ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা সফল হতে দিল না কারা

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ১১, ২০১৯

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইংরেজ ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারে উদগ্রীব। কিন্তু ইতিহাসের কি নিদারুণ বিড়ম্বনা, ইংরেজ ছেড়ে যেতে চাইলেও ভারতবাসীদের মধ্যে অনেক প্রভাবশালী অংশই তাদের মনেপ্রাণে বিদায় দিতে চায়নি। জগজীবন রাম বড়লাট ওয়াভেলকে বলেছিলেন যে, ইংরেজ ভারত ত্যাগ করলে তপশিলী জাতির মানুষদের বর্ণহিন্দুদের উৎকট আধিপত্য সহ্য করে দিনাতিপাত করতে হবে। তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে, অন্তত তাদের সমাজভুক্ত মানুষদের কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য ইংরেজেদের আরো দশ বছরের আগে ভারত ত্যাগ করা উচিৎ নয়। কংগ্রেস বা বর্ণহিন্দুদের শাসন ভারতের জন্য কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, সে সম্পর্কে ভীত নিম্নবর্গের হিন্দুরা পর্যন্ত। নিম্নবর্গের মানুষরা কংগ্রেসের শাসনের চেয়ে ইংরেজ শাসনকে শ্রেয়তর মনে করছে। নিম্নবর্গের আম্বেদকরও কংগ্রেসের শাসন নিয়ে ভীত ছিলেন। নিম্নবর্গকে ভারতে কী চোখে দেখা হতো তার উদাহরণ আম্বেদকর নিজে। তিনি যখন মন্ত্রী তখন তার অধস্থনরা তাকে ফাইলটা ছুড়ে দিতেন তিনি নিম্নবর্ণের ছিলেন বলে।

ভারতকে স্বাধীনতা দান এবং সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান করার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ক্যাবিনেট মিশনকে পাঠানো হলো। ক্যাবিনেট মিশন প্রথমত দুটি প্রস্তাব রাখে। ক্যবিনেটা মিশনের প্রথম দুটি প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল। কারণ জিন্নাহ কলকাতা বাদ দিয়ে বা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে এবং পাঞ্জাবকে টুকরা করে পাকিস্তান মেনে নিতে চাননি। জিন্নাহ বাঙালি এবং পাঞ্জাবি জনগোষ্ঠীকে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা ভূখণ্ডে বিভক্ত করতে আপত্তি জানান। কংগ্রেস আবার স্বল্প ক্ষমতা সম্পন্ন ‘ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র’ মেনে নিতে চাননি। কংগ্রেস চাইছিল, কেন্দ্রের হাতে যতটা সম্ভব ক্ষমতা থাকতে হবে।

যখন লীগ আর কংগ্রেসের মধ্যে মিল হলো না তখন দু’পক্ষ নিজেদের পৃথক পৃথক বিকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করলো। মুসলিম লীগের প্রস্তাব ছিল, হিন্দু-মুসলমান দুটি অঞ্চল নিয়ে সংযুক্ত ভারত রাষ্ট্র গঠিত হবে। দুটি অঞ্চলের কেন্দ্রের হাতে বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়, প্রতিরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া বাকি সব ক্ষমতা থাকবে প্রদেশগুলির হাতে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছয়টি প্রদেশ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, বেলুচিস্তান, সিন্ধু বঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি অঞ্চল করতে হবে। ছয়টি মুসলিম প্রদেশের জন্য পৃথক একটি সংবিধান রচনাকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। কোনো অঞ্চল বা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত প্রদেশের নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বাইরে যাবার অধিকার থাকবে যদি অবশ্য সে প্রদেশের অধিবাসীরা গণভোটের মাধ্যমে সেরকম ইচ্ছা ব্যক্ত করে। দুই অঞ্চলে পূর্বোক্ত দুই সংবিধান সভা স্থির করবে যে, কেন্দ্রে কোনো আইনসভা থাকবে কিনা। কেন্দ্রকে রাজস্ব দেবার জন্য কোন্ পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে তাও দুই সংবিধান সভা স্থির করবে। আইন রচনা, প্রশাসনিক বা শাসন সংক্রান্ত কোনো বিবাদ-সম্পর্কিত বিষয়ে কেন্দ্র তিন-চতুর্থাংশর বহুমত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। দুই অঞ্চল বা গোষ্ঠী এবং প্রাদেশিক সংবিধানসমূহে ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা থাকবে। (শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)

