কাজী নাসির মামুন

কাজী নাসির মামুন

কাজী নাসির মামুনের কবিতা: দর্শন-উপনীত দ্বীপ

ফারুক সুমন

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২০

শূন্য দশকের প্রতিশ্রুতিশীল স্বতন্ত্র স্বরসন্ধানী কবি কাজী নাসির মামুন। পেশায় শিক্ষক হয়েও অন্তর্গত অনুভবে তিনি একজন একনিষ্ঠ শিল্পী। তার কবিতা যেমন আলঙ্কারিক সৌন্দর্যে উজ্জ্বল, তেমনই বোধের গভীরতায় উদ্বোধিত। কবিতা পাঠান্তে পাঠকের চৈতন্যলোকে জেগে ওঠে দর্শন-উপনীত দ্বীপ। যেখানে আছে স্বপ্ন-কল্পনা-আবেগ ও জন্মমৃত্যু রহস্যের অন্তরাল।

কাজী নাসির মামুন ১৯৭৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছায় জন্মগ্রহণ করেন। কবিতায় অধিক সমর্পিত হলেও কবিতাবিষয়ক গদ্য ও ছোটগল্প লেখায় তিনি সমান সচল। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ চারটি। লখিন্দরের গান (২০০৬), অশ্রুপার্বণ (২০১১), কাক তার ভোরের কোকিল (২০১৭) এবং রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই (২০১৮)। অবশ্য ২০১৪ সালে আহমেদ এস. কাদেরীর অনুবাদে লখিন্দরের গান কাব্যটি ইংরেজিতেও প্রকাশিত হয়। গ্রন্থনাম Song of Lokhindar। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন `কবিতাসংক্রান্তি` সম্মাননা ২০০৭ এবং `লোক` লেখক সম্মাননা ২০২০।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ `লখিন্দরের গান`। এই গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে তার আবির্ভাব হলেও তার আগেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা চর্চা শুরু করেন। ফলে গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলোয় পরিপক্বতার রয়েছে ছাপ। নতুন শব্দবুনন, লোকজ শব্দের নতুন উপস্থাপন, কবিতায় উপমা ও চিত্রধর্মিতার এদেশীয় মিথের প্রয়োগ। সবমিলিয়ে একধরনের সচেতন কাব্যপ্রয়াস লক্ষণীয়। গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায় ভাবের উত্থান-পতন লক্ষণীয়। কখনো মনে হতে পারে, একাধিক ভাবনাকে জোড়া তালি দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে পুরো একটি কবিতা। কবিকণ্ঠ কখনো ভাবের গভীরতায় উচ্চকিত, কখনোবা নমিত। কবির বক্তব্য যেন এঁকেবেঁকে এগুচ্ছে আর কবিতার বক্তব্যে জড়িয়ে যাচ্ছে বহু বিচিত্র ছবি, বিবিধ অনুষঙ্গ। উপমা, প্রতীক, রূপক, চিত্রধর্মিতা ইত্যাদি সিনেমেটিক দৃশ্যের পরস্পরায় প্রকাশ পাচ্ছে। কবিতার কোনো কোনো পঙক্তি হঠাৎ থিয়েটারের নাট্য-সংলাপের মতো শোনায়। আমি বলবো, কবিতার এই উৎসার মূলত একজন কবির প্রাতিস্বিকতারই প্রমাণ। কবি কাজী নাসির মামুনের ‘লখিন্দরের গান’ কাব্যটি পড়ে আমার তা-ই মনে হয়েছে। যেমন:

    তার মনে এক নেই
    বহুতত্ত্ব মাটির শেরেক
    কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি
            ঠোঁটে তার
            মনের পেরেক।

এভাবে ‘কটাশ কটাশ কাটে বাঁশ কাটা পাখি’ কবিতাটি শুরু হয়। কিন্তু তার বক্তব্য ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে এদিক-ওদিক। আবার সহসা কবি ফিরে আসেন বিন্দুতে। কবিতার বক্তব্য পুনঃপুন বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে আসে ঐক্যে। মনে হয়, তিনি যেন দক্ষ ধীবর, হাতের জাল মাঝ নদীতে ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে কিনারে টানেন। ‘কুকুরীর জন্য সংবেদনা’ কবিতায় তিনি যখন উচ্চারণ করেন:

