কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ৮

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ২৯, ২০২১

বাস্তবিকই যদি হাকিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকতেন, তাহলে উপস্থিত জনতা মেরে কেটে যেভাবে হোক রমণীটিকে মৃত-স্বামীর সঙ্গে দাহ করতো। মহিলাটি চিতায় উঠবার আগে বলেছিল, ‘এর আগে আমি ছ’বার জন্মগ্রহণ করেছি এবং ছ’বার মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণে সতী হয়েছি। যদি সপ্তমবার সতী না হই তাহলে আমার মতো হতভাগী আর কে আছে।’ ফ্যানি পার্কসের বর্ণনা এখানে অসাধারণ। মহিলাটির মনে কী রকম অন্ধবিশ্বাস! সতীদাহর আসলে মূল কারণ, স্বামীর সঙ্গে ধর্মের নামে স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারতে পারলে সম্পত্তি নিষ্কন্টক হয়। সতীদাহ বন্ধ হয়েছে ১৯২৯ সালে। ১৯২৮ সালেও কলকাতায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে তিনশো আটটি মেয়েকে। সতীদাহ কলকাতায় তখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। সারা ব্ল্যাক টাউন চিতার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চলছে বাবু বিলাস।

নারীদের দুর্দিনের কথা ভাবলে সকলের মন খারাপ হয় যায় এখনো। রামমোহন আর বিদ্যাসাগর প্রমুখ ভদ্রঘরের নারীদের মুক্তির জন্য কতটা স্বার্থ ত্যাগ করেছিলেন আর কতটা ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিলেন আজকের দিনে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করা সেভাবে সম্ভব নয়। বিধবা বিবাহের দায়িত্ব নিয়ে বিরাট এক উপকার করেছিলেন বিদ্যাসাগর ভদ্রঘরের হিন্দু নারীদের।  

বিশ্বনাথ জোয়ারদার জানাচ্ছেন, ‘ঘরে ঘরে তখন বিধবা ছিল। খুব কম বাড়িই ছিল যে বাড়িতে একজন বিধবা ছিল না। অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে অনেকেই বিধবা হয়ে যেতো। ছয় থেকে আট দশ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়ে দু-এক বছরের মধ্যেই বিধবা হয়ে ‘কড়ে রাঁড়ি’ হওয়া আখ্ছার ঘটতো। এদিকে যৌবন তো সধবা দেখে আসে না। ভাই বা বাবার সংসারে বিনা পয়সার ঝির মতো খেটেও, এক বেলা আহার; তাও ভালো মন্দ ভাগ্যে জুটতো না; তবুও একদিন যৌবন এসে শরীরটাকে পাল্টিয়ে দিয়ে পুরুষের চোখে নেশা ধরিয়ে দিত।’

তাই নিজের নিকট আত্মীয়দের বা লম্পট পুরুষদের ক্রমাগত চেষ্টায় একদিন তাকে আত্মসমর্পণ করতে হতো। কখনো তার নিজের শরীরের ভিতরেই স্বাভাবিকভাবে চাহিদা তৈরি হয়ে যেত। প্রকৃতির চাপ চাইলেই কি এড়ানো যায়! যার ফল স্বরূপ অন্তঃসত্তা হওয়া এবং সেই সঙ্গে ঘটতো ভ্রুণ হত্যা। সম্ভ্রান্ত পরিবার এরকম ঘটনায় কখনো লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য পিতামাতাই মেয়েটিকে মরে যেতে বা আত্মহত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করতো। কখনো পরিবারের চাপে গোপনে তার আশ্রয় হতো আর বাড়িতে নয়, পূর্বের আলোচিত সেই বেশ্যাপল্লীতে।

কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশ্যাপল্লীর অনেকেই এভাবে সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে চলে আসা বিধবা নারীর দল। তাদের সংখ্যা ছিল বিরাট। গোলাম মুরশিদের নাটক সংক্রান্ত একটি গবেষণা গ্রন্থে এ নিয়ে অনেক তথ্য রয়েছে। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় খ্রিস্টান হলে দ্বারকানাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, ধর্মান্তরের মূল কারণ হলো ‘বীফ আর ব্রাণ্ডি’ যা প্রথম পর্বেই লক্ষ্য করা গেছে। শিবনাথ শাস্ত্রীর গ্রন্থে দেখা যায় নব্যবঙ্গের তিন প্রধান দীক্ষাগুরু; প্রথম দীক্ষা গুরু রামমোহন রায়, দ্বিতীয় দীক্ষাগুরু ডিরোজিও এবং তৃতীয় দীক্ষাগুরু মেকলে। তিন জনই এই ধুয়া তুলেছিলেন; প্রাচীতে যা কিছু তার সব হেয়, এবং প্রতীচীতে যা কিছু আছে তাই সর্বোৎকৃষ্ট। এই অতিরিক্ত পাশ্চাত্যের পক্ষপাতিত্বের জন্য নিষিদ্ধ খাদ্য আর মদ খাওয়া শুরু হয়েছিল বাঙালীদের মধ্যে।

বিশ্বনাথ জোয়ারদার মন্তব্য করছেন, ‘প্রাচীনপন্থীরা অনেকেই মনে করত নিষিদ্ধ খাদ্য এবং নিষিদ্ধ পানীয় প্রচলনের জন্য রামমোহন, রামগোপাল, কেশব সেন এবং বিলেত ফেরত বাবুরা দায়ী। এদের জন্য ‘হিঁন্দুয়ানী’ ডুবেছিল। রাজনারায়ণ বসু নিজেদের সম্পর্কেই লিখেছেন, ইংরেজি শিক্ষার ফলে অবস্থা এমন হলো যে, বাঙ্গালা সম্বাদপত্র বা পুস্তক পড়তে ভালো লাগত না, কেবল ইংরেজি পুস্তক আর সম্বাদপত্র পড়তেই ভালোলাগতো। ইংরেজি ঔষধ ভালো, বাঙ্গালা ঔষধ মন্দ; ইংরেজি খাদ্য ভালো,  বাঙ্গালা খাদ্য মন্দ; ইংরেজি পাদ্রী ভালো, বাঙ্গালা পাদ্রী মন্দ; ইংরেজি বাইবেল ভালো, হিন্দু শাস্ত্র মন্দ; ইংরেজি সব ভালো, দেশীয় সব মন্দ। ডাফ সাহেবের প্ররোচনায় বাঙালী খ্রিস্টান হতে আরম্ভ করলো। বাঙালী বিলাত যাত্রা শুরু করলো।

ইতিপূর্বেই কালীপ্রসাদ হেঙ্গাম এবং ইয়ং বেঙ্গলদের মদ খাওয়া, পাঁউরুটি-বিস্কুট-গোমাংস-মুরগী খাওয়া হিন্দু সমাজে এক পরিবর্তন আনে। ইয়ং বেঙ্গলদের অন্যতম নেতা রাধানাথ সিকদার বলতেন, ‘প্রত্যেক এ বেলা অর্দ্ধসের আর ও বেলা অর্দ্ধসের গোমাংস ভক্ষণ না করলে বাঙালী জাতি কখনোই বলিষ্ঠ হবে না। নিজে তিনি তাই করতেন। সেসময়ের নতুন হিন্দু বাঙালী সাহেবদের গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে নানারকম গল্প আছে। রাজনারায়ণ বসুও এ ব্যাপারে লিখেছেন। দুই বাঙালী বাবু একবার উইলসন হোটেলে আহার করতে গেছেন। এক বাবুর গরু ভিন্ন চলে না। তিনি খানসামাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভীল বা বাছুরের মাংস হ্যায়? খানসামা উত্তর দিল, নহি হ্যায় খোদাবন্দ। বাবু পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, বীফস্টেক হ্যায়? খানসামা উত্তর দিল, ওভি নহি হ্যায় খোদাবন্দ। বাবু পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, অক্সটাং বা গরুর জিব হ্যায়? খানসামা উত্তর করলো, ওভি নহি হ্যায় খোদাবন্দ। বাবু পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, কাফ্স ফুট জেলি হ্যায়? খানসামা বললো, ওভি নহি হ্যায় খোদাবন্দ। বাবু তখন জানতে চাইলেন, গরুর কুচ হ্যায় নহি? দ্বিতীয় বাবু যিনি এত গোমাংস প্রিয় ছিলেন না, তিনি খানসামাকে বললেন, কিছু না থাকে তো খানিকটা গোবর এনে দে।