জিন্নাহর এই প্রস্তাবের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রদেশগুলিকে প্রথম একটি অঞ্চলের মধ্যে নিয়ে আসা হলেও বা একটি গোষ্ঠীভুক্ত করা হলেও, গণভোটের মাধ্যমে সেখান থেকে বের হয়ে নিজের ইচ্ছামত স্বাধীন থাকতে পারবে বা ভিন্ন অঞ্চলে যোগদান করতে পারবে। জিন্নাহর এই প্রস্তাবে প্রদেশগুলির জন্য যথেষ্ট স্বাধীনতা রাখা হয়েছিল। প্রদেশগুলি কখনোই কেন্দ্রের ইচ্ছাধীন থাকবে না। সংযুক্ত ভারতের কেন্দ্র শুধু বিদেশ সংক্রান্ত আর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। জিন্নাহর প্রস্তাবে পাকিস্তান সম্পর্কে কিছুই বলা ছিলো না। জিন্নাহর প্রস্তাব বাতিল করে ক্যাবিনেট মিশন এরপর ষোলই মে যে চূড়ান্ত প্রস্তাবটি দিয়েছিল সেখানে বাংলার ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন ছিল। ক্যাবিনেট মিশনে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল, ব্রিটিশ-ভারত এবং দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে সর্বভারতীয় ইউনিয়ন গঠন করা হবে এবং তা বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ বিষয়গুলি দেখবে। দায়িত্ব পালনের জন্য কেন্দ্রের রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার থাকবে। ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলিকে তিনটি বর্গে ভাগ করা হবে।

ক বর্গ: মাদ্রাজ, বোম্বাই সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হবে।
খ বর্গ: উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বালুচিস্তান নিয়ে গঠিত হবে।
গ বর্গ: বঙ্গ এবং আসাম নিয়ে গঠিত হবে।

ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনায় দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা এবং আসাম মিলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হবে। ক্যাবিনেট মিশনের এই প্রস্তাবে বলা হলো, কেন্দ্রের প্রশাসন এবং আইন প্রণয়ন উভয় বিভাগই থাকবে যাতে প্রতিনিধিত্ব করবে বিভিন্ন প্রদেশগুলি এবং দেশীয় রাজ্যসমূহ। মিশনের চূড়ান্ত প্রস্তাবে বলা হলো, কেন্দ্রের আওতাভুক্ত বিষয়াবলি ছাড়া আর সব বিষয় এবং অবশিষ্ট ক্ষমতা প্রদেশগুলির উপর বর্তাবে। ক্যাবিনেট মিশনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে আরো বলা হয়, নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা কার্যকরী হবার পর প্রদেশগুলির যাকে যে বর্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার বাইরে চলে আসার অধিকার থাকবে। বাংলা বা আসাম বা বাকি দুটি বর্গের যে কোনো প্রদেশ ইচ্ছা করলে সংবিধান রচনার পর নিজের পাছন্দ মতো বর্গ বেছে নিতে পারবে। বাংলাকে যে আসামের সঙ্গে বা আসামকে বাংলার সঙ্গে থাকতে হবে তাও নয়। বাংলা বা যে কোনো প্রদেশ চাইলে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে থাকবে না চাইলে স্বাধীন হয়ে যেতে পারবে। বাংলাকে ভাগ করার প্রশ্নই নেই, বরং ত্রিপুরা বাংলার ভিতরে চলে আসার কথা।

ক্যবিনেট মিশন যে চূড়ান্ত প্রস্তাবটি দিয়েছিলো, মুসলিম লীগ তা গ্রহণ করলো। গান্ধীবাদী শৈলেশকুমার বলছেন, ‘লীগের এই স্পষ্ট প্রতীয়মান পরিবর্তিত ভূমিকার পিছনে জিন্নাহর বিশেষ অবদান ছিল।’ জিন্নাহ ভারত থেকে কখনো সম্পূর্ণভাবে বের হয়ে যাবার কথা বলেননি। জিন্নাহ হিন্দু প্রধান এবং মুসলিম প্রধান প্রদেশের ভিত্তিতে ভারতকে দুটো অঞ্চলে ভাগ করার কথা বলেছিলেন। জিন্নাহর মূল যে দাবি প্রদেশগুলির হাতে স্বায়ত্বশাসন বা অবশিষ্ট ক্ষমতা দান সেটা ক্যাবিনেট মিশন মেনে নিলে তিনি ক্যাবিনেট মিশনের যুক্তরাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পক্ষে প্রস্তাবে সম্মতি জানান। জিন্নাহর তরফে এটি এক বিরাট বিবেচনার পরিচায়ক। জিন্নাহকে মুসলিম লীগের নেতাদের স্বপক্ষে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিলো। জিন্নাহ ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব নিয়ে ছয়ই জুন মুসলিম লীগের সভায় বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের ক্রিপস-এর প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। আমিই সিমলা সম্মেলনের প্রস্তাবটি গ্রহণ না করতে বলেছিলাম। আমি আপনাদের বলছি, এই প্রস্তাবটিতে সম্মত হোন।’ জিন্নাহ স্বীকার করলেন, সংখ্যালঘু সমস্যার এর চেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে না।

