটাই আমার গর্ব, ওইটার কাছে মানুষ ফিরবেই ফিরবে। আজ হোক কাল হোক ফিরবে। এটা মনে না করলে লেখাই যাবে না, কাজ করা যাবে না, চিন্তাভাবনা করা যাবে না।

হামিদ কায়সার: এটাই তো লেখক-শিল্পীর কাজের মূল প্রেরণা।
হাসান আজিজুল হক: অনেক ইলিয়াড কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু যেগুলো রয়ে গেছে রয়েই গেছে, সেগুলোর মূল্য কমাবার কোনো ব্যাপার কিন্তু নেই। মহাভারতের মূল্য কমে গেছে এটা কেউ বলবে না। সেই মূল্যটা আছে। আজকে কেউ পড়বে না, সেটা তো ভিন্ন। অর্থাৎ একটা হচ্ছে শিল্পের চিরকালীন আবেদন যেটা থাকে, একটা জিনিস আর সেটা ব্যবহার করায় কমবেশি হয়, সেটা আরেকটা জিনিস।

হামিদ কায়সার: আপনাকে কেউ কেউ বলে থাকেন রাঢ়ের লেখক, এই যে একটা অঞ্চলে আপনাকে বেঁধে দেওয়া হয়, বিষয়টাকে আপনি  কীভাবে দেখেন?
হাসান আজিজুল হক: কোনো একটা দিক থেকে দেখতে গেলে সব লেখাই আঞ্চলিক। ল্যাটিন আমেরিকান সমস্ত লেখাই ওই অর্থে আঞ্চলিক। গোটা পৃথিবীটাই একটা ভাগ নিয়ে লেখা। তাহলে প্রামিদ্য অনন্ত তোয়ের যে ইন্দোনেশিয়ান লেখক, সে-ইন্দোনেশিয়াকেই নিয়ে এসেছেন। আমি সদ্য তার কিছু লেখা পড়লাম। তার মহাকাব্যিক লেখাও পড়লাম। মেয়ের কাছে লেখা তার বন্দিজীবনের কাহিনী। মনে হয় এদের লেখা— যাই লিখুক না কেন— তার একটা প্রাসঙ্গিকতা, তার একটা জেনুইননেস দাঁড়াবেই। কেন পোস্ট মডার্নিজম, কেন ম্যাজিক রিয়ালিজম— এই সমস্ত কথা আমার মুখ থেকে বেরোবে, যারা সৃষ্টিশীল লেখার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে? আমি বুঝতে পারি না। আমি দর্শনের লোক বলে, পেশাগত কারণে আমাকে এই সমস্ত জিনিস একটু দেখতে হয়, একটু পড়তে হয়। আমি এখনো পর্যন্ত সদুত্তর খুঁজে পাইনি। যত লেখা পড়েছি, এমন নয় যে আমি খোঁজ-খবর রাখি না। সারামাগার লেখা তো পুরানো নয়, অনন্ত তোয়েরের লেখা তো পুরানো নয়। অরুন্ধতি থেকে শুরু করে কার লেখা পড়ছি না? অনিতা দেশাই থেকে কে না? সালমান রুশদি, ল্যাটিন আমেরিকান, সব লেখাই তো পড়েছি। তাদের একটাই ধ্রুব আছে— সময়, সমাজ, মানুষ। ফিক্সড করা আছে তার নিজের দেশ। আমাদের বাংলাদেশে, আমাদের কথাসাহিত্যে— কোনো দোষারোপের কথা নয়, এই রকম ইতিহাসে মনোযোগ ওইখানে যাবে না। বিশাল সৃষ্টি ওইখান থেকে হবে না। ষাটের দশক আমাদের গেল বাঙালির পুরো সেন্টিমেন্টাল রাইটিং দ্বারা। সেন্টিমেটাল রাইটিং বাংলা সাহিত্যের প্রধান দুর্বলতা। মার্সেল প্রুস্তের মতো লেখা আমি লিখতে পারি না। সেটা আমার দ্বারা হয় না। বালজাক, স্তাঁদাল, ডারেল-টারেল হতে পারে। কিন্তু প্রুস্তের মতো লেখা, কামুর মতো লেখা কিংবা সার্ত্রের মতো লেখা হয় না। আমি সমস্ত জিনিসটা সোজা অ্যাপ্রাচ করি আমাদের হৃদয়ের কাছে, যা বাঙালির বিশিষ্টতা। যদি কেউ আমাকে বলে যে গোটা বাঙালি জাতির যে হৃদয় দিয়ে বোঝা, সেটা তো অন্য ভাষায় বলতে পারো যে, কবিতা দিয়ে বোঝা। বুদ্ধি দিয়ে বোঝা, রাগ না করে বোঝা, বোঝার সময়টাতে কোনো আক্ষেপ-আফসোস, অনুভব, ক্রোধ, স্যাটিসফেকশন, কোনো কিছু না জড়িয়ে বুদ্ধি দিয়ে প্রকাশ করা, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, যার আদর্শ।

হামিদ কায়সার: বিশাল ক্যানভাসে তো কাজই হলো না সেভাবে!
হাসান আজিজুল হক: যেহেতু বিরাট ক্যানভাসটা মাথার মধ্যে ধারণ করা— বহুত সময়, বহুত ইতিহাস, বহুত বিচিত্র জীবনযাপন, এটাকে আমরা গ্রাস করতে না পারার ফলে, আমরা এটা পারি না, বিশেষ করে আমাদের মিডল ক্লাসের গ্রোথটা যেভাবে হয়েছে, সেজন্যে। মিডল ক্লাস হয়েছ তো তুমি শহরে আটকা পড়ে গেছ। নাইনটিনথ্ সেঞ্চুরির বাংলা সাহিত্যের যদি কোনো দোষ থাকে এটাই তার দোষ। অসম্ভব সংকীর্ণতা। অত্যন্ত হাই সোসাইটির লোক ছিলেন টলস্টয়। কিন্তু তার বইতে যখন চাষি আসছে, একদম সেই চাষিটাই আসছে। এ কী আশ্চর্য ঘটনা! অথচ কীরকম উন্নাসিক জীবনযাপন করতেন! তখন লিখছেন কেমন করে লিখছেন! শেখভ, দস্তয়ভস্কি, এমনকী তুর্গেনিভের মতো অভিজাত লেখক। তার মানে তাদের জীবনের অভিজ্ঞতাটা ব্যাপক হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা ইংরেজি শিখে মিডল ক্লাস হওয়ার পর থেকে কলকাতা শহর তৈরি করেছি। আজকে কলকাতা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কোনো শহর নেই। আজকে ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের কোনো শহর নেই। আরে! সব টেনে নিয়ে গিয়ে হাঙরের মতো পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বসে আছি। অর্থনীতি-রাজনীতি-সাহিত্যও তাই। এই চোখটাকে ছড়িয়ে দেওয়া, পুরো জাতিতে চোখ যাওয়া— আমি সেটাই করছি।

কৃতজ্ঞতা: শাহনাজ সালমা
ডিসেম্বর ২০০৪, কালি ও কলম