যারা ইংরেজি জানতেন না, এমন অনেকেও গরুর মাংস খাওয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে ছিলেন না। বলতে গেলে তখন ফুটানি করে কে না মদ খায়, আর কে না উইলসন হোটেলে যায়! বাঙালী বাবুরা তখন দাবি করতে পারতেন, মদ্যপানে তারা ইংরেজদের সমকক্ষ। রাজনারায়ণ বসুর লেখা থেকেই জানা যায়, উনিশ শতকের প্রথম দিকের বাবুরা তখন বেলা দুপুরের পর ঘুম থেকে উঠতেন। আহ্নিকের আড়ম্বরটাও বড় ছিল, দুতিন ঘণ্টার কমে আহ্নিক শেষ হতো না; তেলমাখতেও ঝাড়া চার ঘণ্টা লাগতো। চাকরের তেল মাখানীর শব্দে ভূমিকম্প হতো। বাবু উলঙ্গ হয়ে তেল মাখতে বসতেন, সেই সময়ে বিষয়কর্ম দেখতেন, কাগজপত্রে স্বাক্ষর করা বা সীলমোহর দেয়া চলতো। এঁদের মধ্যে অনেক জমিদার রাত্তির দুটা পর্যন্ত কাছারি করতেন। কলকাতার কোনো কোনো বাবু সারাদিন ঘুমাতেন, সন্ধ্যার পর উঠে কাজকর্ম দেখতেন। তাদের কাছে দিনই রাত ছিল, রাতই দিন হয়ে দাঁড়ালো।  

বাবুরা অনেকেই ইংরেজি জানতেন না। কিন্তু পাঁচ ইয়ারের সঙ্গে মিলে ইংরেজি ধরনে চলতেন। সাহেবদের মতো চেয়ারে বসে মজলিস করা, কাচের বা চিনামাটির পেয়ালায় করে চা খাওয়া, জগে এবং কাচের গ্লাসে করে জল খাওয়া; সকলই ইংরেজি কেতার সাজসরঞ্জাম। ইংরেজি জানেন না কিন্তু ঘরে ইংরেজি বই ঠাসা ছিল, ইংরেজি বহু রকমের টাট্কা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে নাড়তেন চাড়তেন। কারণ শাসক ইংরেজদের ভাষার সঙ্গে, তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই, বাবুদের কাছে সেটা বিরাট লজ্জার। যতই দান ধ্যান করুক কিংবা দুর্গাপূজায় বল্গাহীন খরচ করুক বা রক্ষিতাকে বাড়ি করে দিক আর বেড়ালের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করুক, তাতে বাবুগিরি হবে না। বাবুগিরি হবে না যদি না মোসাহেব থাকে। বাবু আছেন মোসাহেব নেই, তা একেবারেই অসম্ভব। যদি তারা না থাকে, বাবুকে কে তোষামদ করবে? ফলে বাবু আছেন মানেই মোসাহেব আছেন।