    আঘাতে আঘাতে মানুষ দস্য হয়ে যায়।
    চিতই পিঠার মতো জালি জালি কলিজায়
    রক্ত ফিনকি দিয়ে ওঠে তার।

কিংবা,
বোধিরা মরেছে আজ, কেউটেছোবল খাচ্ছি বর
সাঁই তুমি কথা কও, জলে ভাসি এই লখিন্দর।
নীলকণ্ঠ হয়েছি দেখো, উদোম শরীর দেখো লাশ
আমাকে করেছ পর? কেন শুধু এই পরিহাস?
এদিকে সেদিকে খুঁজি, চারপাশে তোমার আকার
সবঘাটে হাস খেল, মূলত এ আমিই মাকাল,
সাঁই বেহুলা যে, প্রেমের করুণা সঞ্জীবনী
একবার বীণ ধরো, সর্প এসে ফেলে যাক মনি। (লখিন্দরের গান)

রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতায় সবচেয়ে আলোচিত দুটি দশক ত্রিশ ও ষাটের দশক। এদুটি দশক পশ্চিমা সাহিত্যের প্রভাবকে ধারণ করে বাংলা কবিতায় এনেছে পরিবর্তন। এছাড়া বিভিন্ন কাব্য-আন্দোলনের প্রভাব তো ছিলই। সেই তুলনায় শূন্য দশকের কবিরা কোনো ইশতেহার নিয়ে কবিতাঙ্গনে পা ফেলেননি। কোনো তত্ত্বও কবিতার মগজে বুনে দিতে তারা তৎপর নন। তবে এই দশকের কবিতার স্বাতন্ত্র্য কোথায়? মোটাদাগে বলা যায়, অন্তর্গত স্পন্দন তৈরিতে এই দশক সক্রিয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে ও পরে বাংলা কবিতায় স্লোগানধর্মিতা এবং স্পষ্টত বক্তব্যের যে আবেগতাড়িত উচ্ছ্বাস লক্ষণীয়, শূন্যদশকের কবিতায় ক্রমশ এই প্রবণতা কমে আসে। কাজী নাসির মামুনের কবিতা এই বোধের অনুগামী। তিনি কবিতাকে ভাবসম্পদ মনে করেন। বিষয়কে অনুভূতির রঙে রাঙিয়ে দিয়ে কবিতায় রূপ দেন। যেমন:

সহসা নির্মম এই বন্য কানামাছি ইচ্ছে করে মাছরাঙা পাখিদের মতো
ছুঁ মেরে তোমাকে দিই। একটু কামড়ে দাও নির্জন অন্তর।
তোমার ছায়ার মতো প্রাঞ্জল বনের দিকে তাই আমি ফিরে যাই একা একা।
(বৃক্ষাঞ্জলি/অশ্রুপার্বণ)

কিংবা,
যৌবন পালিত হবে গোপন উৎসবে?
যেন পিঠা পাতায় মুড়িয়ে দিল কেউ;
সৃজিত জীবনে তবু হাহাকার মিটল না।
যেন সর্প সঙ্গমের প্যাঁচানো লতায়
ষোড়শীর বেণী-বাঁধা চুল মিলিয়ে দেখেছি:
মানুষেরও জল আছে, বিষ। মানবীর আছে মেঘ, ফণা।
(জল যেন বিষ, মেঘ যেন ফণা/ অশ্রুপার্বণ)

