কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ৭

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ২৮, ২০২১

কলকাতার চড়ক পূজা বা চড়ক উৎসব সম্পর্কে ফ্যানি পার্কস নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। কালীঘাটে মন্দির ও জাগ্রত কালী দর্শন করতে যেতে হবে। পথে এক দৃশ্য দেখা গেল, উৎসবের দৃশ্য, অবিস্মরণীয়। দেখা গেল হাজার হাজার লোক রাস্তায় ভীড় করে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলে জানা গেল চড়ক পূজার উৎসব চলছে। দীর্ঘ এক কাষ্ঠদণ্ডের মাথায় হুক বিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাওয়া চড়কপূজার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন রকম লোক কতো যে বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে তার ঠিক নেই। স্বচক্ষে সেখানে দেখা গেল বৈরাগী সাধুদের। সর্বাঙ্গে ভস্মমাখা, মাথায় লম্বা লম্বা জটা, পরনে একটুকরো কাপড় জড়ানো, প্রায় নগ্ন বলা চলে। সেখানে একদল নীচু জাতের হিন্দু নিজের বাহুর এফোঁড়-ওফোঁড় ছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে বাঁশের কাঠি ও লৌহশলাকা পুরে ঢোলের বাজনার তালে তালে তাণ্ডব নৃত্য করছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ লৌহশলাকা দিয়ে জিব ফুঁড়ে বাহাদুরি দেখাচ্ছিল।

কয়েকগজ দূরে তিনটি বড় বড় কাঠের খুঁটি মাটিতে পোতা ছিল। প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা এক একটা খুঁটি, তার মাথায় আড়ে একটি বা দুটি বাঁশ বাঁধা। বাঁশটিকে ঘুরানোর ব্যবস্থা আছে। তার একদিকে এক লোক ঝুলে রয়েছে, আর একদিকের লম্বা দড়ি ধরে নিচের লোকজন খুঁটির চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং উপরে ঝুলন্ত লোকটিও তার ফলে ঘুরছে বন বন করে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, উপরের লোকটি হুকবিদ্ধ হয়ে ঝুলছে আর ঘুরছে এবং তার বুকে ও পিঠে সেই হুকগুলি বিঁধে রয়েছে। এই ধরনের উৎসবে দুর্ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। চড়ক পূজায় শতকরা তিন চারজন লোক মারাও যায়।

রামমোহন রায়ের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন ফ্যানি পার্কস। তিনি তার বর্ণনা দিয়েছেন। সেদিন এক ধনী সম্ভ্রান্ত বাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম, বাবুর নাম রামমোহন রায়। বেশ বড় চৌহদ্দির মধ্যে তাঁর বাড়ি, ভোজের দিন নানাবর্ণের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। চমৎকার আতশবাজির খেলাও হয়েছিল, আলোয় আলোকিত হয়েছিল তাঁর পুরো বাড়ি। বাড়িতে বড় বড় ঘর ছিল এবং একাধিক ঘরে বাঈজী ও নর্তকীদের নাচগান হচ্ছিল। বাঈজীদের পরনে ছিল ঘাঘরা, শাদা ও রঙিন মসলিন ফ্রিক দেওয়া, তার উপরে সোনারূপার জরির কাজ। সাটিনের ঢিলে পাজামা দিয়ে পা পর্যন্ত ঢাকা। দেখতে অপূর্ব সুন্দরী, পোশাকে ও অলোয় আরো সুন্দর দেখাচ্ছিল। গায়েতে অলঙ্কারও ছিল নানারকমের। নাচের সময় মুখের, গ্রীবার ও চোখের ভাবপ্রকাশের তীর্যক ভঙ্গিমা এত মাদকতাপূর্ণ মনে হচ্ছিল যে তা বর্ণনা করা কঠিন। নর্তকীদের সঙ্গে একদল বাজিয়ে ছিল, সারেঙ্গী মৃদঙ্গ তবলা ইত্যাদি নানারকম বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল তারা। গানের সুর ও ভঙ্গি অন্যরকম, যা আমরা কখনো শুনিনি। বাঈজীদের মধ্যে একজনের নাম নিকী, শুনেছি সারা প্রাচ্যের বাইজীদের মহারানী সে, এবং তার নাচগান শুনতে পাওয়া রীতিমত। বাঈজীদের নাচগান শোনার পর রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। বাড়ির ভিতরে সুন্দর ও মূল্যবান আসবাবপত্র সাজানো এবং সবই ইউরোপীয়। ইউরোপীয় স্টাইলেই হলো সবকিছু, কেবল বাড়ির মালিক হলেন বাঙালীবাবু।