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, বাবুদের কাছে কতকগুলিন লোক নিয়মিত আসা যাওয়া করে। প্রতিদিন প্রাতঃকালে যায়, বেলা দশ এগারো ঘণ্টা বসে থাকে। কেউ বিকালে যায় আর রাত্রি দু প্রহর পর্যন্ত সেখানে কালযাপন করে। বাবুরা হাই তুললে তুড়ি দেয় এবং আজ্ঞা যে আজ্ঞা মহাশয় করে। বাবু তাদের সঙ্গে নিয়ে স্থান বিশেষে গমন করেন, সবাই তাদেরকে বলে এ অমুক সাহেবের মোসাহেব। পয়সা দিয়ে মোসাহেব পুষতো অনেক বাবু। মোসাহেবী ব্যাপারাটাই আলাদা, বহু গুণের দরকার হয়। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা মোসাহেবী করতে এসে এক অক্ষর সংস্কৃত পড়েনি এমন বাবুদের কাছে শাস্ত্রের তাৎপর্য শুনে, বাবুদের জোর গলায় সাধুবাদ করতেন। নইলে পেটে যে দানাপানি পড়বে না। সুতরাং বাবুর শাস্ত্রজ্ঞানের প্রশংসা না করে উপায় আছে।

বাবুরা দরকার হলে টাকা খরচ করে প্রশংসা শুনতে চাইতেন। ফলে শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণদের কেউ দশ টাকা দিলে, তিনি কুড়ি টাকা দেন। ব্রাহ্মণদের মুখে তখন বাবুর গুণকীর্ত্তন শুরু হয়ে যেতো। দীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা অনেক শ্রম করে বিদ্যা উপার্জন করেছেন, বাবুলোকের কাছে দুবেলা গিয়ে আশীর্বাদ করে আসেন। এসব পণ্ডিতদের কেউ কেউ আবার বাবুদের সভাপণ্ডিত পদ লাভ করেন। বাবুদের মন রাখতে বাবুরা যেমনটি চাইতেন, তেমন বিধান দিতেন। চুনিলাল মিত্রের ‘কলকাতার নুকোচুরি’ রচনায় দেখা যায়, পামরবাবুকে তাঁর ব্রাহ্মণ সভাপণ্ডিত গোপালরাম চূড়ামণি, পরস্ত্রী গমনের পক্ষেই বিধান দিচ্ছেন। ‘মহাশয়! কি বলেন? পরস্ত্রী গমনে যদ্যাপি পাতক হতো তাহা হইলে ভগবান যশোদানন্দন আর ষোড়শ ব্রজগোপীনির সহিত লীলা কত্তেন না? দেবাদিদেব মহাদেবও কুচনী ক্রীড়ায় রত হতেন না। এ সামান্য বিষয়ে আপনি জিজ্ঞাসা কেন কচ্চেন? এ বিষয়ে কিছু মাত্র পাপ কি নুকোচুরি নাই। আজ কালতো আপামর সাধারণে এ কাজ কোচ্চে।’

ব্রাহ্মণরা সভাসদরা এভাবেই বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ঠিক ধর্মীয় বিধানের উল্টোসুরে গীত গাইতেন। বাবুদের জন্য নতুন বিধান তৈরি করে দিতেন। বাবুরা অনেকেই প্রশংসা শুনতে পছন্দ করতেন। কী মুর্খ কী পণ্ডিত সকল মোসাহেবের এক রা, বাবুকে সুযোগ পেলেই বলতেন ‘মহাশয়ের তুলনায় গুণবান এবং গুণবোদ্ধা আর তো দেখি না’। ইত্যাদি কথার জালে বাবু খুবই প্রসন্ন তখন। বাবু তাদের তোয়াজপূর্ণ কথাতেই সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি নিজে বিরাট বিদ্বান-ধনবান-রূপবান আর গুণবান। কিছু মোসাহেব থাকতো যারা মিথ্যা গল্প করতে এবং অন্যের কুৎসা করতে বিলক্ষণ নিপুণ ছিলেন। সময় মতো বাবুর সামনে দরকার মতো তাই করতেন। বাবু প্রতিপক্ষের কুৎসা শুনে খুব তৃপ্তি পেতেন। চলবে