কবি-সাহিত্যিকরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা

মহাকালে রেখাপাত ৯১

স্বকৃত নোমানে

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৮, ২০২৩

সেদিন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার নাটোরের এক আড্ডার কথা লিখেছিলেন ফেসবুকে। সেই আড্ডার বর্ণনা দিতে গিয়ে জাকির ভাই লিখলেন, ‘ইউক্রেন এমন সব ড্রোন দিয়ে রাশিয়াতে হামলা চালাচ্ছে যেগুলো আঘাত করে আবার ফেরত আসতে পারে।’ ব্যাপারটা আমার মধ্যে বেশ কৌতূহল জাগাল। নেট সার্চ দিয়ে জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্র ‘গ্র্যামলিন’ নামের এমন এক অত্যাধুনিক ড্রোন আবিষ্কার করেছে, যা দূরের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে সফল আঘাত হেনে ‘মাদারশিপে’ তথা গন্তব্যে ফিরে আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এই ড্রোন আবিষ্কার করে ২০২০ সালে। সম্ভবত ড্রোনগুলো ইউক্রেনকে দিয়েছে এবং সেগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে ইউক্রেন।

আমি তো পুরাণচারী। মনে পড়ে গেল, পুরাণের এক বিশেষ শরের কথা। বাল্মিকী রামায়ণে এমন তীরের ব্যবহার দেখা যায় যা লক্ষবস্তুতে আঘাত হেনে আবার তুণীরে ফিরে আসতে পারে। রামচন্দ্রের কাছে এই তীর ছিল, লক্ষ্মণের কাছে ছিল, হানুমানের কাছেও ছিল। সম্ভবত ভরত বা ভরতপুত্রের কাছেও ছিল। মনে নেই। কেবল রামায়ণে নয়, মহাকাব্য মহাভারতের অনেক মহারথীর কাছেই এমন তীর ছিল, যা নির্দিষ্ট লক্ষবস্তুতে আঘাত হেনে আবার তুণীরে ফিরে আসত।

বীর বারবারিকের কাছেও ছিল এমন তীর। বারবারিক ছিলেন ভীমপৌত্র তথা ঘটোৎকচ-অহিলাবতীর পুত্র। তার কথা মহাভারতে উল্লেখ নেই। কাশীদাসী কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারতে পাইনি, হরিদাসসিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য্যেণ অনূদিত মহাভারতে পাইনি, কাশীদাসী মহাভারতেও পানি। বারবারিকের উল্লেখ দেখতে পাই স্কন্ধপুরাণে। বিভিন্ন লোকগাথায়ও বাররবারিকের আখ্যান রয়েছে। একটি আখ্যান এমন: বারবারিকের কাছে ছিল তিনটি বাণ। প্রথম বাণ দিয়ে তিনি শত্রুপক্ষ চিহ্নিত করতে পারবেন, দ্বিতীয় বাণ দিয়ে মিত্রপক্ষকে চিহ্নিত করে রক্ষা করতে পারবেন এবং তৃতীয় বাণ দিয়ে শত্রুপক্ষকে বিনাশ করতে পারবেন। তিনটি বাণই নিজ নিজ কার্য সম্পাদন করে আবার তুণীরে ফেরত আসতে পারবে।

কিন্তু বারবারিক তার মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, যুদ্ধে তিনি দুর্বলপক্ষের হয়ে লড়বেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ তাকে বললেন, এমনও তো হতে পারে যুদ্ধের কোনো একদিন কৌরবপক্ষ দুর্বল হয়ে গেল, তখন তো প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী তোমাকে তাদের পক্ষে লড়তে হবে। তার মানে তোমার শরাঘাতে পাণ্ডবপক্ষ বিনাশ হয়ে যাবে। অতএব তোমাকে যুদ্ধে অংশ নেওয়া চলবে না। শ্রীকৃষ্ণ তাকে বধ করেন। কোনো কোনো আখ্যান মতে, বৃহত্তর স্বার্থে বারবারিক নিজেই নিজের মস্তক ছিন্ন করে কৃষ্ণপদে সমর্পণ করেন। কৃষ্ণ সেই ছিন্নমস্তক এক পর্বতশীর্ষে স্থাপন করেন। সেই ছিন্নমস্তক ছিল কৌরব-পাণ্ডব যুদ্ধের নিবিড় দ্রষ্টা। এই বিষয়ে পুরাণ বিশেষজ্ঞ ও কথাসাহিত্যিক শামিম আহমেদ ভালো বলতে পারবেন। তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম বারবারিক সম্বন্ধে। তিনি বলেছিলেন, আখ্যানটি নেপাল অঞ্চলে প্রচলিত আছে।

