কাউসার পলাশের ভ্রমণগদ্য ‘শাদা পাহাড় অভিযান’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : জুন ০৯, ২০২২

২০২২ সালের ৮ মে সকাল সকাল সবাই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে ট্রেকিংয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। এরই মধ্যে একটা প্রব্লেম দেখা দিলো। টিমের প্রান্ত ভাই অসুস্থ বোধ করছিলেন। ফলে তিনি যাবেন না বলে আমাদেরকে জানিয়ে দিলেন। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই তাকে রেখে যেতে আগ্রহী ছিলাম না। সবাই মিলে তাকে মোটিভেশনাল বাক্য প্রয়োগ দ্বারা মানসিক শক্তি দিতে চেষ্টা করতে লাগলাম। গাইড রানা ভাই বারবার আমাদেরকে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে তাগাদা দিচ্ছিলেন। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত সকল মালামাল গাড়িতে উঠিয়ে গাড়ি প্রস্তুত হয়ে গেল।

অনেক বুঝানোর পরে প্রান্ত ভাই যেতে রাজি হলেন। অবশেষে আমাদের পুরো টিম গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িতে অনেক মালামাল ওঠানোয় আমাদেরকে কোনো রকম কষ্ট করে গাড়ির ছাদে গিয়ে বসতে হলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমরা ছাড়া ওই গাড়িতে অন্যান্য টিমের কয়েকজন ট্রেকার ছিল। কে কোথায় যাবে এবং তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার কিছু গল্প শুরু হয়ে গেল। আমি গাড়ির ছাদে বসে চারদিকের সৌন্দর্য মোবাইলে বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। গাড়ি এমন এক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল যা দেখে ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। মনে হচ্ছিল যেন এক ঝুলন্ত পাথর কাটা আঁকাবাঁকা রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার যদি কিঞ্চিৎ ভুল করে, তাহলে আর কারো বেঁচে থাকার আশা করা বোকামি।

এইভাবে প্রায় ৫০ মিনিট যাওয়ার পরে গাড়ি ছোট একটা গ্রামে এসে থামলো। আমরা গাড়ি থেকে নেমে যার যার ব্যাগ নিয়ে দলীয় কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। তারপর আমাদের গাইড রানা ভাই আমাদেরকে কোন পথে কিভাবে যেতে হবে অল্প কথায় আমাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন। আমরা সবাই সেই গ্রাম থেকে হাঁটা শুরু করে দিলাম। শুরুতে কিছুটা নিচের দিকে নামলাম। তারপর নেমে একটা নদীর পাশঘেঁষে হাঁটা শুরু করলাম। ট্রেইলে নেমেই দেখলাম অনেক ট্রেকারদের যাতায়াত এখানে। কেউ সামনে থেকে শেষ করে আসছে, কেউ যাচ্ছে। তবে অধিকাংশই যাচ্ছে। প্রায় দুশো জন হবে যারা এই গ্রাম থেকে হাঁটা শুরু করছে। এরই মধ্যে আমাদের সাথে কলকাতার একটা টিমের দেখা হলো। তারা ট্রেইলে এই প্রথম কোনো বাঙালি টিম পেয়ে খুশি।

তারা বলল, ট্রেইলে কারো সাথে বাংলায় কথা বলতে পারবো এটা ভাবিনি। তাদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের অনেক গল্প হলো। তারা পুরো পরিবার নিয়ে হারকিদুন যাচ্ছিল। ওই ফ্যামিলির পুরুষ কর্তার বয়স ৬৩। এ বয়সে উনি নিয়মিত ট্রেকিং করেন। এর আগেও তিনি অনকগুলো ট্রেইল শেষ করেছেন। ব্যাপারটা ভাবতেই আমি অবাক হচ্ছি। আর এখানে তিনি তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ১৩ হাজার ফিটের হারকিদুন সামিটে করতে আসছেন। ওই টিমের সাথে আমরা কিছু ছবি তুল্লাম তারপর আমি আমার মতো করে হাঁটা দিলাম। আমি যতই সামনে যাচ্ছিলাম চারদিকের স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমার পায়ের তুলনায় মোবাইলের ক্যামেরা বেশি গতিতে ব্যবহার হচ্ছিল। কোনো ছবিই যেন আমার মন ভরছিল না। যতই ছবি তুলি মন আরো বেশি ছবি তুলার জন্য ব্যাকুল।