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি চব্বিশে মে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা সরাসরি নাকচ করে। গান্ধী প্রথম বলেছিলেন, ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর সমাধান। কিন্তু আসামের মুখ্যমন্ত্রী যখন বেঁকে বসলেন, গান্ধী নিজের কথা ঘুরিয়ে ফেললেন। কংগ্রেস সভাপতি আজাদ চাইছিলেন ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক। সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিতে উনিশশো ছিচল্লিশ সালের ছয়ই জুলাই বিরাট বিরোধিতার মুখে আজাদ বললেন, ‘ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা সবদিক থেকে কংগ্রেসের মতকেই মেনে নিয়ে সংখ্যালঘুদের প্রয়োজনীয় আশ্বাস দান করেছে।’ যখন ভোট গ্রহণ করা হলো তখন ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রস্তাবটি গৃহীত হলো। ইতিমধ্যে গান্ধী আজাদকে সভাপতির পদ ছাড়তে বললেন। গান্ধীর কথায় আজাদ জওহরলালের হাতে কংগ্রেসর সভাপতির পদ হস্তান্তর করলেন। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়ের দ্বারা একত্রে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণের ঘটনাকে অনেকেই মনে করলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল পদক্ষেপ। জিন্নাহর মূল দাবি ছিলো পাকিস্তান নয়। তার মূল দাবি ছিল, সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা এবং প্রদেশগুলির স্বায়ত্বশাসন, এই ঘটনায় তা প্রমাণিত হলো।

যদি এই প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত গৃহীত হতো, তাহলে বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম মিলে হতো একটি স্বায়ত্বশাসিত বিরাট বঙ্গ-আসাম ভূখণ্ড। কিন্তু যখন সব প্রস্তুত, বাধা হয়ে দাঁড়ালেন জওহরলাল নেহরু। কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে তিনি দশই জুলাই বোম্বেতে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে নিজের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে বললেন, ‘আমরা সংবিধান পরিষদে যেতে রাজি, এছাড়া অন্য কিছুতে যেতে রাজি নই। আমরা সেখানে কী করবো তা আমরা স্থির করবো। আমরা কারও প্রতি কিছু করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেইনি।’ নিজের গ্রন্থে আজাদ লিখছেন, তিনি একটি বিস্ময়কর বিবৃতি দিলেন। সাংবাদিকরা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক খসড়া প্রস্তাবটি গ্রহণের দ্বারা কি এই বুঝায় যে কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনসহ, ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাটি হুবহু গ্রহণ করেছে? জওহরলাল উত্তরে বললেন, গণপরিষদে কংগ্রেস প্রবেশ করবে যে-কোনো চুক্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থায় এবং উদ্ভুত যে-কোনো পরিস্থিতির প্রয়োজন মোকাবেলা করার স্বাধীনতা নিয়ে।

সাংবাদিকরা তখন জানতে চাইলেন, তার অর্থ কি ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা পরিবর্তিত হতে পারে? জওহরলাল জোরের সঙ্গে বললেন, কংগ্রেস কেবলমাত্র গণপরিষদে অংশগ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে এবং ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাকে যেভাবে পরিবর্তন বা সংশোধন করলে উত্তম হবে সেভাবে পরিবর্তন করার স্বাধীনতা রয়েছে বলে সে মনে করে। জওহরলালের এই বক্তব্যকে অনেকেই তীব্র সমালোচনা করেছেন। আজাদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেন, ‘আমি অবশ্যই নথিভুক্ত করে রাখবো যে, জওহরলাল ভুল কথা বলেছিলেন। কথাটা মোটেই ঠিক নয় যে, কংগ্রেসের ইচ্ছেমতো পরিকল্পনাকে সংশোধন করার স্বাধীনতা আছে।’ কংগ্রেস সভাপতির এই ঘোষণার ফলে জিন্নাহ গোটা অবস্থার পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন। কারণ কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্য ছিলো, গণপষিদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা জোরে কংগ্রেস এই পরিকল্পনার পরিবর্তন ঘটাতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠদের দয়ার পাত্র হয়ে উঠবে। জিন্নাহ সেজন্য জওহরলালের ঘোষণাকে কংগ্রেসের ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা পরিত্যাগ করার শামিল বলে মনে করেন। (মওলানা আজাদ, ভারত স্বাধীন হলো)