কেবল তুণীরে ফেরত আসা তীর নয়, শ্রীকৃষ্ণের কাছে ছিল সুদর্শন চক্র। এটি এমন এক অস্ত্র, যা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে আবার ফেরত আসে। মহাভারতে এই অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। কৃষ্ণ এই অস্ত্র দিয়ে শিশুপালকে বধ করেছিলেন, পৌণ্ড্রক বাসুদেবকে বধ করেছিলেন। রামায়ণ-মহাভারতে এমন সব অস্ত্রের কথাও রয়েছে, যেসব অস্ত্র দিয়ে একদিনে, তিনদিনে কিংবা সাতদিনে সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব। যেমন পাশুপতাস্ত্র। অর্ধাচন্দ্রাকৃতির এই অস্ত্র মন, চোখ, কথা এবং ধনুকের দ্বারা নিক্ষেপ করা যেত।

অর্থাৎ যোদ্ধা মনে মনে অস্ত্রটিকে আহ্বান করলেন, অমনি অস্ত্রটি ধনুকে এসে যাবে। যোদ্ধা চোখের ঈশারা করলেন, অমনি সেটি নিক্ষিপ্ত হবে। যোদ্ধা আদেশ করবেন, অমনি সেটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানবে। পুরাণমতে, পশুপতাস্ত্র প্রধানত শিব ও কালীর অস্ত্র। সেকালের যুদ্ধে এ অস্ত্র কেবল মহারথীরাই ব্যবহার করতেন। সাধারণ যোদ্ধাদের কাছে এই অস্ত্র থাকত না এবং সাধারণ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কোনো মহারথী এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন না বলে নিষেধাজ্ঞা ছিল। অস্ত্রটি নিক্ষেপিত হলে বিপক্ষদলের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। মহাভারতে উল্লেখ, মহাদেবের কাছ থেকে অস্ত্রটি লাভ করেছিলেন মহাবীর অর্জুন।

আরেকটি মহা অস্ত্রের নাম ব্রহ্মাস্ত্র। এটি এমন শক্তিশালী, অপ্রতিরোধ্য ও ধ্বংসাত্মক অস্ত্র যে, দুই ব্রহ্মাস্ত্রের সংঘর্ষে পৃথিবীর প্রাণ-অপ্রাণ সমস্ত কিছু ধ্বংস করা করা সক্ষম। এই অস্ত্র ব্যবহারের পর অগ্নির ভয়ানক গোলা তৈরি হয়, ভয়ানক শিখা ও অগণিত ভয়ংকর বজ্রের ঝলকানি ওঠে। গাছপালা, নদীনালা, সাগর-মহাসাগর, পশুপাখিসহ সমস্ত সৃষ্টি কাঁপতে থাকে, আকাশ বেষ্টিত হয় অগ্নিতে। হিমবাহ গলে যায়, অস্ত্রের ভয়ংকর শব্দে পর্বতগুলো ভেঙে যায়। রাবণের কাছে এই অস্ত্র ছিল। তদীয় পুত্র মেঘনাদের কাছেও ছিল। মহাভারতসহ একাধিক পুরাণে ব্রহ্মাস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়।

ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালাতে সক্ষম বলে এই অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। আর সমস্ত্র অস্ত্র ব্যর্থ হলে শুধুমাত্র অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটাতেই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করা যাবে বলে নির্দেশ ছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা এই অস্ত্রের সন্ধান করেছিলেন। প্রতিহত করতে অর্জুনও সন্ধান করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে অর্জুন, দুই ব্রহ্মাস্ত্রের সংঘর্ষে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাবে। অতএব সংযত হও সখা। কৃষ্ণের অনুরোধে অস্ত্র ফেরত নিলেন অর্জুন। কিন্তু অশ্বত্থামা জানা ছিল না এই অস্ত্র ফেরত নেওয়ার কৌশল। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে অশ্বত্থামা অস্ত্রটি নিক্ষেপ করেন অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভে।

পুরাণের আরেকটি অস্ত্র হচ্ছে ব্রহ্মশিরাস্ত্র। এটি ব্রহ্মাস্ত্রের চেয়ে চার গুণ অধিক শক্তিশালী। এ এমন এক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র, যা দেবতাদের অস্তিত্বকেও শেষ করে দিতে সক্ষম। ঋষি অগ্নিবেশ, পরশুরাম, কর্ণ, অর্জুন ও অঅশ্বত্থামা এই অস্ত্র ব্যবহার করার অধিকারী ছিলেন। তবে পরশুরামের অভিশাপে কর্ণ এই অস্ত্র সন্ধানমন্ত্র ভুলে গিয়েছিলেন। মহাভারতে উল্লেখ, যখন এই অস্ত্র আহ্বান করা হয়, তখন আগুনের বিশাল গোলক ভয়ানক শিখায় জ্বলে ওঠে, বজ্রপাতের অসংখ্য শব্দ শোনা যায়, পৃথিবীতে ফাটল শুরু হয়, নদী শুকিয়ে যায়, হাজার হাজার উল্কা পড়ে যায় এবং সমস্ত প্রাণী প্রচণ্ড আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পাহাড়, জল, গাছপালাসহ সমগ্র পৃথিবী কেঁপে ওঠে। যখন এটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে, তখন এটি ধ্বংস হয়ে যাবে এবং পতিত স্থানে কিছুই জন্মাবে না, এমনকি পরবর্তী পঞ্চাশ ব্রহ্ম বছর (১৫৫.৫ ট্রিলিয়ন মানব বছর) পর্যন্ত ঘাসও গজাবে না।

অপরদিকে, নারায়ণী অস্ত্র স্বয়ং শ্রীবিষ্ণুর নামে নামাঙ্কিত। যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে বিষ্ণুর কাছ থেকে এই অস্ত্র লাভ করা সম্ভব ছিল। মহাভারতে উল্লেখ আছে অস্ত্রটির কথা। যে যোদ্ধা নারায়ণী অস্ত্র লাভ করতে পারত, সে সারা জীবনে মাত্র একবারই অস্ত্রটি প্রয়োগ করতে পারত। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে ব্রহ্মানন্দ অস্ত্রের কথাও। এই অস্ত্র গোটা বিশ্ব ধ্বংস করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। আরেকটি অস্ত্র হচ্ছে ভার্গভ অস্ত্র। ব্রহ্মশিরাস্ত্রের মতো সমান ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা রাখে ভার্গভ অস্ত্র। পুরাণ অনুসারে, এই অস্ত্র ব্যবহার করা হলে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এমনভাবে ধ্বংস হবে যে ছাই পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে না। ব্রহ্মাস্ত্র ও ব্রহ্মশিরাস্ত্রকে নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে ভার্গভ অস্ত্র। এ ছাড়াও মহাভারতে আগ্নেয়াস্ত্র, নাগাস্ত্র এবং বরুণাস্ত্রের উল্লেখ দেখা যায়।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে ব্যাসদেব এলেন হস্তিনাপুর প্রাসাদে। সঞ্জয়কে দিলেন এমন এক দিব্যদৃষ্টি, যা দিয়ে তিনি হস্তিনাপুরে বসে কুরুক্ষেত্রের সব দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলেন। দেখে দেখে ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। সেই দিব্যদৃষ্টি আজকের স্কাইপি, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার—যা দিয়ে আমরা বাংলাদেশে বসে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারি, মানুষটিকে দেখতে পারি।