ট্রেইলে একটা দারুণ ব্যাপার ফলো করলাম, প্রতিটি মানুষ দারুণ আন্তরিক। সবাই ময়লা আবর্জনা এবং অপরের যেন কোন প্রব্লেম না হয় এটা নিয়ে দারুণ সচেতন। তাদের এইসব চিন্তা ভাবনার সাথে আমাদের নিজেদের দেশের পাহাড়ের অবস্থা তুলনা করতে গিয়ে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেক উঁচুতে দারুণ একটা গ্রামের নিচের কয়েকটা দোকান আছে সেখানে গিয়ে থামলাম। আমি সেখানে ব্যাগ রেখে ওজু করে যোহর নামাজ আদায় করে নিলাম। আস্তে-ধীরে আমার টিমের সবাই আসলো, তারপর নুডলস আর জুস খেয়ে নিলাম। সেখানে আমরা দীর্ঘ সময় রেস্ট করলাম। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম। রানা ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের আর কতটা পথ বাকি। উনি জানালেন, ২ কিলোমিটারের মতো হবে।

এর মধ্যে আকাশ মেঘলা হতে শুরু করলো। আমি ভাবলাম, আমি খুব দ্রুত যেতে চাই। বৃষ্টির আগেই আমি ২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে চাই। আমি দ্রুত হাঁটা দিলাম। এক কিলোমিটারের অধিক পথ হাঁটার পরে বৃষ্টি শুরু হলো। আমি একটা ঝর্ণার সামনে ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম। এরই মধ্যে দেখলাম, পুরো ট্রেইল প্রায় ফাঁকা হয়েছে গেছে। কারণ মাত্র ৩-৪টা টিম ছাড়া বাকি টিম হারকিদুন যাচ্ছিল। ফলে হারকিদুন যাওয়ার অধিকাংশ টিম ওই গ্রামের আশপাশের এলাকায় টেন্ট করতে শুরু করে দিলো। আর যারা বালি পাস যাবে, তারা আরো পথ এগিয়ে গিয়ে তারপর টেন্ট করবে। সাদা পাহাড়ের ট্রেইলে প্রথম বৃষ্টি উপভোগ করছি। অনুভূতি কতটা দারুণ ছিল তা প্রকাশ করতে ব্যার্থ আমি। আমার টিমের সবাইকে দেখা গেল, সবাই বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য পঞ্চ পড়ে নিলো।

তাদের পঞ্চ পড়া দেখে আমার কেন যেন এটা পরতে অস্বস্তি লাগলো। আমি ভাব্লাম বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি এখানে অপেক্ষায় থাকবো। তাও আমি এটা ব্যবহার করবো না। আমার টিমের সবাই আমাকে পাস করে এগিয়ে গেল। আমি বৃষ্টি কমার অপেক্ষায়। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশাল এই ঝর্ণার রূপে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি কমে গেলে আমি দ্রুত বের হয়ে হাঁটা শুরু করে দিলাম। ১০ মিনিট হাঁটার পরেই দেখলাম আরেকটা গ্রাম। গ্রামের নিচে বিশাল বড় বড় দুটো বাড়ি। এই এলাকার নাম শেমা। টিমের সবাইকে সেখানেই দেখতে পাইলাম। বুঝতে পারলাম আজকের জন্য এখানেই আমাদের ট্রেকিং শেষ। কি সুন্দর একটা গ্রাম! লোকজন গ্রামের নিচের দিকে বিপরীতে একটা ঝুলন্ত ব্রীজ ধরে সবাই নদী পার হয়ে গ্রামে আসা-যাওয়া করে।

আমি কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে একটা জায়গায় রেখে আশপাশের জায়গা ঘুরে দেখার জন্য বের হয়ে গেলাম। যতই দেখছি আমি যেন ততই সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যা গোধূলির আকাশের রঙের সাথে সবুজ ও সাদা পাহাড়ের সংমিশ্রণের কত বৈচিত্র্যময় আয়োজন। যেদিকেই চোখ যাচ্ছে প্রকৃতির রূপে মনপ্রণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পাথুরে পথ ঘেঁষা দুধের মতো সাদা নদীর কলতান শব্দের মধ্যে যেন যাদুকরী এক নেশার বিরাজমান। মনে হচ্ছিল, দূরের উপরের আকাশ থেকে এই দুধসাদা পানি নেমে আসছে। অনেক দূরের পাহাড় চূড়াগুলা যেন সাদা মুকুট পরে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। আমি একের পর এক ছবি আর ভিডিও করেই যাচ্ছিলাম। এইভাবে করেই যে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেল টের পাইলাম না। আমি আস্তে-ধীরে আমাদের ক্যাম্পে ফেরত আসলাম।

এসেই দেখলাম, বিকালের নাস্তা প্রস্তুত। তারপর খাবারের ওপর ঝাপিয়ে পড়লাম। নাস্তা শেষ করে ভয়ংকর ঠাণ্ঠা পানি দিয়ে হাতমুখ ভালো করে ধুয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। গাইড জানালেন, আমাদের রাতের খাবার ৮টার সময় দেবে। আমরা যেন ৮টায় খাবার খেয়ে নেই। যথাসময়ে আমরা রাতের খাবার খেয়ে এবং আমি নামাজ শেষ করে স্লিপিং ব্যাগে রাতের ঘুমের জন্য নিজেকে ভরে ফেললাম। চলবে