কাজী নাসির মামুনের কবিতায় দেখা যায় ক্ষণিক ক্ষরণ। তবে তিনি বোধহয় কবিতায় দুঃখবাদী নন। তার কবিতায় দুঃখবোধের প্রকাশ উচ্চকণ্ঠ নয়। বরং মনোগত বেদনা একটা মিহি চোরাসুর হয়ে কবিতায় আভাসিত হয়। কবিতা পাঠান্তে পাঠকের মনে তার রেশ রয়ে যায়। তার লেখা `অশ্রপার্বণ` শীর্ষক দীর্ঘ কবিতাটি বোধকরি গুরুত্বপূর্ণ একটি `শোককবিতা` (Elegy)। সহোদরের অকালমৃত্যু কবিকে ভীষণরকম শোকাহত করে। ফরাসি প্রতীকবাদী কবিদের মতো তিনি তার ব্যক্তিগত মনোবেদনা স্থাপিত করেন প্রতীকের ব্যঞ্জনায়। এইক্ষেত্রে কবিতায় উদ্ধৃত হয়েছে গ্রাম ও শহরের নানা উপকরণ। `পাথরের প্রজাপতি` `প্রস্তর ডানা` `গ্রামীণ পিঠার ব্যর্থ ভাবালুতা` `পিচঢালা পথের আত্মা` `মর্মযন্ত্রণার ইট` ইত্যাদির প্রয়োগ কাব্যভাষায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যেমন:

আমার জীবনে তুমি পাথরের প্রজাপতি হও।

দুরন্ত বিক্ষোভে ফেটে-পড়া
বিমুক্ত টিয়ার গ্যাসে শহরের বিপুল আবাস
অমূলক অসুস্থ কান্নায় ভেসে গেলে
প্রস্তর ডানায় তুমি সুখ নিয়ে এসো।
(গুপ্তচর/ কাক তার ভোরের কোকিল)

কিংবা,
উড্ডীন স্বপ্নের পাশে
     তোমার শরীর যেন স্পর্শসমতল;
ইট বালি সুরকির সুমন্তর ঢেলে
          আঙুলে আঙুলে গড়ি ইমারত।
(ইমারত/কাক তার ভোরের কোকিল)

কাজী নাসির মামুনের কবিতায় সমকালীন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের রাজনৈতিক নানা ঘটনার অভিঘাত অস্বাভাবিক নয়। তবে এর আগে সমকালীন ঘটনাকে কবিতায় যেভাবে স্পষ্ট ও বিবৃতি আকারে উপস্থাপন করার প্রবণতা দেখা যায়, মামুন সে পথে হাঁটেননি। তার কাছে সমকালীন ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই যুগযন্ত্রণাকে কবিতাময় করে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ শিল্পের মানদণ্ডে সমকালীন কবিতা হেরে যাক, এটা তিনি চাননি। ফলে বিষয় সমকালীন হয়েও কবিতা হয়ে উঠেছে চিরকালীন শিল্পের বৈভব।

কাজী নাসির মামুনের দীর্ঘকবিতা ‘রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই’ এরকম একটি সৃষ্টি। মিয়ানমার সরকারের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৬-২০১৭ সালের দিকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। যারা বর্তমানে কক্সবাজারের পাহাড়গুলোতে গাদাগাদি করে বাস করে। এটাই এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ আশ্রয় শিবির। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমার সম্প্রদায়ের অমানবিক আচরণ বিশ্বের বিবেকবান মানুষের মনকে ব্যথিত করে। কবি কাজী নাসির মামুন সেই ব্যথিত মুহূর্ত এবং ইতিহাসের নির্মম সত্যকে কবিতা ধারণ করেছেন। লিখেছেন ‘রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই’। এটা এক মর্মবিদারী কবিতা। নিসর্গের নিবিড়তায় উপমা ও চিত্রকল্পের অনবদ্য উপস্থাপনে এসেছে সমকাল। যেমন:

পৃথিবী মৃত্যুর দিকে গেছে
রক্তের নিশানমালা এখন উড়ছে আরাকানে
সূর্য কি মুখর আলো? উদয়াস্ত রঙে মাখা
প্রখর আগুনে মজা পায়?
মরণ-স্তূপের পাশে কুয়াশাঘুঙুর
বাদ্য-বিউগল নিয়ে হাঁটে।
         পতনস্পর্ধায় নামে মানুষের ঢল।
আগুন! আগুন! বলে বৃষ্টির ঘূর্ণন
মাথায় নিয়েছে ওরা;
কান্নার বিকল্প নদী চোখের ভিতর।
                        ভূগোল বঞ্চনা পায়ে পায়ে।
জল তুমি রৌদ্রকন্যা? বিকশিত আগুনের বোন?
(রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই)