ব্রহ্মাস্ত্র মনে করিয়ে দেয় বর্তমানের পরমাণু বোমার কথা। ব্রহ্মশিরাস্ত্র মনে করিয়ে দেয় হাইড্রোজেন কিংবা থার্মোনিউক্লিয়ার হাইড্রোজেন কিংবা পারমাণবিক বোমার কথা। নারায়ণী অস্ত্র মনে করিয়ে দেয় বর্তমানের মিসাইল অস্ত্রের কথা। সে যুগে এমন অস্ত্র ছিল কিনা, এই তর্ক বৃথা। কেননা পুরাণকে কখনো যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না। হয়ত পৃথিবীতে এমন এক যুগ ছিল, যে যুগে বর্তমান পৃথিবীর চেয়েও ভয়াবহ সব মারণাস্ত্র ছিল। সেসব অস্ত্রের কথা মুখে মুখে বাহিত হয়ে বাল্মিকীর কাব্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে, ব্যাসদেবের কাব্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

কিংবা, না, কোনো যুগে এমন কোনো মারণাস্ত্র ছিল না। এ স্রেফ বাল্মিকীর কল্পনা, ব্যাসদেবের কল্পনা। বিস্মিত হই তাদের কল্পনার দৌড় দেখে, তাদের কল্পনাশক্তি দেখে। সেই কত হাজার বছর আগে তারা এমন এক অস্ত্র কল্পনা করেছিলেন, যা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে আবার ফেরত আসে। সেই অস্ত্র মানুষ এখন তৈরি করেছে। তারা কল্পনা করেছিলেন এমন এক অস্ত্র, যা দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস করা সম্ভব, গোটা পৃথিবী ধ্বংস করা সম্ভব। সেই অস্ত্র তৈরিও মানুষ আজ সম্ভব করে তুলেছে—পারমাণবিক বোমা। তারা কল্পনা করেছিলেন এমন এক যন্ত্র, যা দিয়ে হস্তিনাপুরে বসে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দেখা যায়। এখানেই কবি-সাহিত্যিকের শক্তি। এই কারণেই কবি-সাহিত্যিকরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তারা মানুষের সর্বোচ্চ সাধ্যসীমাকে কল্পনা করে নিতে পারেন।

কথাশিল্পী অমিয়ভূষণ মজুমদার এক সাক্ষাৎকারে শেক্সপীয়রকে আধুনিক নাট্যকার বলেছিলেন। বলেছিলেন, সফোক্লেস বিশ শতকের শেষে এসেও আধুনিক। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসও আধুনিক কবি। বলেছিলেন, অর্জুন, ভীম, ভীষ্ম, দ্রোণাচার্যা—এদের কাছে এমন অস্ত্র ছিল (কবির কল্পনায়) যা দিয়ে সাত দিনে, তিন দিনে, একদিনে পৃথিবী ধ্বংস করা যেত। ভীষ্ম নিজে প্রাণ দিলেন, অথচ সেই অস্ত্র ব্যবহার করলেন না। জয়দ্রথ-বথে নিজেকে নিধন করতে হবে জেনেও অর্জুন চক্রব্যূহ ধ্বংস করতে তার পাশুপতাস্ত্র ব্যবহার করেননি। ব্যক্তির নিজের মতের চাইতেও মানবকল্যাণ বড়—এই কল্পনা কবি ব্যাস করেছিলেন। আর আমরা মাত্র কয়েক মেগাটনের মালিক হয়ে এখন পর্যন্ত পৃথিবীকে পারমাণবিক বোমার ভয় থেকে আশ্বস্ত করতে পারিনি। এই জন্য ব্যাসদেবকে রেগান বা আন্দ্রোপভ থেকে আমরা অনেক বেশি আধুনিক বলতে পারি।

১৮.১০.২০২৩