সাতাশে জুলাই বম্বেতে মুসলিম লীগের কাউন্সিলের বৈঠক বসে। জওহরলালের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে তিনদিন আলোচনার পর লীগ কাউন্সিল ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলেন। মুসলিম লীগের ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা বাতিলের সিদ্ধান্তে আজাদ উদ্বিগ্ন হলেন। কারণ ভারত ভাগের সম্ভাবনা তৈরি হলো জওহরলারের বক্তব্যকে ঘিরে। দীর্ঘদিনের সব পরিশ্রম ভণ্ডুল হতে বসেছে জওহরলালের জন্য। পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য আজাদ চাইলেন দ্রুত কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটির সভা ডাকা হোক। জওহরলাল প্রথমে তাতে ইচ্ছুক ছিলেন না, পরে আজাদের চাপে সভা ডাকতে বাধ্য হলেন। সভা বসলো আটই আগস্ট। সকলকে আজাদ বোঝালেন যে, সভাপতির সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্যে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এ কথা স্পষ্ট করতে হবে যে, সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস সভাপতির বিবৃতিটি ছিলো তার ব্যক্তিগত মতামত এবং তা কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের সঙ্গে এক নয়। সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই কংগ্রেসের মত ব্যক্ত হয়েছে এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষ, এমনকি কংগ্রেস সভাপতিও তার পরিবর্তন ঘটাতে পারেন না। (মওলানা আজাদ, ভারত স্বাধীন হলো)

হয়তো তাতে একটা সমাধান হতে পারতো। জওহরলাল যুক্তি দেখালেন যে, ক্যাবিনট মিশন পরিকল্পনা কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত হয়েছে একথা যদি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি পুনরাবৃত্তি করতে চায় তাতে তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কংগ্রেসের সভাপতির বক্তব্য কংগ্রেসের নীতির প্রতিনিধিত্ব করে না, এ কথা বলা হলে তা ব্যক্তিগতভাবে জওহরলালের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। ফলে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি উভয়সঙ্কটে পড়ে যায়। কংগ্রেস সভাপতির মর্যাদা তারা বিপন্ন করবে কি না, নাকি বহুদিন পর যে মীমাংসায় পৌঁছানো গিয়েছিলো সেটাকে বিপদাপন্ন করবে। সভাপতির বিবৃতিকে বর্জন করার মানে হলো সংগঠনকে দুর্বল করা, ভিন্ন দিকে ক্যাবিনেট মিশন পকিল্পনাকে বাতিল করার অর্থ হলো দেশকে ধ্বংস করা। ফলে নেহরুর বিবৃতির একটি গোজামিল ব্যাখ্যা দেয়া হলো। বলা হলো, কমিটি এটা স্পষ্ট করে দিতে চায় যে তারা যদিও বিবৃতির অন্তভুর্ক্ত সবগুলি প্রস্তাব অনুমোদন করেনি, কিন্তু পরিকল্পনাকে তারা গ্রহণ করেছে পুরোপুরিভাবেই। কংগ্রেসের কারণে ক্যাবিনেট মিশনের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে গেল। পাশাপাশি ভারত আর পাঞ্জাব এবং বাংলা ভাগের খেলায় মেতে উঠলেন গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদরা। বিভিন্ন চিঠিপত্র রয়েছে তাদের, যেখানে একথাও বলা হয়েছে ভারত ভাগ না হলেও, পাকিস্তান সৃষ্টি না হলেও বাংলাকে ভাগ করতে হবে। শিলা সেন, জয়া চ্যাটার্জী, সুনীতি কুমারের গ্রন্থ দেখুন।

মওলানা আজাদ লিখেছেন, ‘কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের বিরোধে ক্যাবিনেট মিশন বললো, এ ব্যাপারে লীগের ব্যাখ্যা সঠিক।’ তিনি আরো লিখছেন, ‘ন্যায্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, এ ব্যাপারে মি. জিন্নাহ পুরোপুরি সঠিক ছিলেন।’ তিনি অন্যত্র জানাচ্ছেন, ‘দশ বছর পর পিছনে তাকিয়ে আমি স্বীকার করছি যে, মি. জিন্নাহ যে কথা বলেছিলেন তাতে জোর ছিল। কংগ্রেস সন্দেহ উত্থাপন করে সঠিক বা বুদ্ধিমানের কাজ কোনোটিই করেনি।’ (মওলানা আজাদ, ভারত স্বাধীন হলো)