কাজী নাসির মামুনের কবিতায় ছন্দপ্রযত্ন কতটুকু হয়েছে? কবিতার আলোচনায় এরকম আগ্রহ পাঠকের মনে তৈরি হওয়া অমূলক নয়। কারণ এরই মধ্যে শূন্য দশকের কবিতায় ছন্দপ্রয়োগ সম্পর্কে সমালোচক মহলে এক রকম আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ‘প্রথম দশকের অধিকাংশ কবিই ছন্দনিষ্ঠ নন।’ এমন মন্তব্য চিন্তার উদ্রেক করে বৈকি। এতদিন কবিতা প্রসঙ্গে বলা হতো, ‘ছন্দজ্ঞান বিনা কাব্য রচে যেই জন, পণ্ডিতসভায় সে লজ্জারও ভাজন।’ তবে কী শূন্য দশকের কবিরা পণ্ডিতমহলে লজ্জার ভাজন হবেন? তারাও কি মনে করেন যে, ছন্দ এবং মিল মধ্যযুগীয় ব্যাপার, এই দুটিকে বর্জন না করলে কবিতা আধুনিক কিংবা উত্তর-আধুনিকের অবয়ব পাবে না। প্রচলিত প্রধান ছন্দগুলোর (অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত) প্রয়োগ বেশির ভাগ কবির কবিতায় অনুপস্থিত।

শূন্য দশকের কবিদের ছন্দ কেন্দ্রিক এই মৌল প্রবণতা কাজী নাসির মামুনের কবিতায়ও প্রতিভাত হয়। তবে তুলনামূলক অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রতি তার প্রবল ঝোঁক লক্ষণীয়। কখনোবা গদ্যচ্ছন্দের ‘বিষমমাত্রিক যতি; অসম ছন্দস্পন্দ এবং গদ্যোচিত বাগভঙ্গি’ যথার্থ রূপে প্রয়োগ হয়েছে তার কবিতায়। অন্ত্যমিল মানেই ছন্দ, এধরনের সনাতনী চিন্তা থেকে সচেতনভাবেই তিনি হয়তো নিরীক্ষাপ্রবণ হয়েছেন। কারণ কেবল ছন্দের দোহাই দিয়ে কবিতাকে আড়াল করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘পুনশ্চ’ কাব্যের ভূমিকায় এই ছন্দের বাস্তবতা উপস্থাপন করেছেন, ছন্দটাই যে ঐকান্তিকভাবে কাব্য, তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা আছে রসে, ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয়... গদ্যেও কাব্যের সঞ্চরণ অসাধ্য নয়, গদ্যই হোক, রসরচনা মাত্রেরই একটা স্বাভাবিক ছন্দ থাকে। পদ্যে সেটা সুপ্রত্যক্ষ, গদ্যে সেটা অন্তর্নিহিত।

সর্বোপরি, কাজী নাসির মামুনের কবিতায় আছে নিবিড় নিরিখ। বিশেষ করে ভাবের গভীরতম অঞ্চল ছুঁয়ে তিনি উদ্ধার করেন অধরা পঙক্তি। একজন চিত্রশিল্পী যেমন ক্যানভাসে তুলির টানে মূর্ত করে তোলেন সীমাহীন শিল্পবোধ, মামুন যেন অনুরূপ ধ্যান ঢেলে দেন কবিতার ক্যানভাস জুড়ে। তার লক্ষ্য স্বতন্ত্র স্বর-সন্ধান। তার কাব্যভাষায় নতুন নতুন শব্দবন্ধ প্রযুক্ত করার সচেতন মনোভঙ্গি দেখে এটাই অনুমিত হয়।

লেখক: কবি