কবিতার ব্যাপারে রাসূলের (সা.) দৃষ্টিভঙ্গি

ড. আব্দুস সালাম আজাদী

প্রকাশিত : মে ০৩, ২০২১

আমাদের নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবি ছিলেন না, কবিতা তার পেশা ছিল না, কিন্তু তিনি কবিতাকে পছন্দ করতেন। তিনি বলেছিলেন, কবিতা মানুষের কাছে তেমন গতিতে যায়, বর্শা যেমন গতিতে যায়।

আবার আরেক জায়গায় তিনি বলেছিলেন, কোনো কোনো কবিতার মধ্যে জাদু আছে। অর্থাৎ, আমাদের লেখাগুলো যেন প্রজ্ঞাপূর্ণ হয়। এটাই তো হওয়া উচিত ছিল। মানুষ যাতে আমাদের লেখাগুলো পড়ে হো-হো করে হাসতে পারে, কাঁদতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর এই হাদিসে এটাই বুঝিয়েছিলেন।

কবিতা কিভাবে হবে, তিনি এটাই শুধু বুঝাননি, যারা ভালো-ভালো কবিতা লিখতো, তাদের কবিতার কদরও করতেন। কবিতা শুনতেন। একবার তিনি একটি সফরে ছিলেন। তাঁর এক সাহাবিকে তিনি বলেন, উমাইয়্যা ইবনে আবিস সালাতের কিছু কবিতা শুনাতে। উমাইয়্যা ছিলো কাফের কবি। সাহাবি এক পঙক্তি বলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে আরো কবিতা বলতে বলেন। এভাবে ওই সাহাবি তাঁকে উমাইয়্যা ইবনে আবিস সালাতের একশোটি কবিতার পঙক্তি শুনান।

এরপরর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মন্তব্য করেন, উমাইয়্যা ইসলাম গ্রহণ করেনি, কিন্তু তার কবিতা ইসলাম গ্রহণ করেছে।

এটা একটি যুগান্তকারী কথা। এটার মানে হলো, আমাদের নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন অমুসলিম কবির কবিতাকে গ্রহণ করেছেন, তার কবিতার প্রশংসা করেছেন। লোকটি অমুসলিম, কিন্তু তার কবিতা তো ভালো। অর্থাৎ, কবিতা গ্রহণের জন্য শুধুমাত্র মুসলিম হতে হবে, এটা কোনো শর্ত না। অমুসলিম কবিদেরও ভালো-ভালো কবিতা আমরা গ্রহণ করতে পারি। তবে, সেই কবিতাগুলো হতে হবে ইসলামের প্রতিচ্ছবি।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাঝেমধ্যে কবি লাবিদের কবিতাকে উদ্ধৃতি দিতেন, বিভিন্ন জায়গায় তার কবিতার লাইন তুলে ধরতেন। লাবিদের কবিতার একটি লাইন ছিল, আলা কুল্লা সাইয়্যিং মা খালাল্লাহু বাথীল। অর্থাৎ, সাবধান, আল্লাহ ছাড়া সকল জিনিসই বাতিল এবং অসার। কবিতার এই লাইন সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, এটা হলো কোনো কবির সবচেয়ে সঠিক বাক্য।

রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো কবিতা ভালো লাগলে সেটার প্রশংসা করতেন। সাহাবি কাব ইবনে যুহাইরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ‘বানাত সু’আদ’ কবিতাটি শুনে এতটাই আপ্লুত হন যে, নিজের চাদরটি কবিকে দিয়ে দেন। ফলে কবিতাটির নাম হয়ে যায় ‘কাসীদাতুল বুরদা’।

আবার, কবিতার কোনো বক্তব্য যদি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হতো কিংবা অর্থপূর্ণ না হতো, তখন তিনি সংশোধন করে দিতেন। কবি কাব ইবনে যুহাইরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) একটি কবিতায় তাকে ‘হিন্দুস্তানের তরবারি’ বলে সম্বোধন করলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংশোধন করে দিয়ে বললেন, বলো ‘আল্লাহর তরবারি’।

আরেকদিন শুনতে পেলেন কবি আন-নাবিগা আল-জা’দী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলছেন, আমাদের মর্যাদা এত দূরে গেছে, আসমান ছুঁয়ে গেছে। আমরা তারও দূরে যেতে চাই। এটা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আরো দূরে? আরো দূরে কোথায় যেতে চাও? কবি আন-নাবিগা আল-জা’দী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমরা জান্নাতে যেতে চাই।

কবিতার ভিশন নিয়ে আমাদেরকে এভাবে দূরে যেতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে। কল্পনার জগতে অনেক দূরে পাখা মেলতে হবে। কবিতার শব্দে এমন কিছু নিয়ে আসতে হবে যে, মানুষ পড়লে মুগ্ধ হয়। তন্ময় হয়ে যেনো চিন্তা করে। বর্শার মতো যেন কবিতা তার হৃদয়ে বিদ্ধ হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবি ইমরাউল কায়সের কবিতা শুনতেন। তিনি ছিলেন জাহেলী আরবের ‘কবিগুরু’। রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইমরাউল কায়স সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ভালো কবি বটে, তবে তার কবিতায় অশ্লীলতা আছে। সে হবে জাহান্নামী কবিদের সর্দার।

আমাদের নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবিতার সমালোচক এবং বোদ্ধা ছিলেন। তিনি কনটেন্টকে সামনে নিয়ে আসতেন। কবিতায় কী বলা হয়েছে এটাই মূল উদ্দেশ্য। এভাবে আমাদের নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবিতাকে পরিশীলিত করলেন। বহুধারায় কবিতা লেখা হোক এটা তিনি চাইলেন। তাঁর সাহিত্য সংস্কৃতির দিকটি যদি আমরা বুঝতাম, তাহলে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বোধ আরো ভালো হতো।

ড. আব্দুস সালাম আজাদীর বক্তব্য অবলম্বনে আরিফুল ইসলাম