ফ্যানি পার্কস ‘সতীদাহ’ সম্পর্কে লিখেছেন তার ভ্রমণবৃত্তান্তে। আমাদের বাড়ির কাছে একজন ধনী বেনিয়া বাস করতো। একদিন শুনলাম সে মারা গেছে। সকালে উঠে দেখি বাজারে খুব ভীড় হয়েছে, লোকজন হল্লা করছে। টমটম, ঢাকঢোল, ড্রাম,  বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি মহানন্দে বাজানো হচ্ছে। খোঁজ করে জানা গেল মৃত বেনের স্ত্রী সহমরণে যাবার সংকল্প করেছে। সতী হবে, সতী হবে একটা সোরগোল পড়ে গেল। তারই জন্য এত আনন্দ। স্থানীয় হাকিম মহিলাকে আদালতে ডেকে পাঠিয়ে যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে সহমরণে কোনো লাভ নেই। কিন্তু হাকিমের যুক্তিতে কাজ হলো না, রমণীর সংকল্প অটল রইল। বরং রমনী বললো, ‘হুজুর যদি আপনি আমাকে সতী হতে বাধা দেন তাহলে আমি আদালতেই আপনার সামনে গলায় দড়ি দিয়ে মরবো।’ নিবারণের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে হাকিম সাহেব হতাশ হলেন। পরদিন সতীদাহ দেখার জন্য গঙ্গার ঘাটে লোকের ভীড় হলো খুব। নদী তীরে চিতা সাজানো হলো, তার উপরে সেই বাসী মৃতদেহও চাপিয়ে দেয়া হলো। হাকিম চারদিকে পাহারা বসিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন যাতে কোনো লোক জ্বলন্ত চিতার দিকে না যেতে পারে। হাকিম সাহেবের সঙ্গে আমার স্বামীও ছিলেন।

গঙ্গাস্নান করে বেনের বিধবা স্ত্রী একটি কাঠিতে আগুন ধরিয়ে নিল, স্বামীর চিতার চারপাশে ঘুরে বেড়ালো তাই নিয়ে এবং শেষে চিতায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে তার উপরে হাসিমুখে উঠে বসলো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো চিতায়, সে তার স্বামীর মাথাটি কোলের উপর তুলে নিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল আগুনের মধ্যে। মুখে কয়েকবার উচ্চারণ করলো, ‘রাম রাম সত্য, রাম রাম সত্য’। বাতাস লেগে আগুন যখন শিখা বিস্তার করে ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো তখন সতী রমণী হাত-পা ছুঁড়ে যন্ত্রণায় চীৎকার করতে আরম্ভ করলো, চেষ্টা করলো চিতার উপর থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পাশে যে একজন হিন্দু পুলিশ দাঁড়িয়েছিল তার উপর অত্যাচার না হয় দেখার জন্য, শেষ পর্যন্ত সেই-ই তাকে লাঠি তুলে মারতে উদ্যত হলো। ভয়ে শিউরে উঠে সতী আবার এগিয়ে গেল চিতার দিকে। তাই দেখে হাকিম হিন্দু পুলিশটিকে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠিয়ে দিল। সতী চিতার দিকে একটু এগিয়েই লাফ দিয়ে দৌড়ে পালালো এবং ছুটতে ছুটতে গিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। সমবেত জনতা এবং মৃত বেনের আত্মীয়রা একযোগে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘ধরে আন হতভাগীকে, মেরে ফেল, কেটে ফেল, বাঁশের বাড়ি দে মাথায়, হাত-পা বেঁধে চিতায় ফেলে দে।’ হাকিম ও পুলিশ তাদের তাড়া করে বিদায় করে দিল।
সতী রমণী এবার শান্ত হয়ে খানিকটা পানি পান করলো এবং তার লাল কাপড়ের আগুনও নিভিয়ে ফেলা হলো। পরক্ষণেই সে বললো, চিতায় তাকে উঠতেই হবে, সতী হতেই হবে, তা ছাড়া গতি নেই। হাকিম ধীরে ধীরে তার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘শাস্ত্রমতে আর তোমার সতী হওয়া চলবে না মা। আমি জানি একবার চিতায় উঠে বের হয়ে গেলে আর তাতে উঠা যায় না। কাজেই আর তোমাকে আইনত আমি সতী হতে দিতে পারি না। জানি আজ থেকে তোমাকে হিন্দু সমাজে একঘরে হয়ে বিনা দোষে কলঙ্কিত জীবন কাটাতে হবে। কিন্তু তার জন্য তোমার একটুও চিন্তা করতে হবে না। সরকার তোমার দায়িত্ব নেবেন, তোমার খোরাাকপোশাকের অভাব হবে না। হাকিম স্ত্রীলোকটিকে পাহারা দিয়ে পালকিতে করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। জনতা অবজ্ঞায় মুখ ঘুরিয়ে পালকির পথ ছেড়ে দূরে সরে গেল। ভাবখানা যে, এরকম অপবিত্র আর অ-সত্য রমণীর মুখদর্শন করাও পাপ। চলবে