ক্ষুধার্ত সংলাপ

প্রকাশিত : মে ০৯, ২০১৮

নাট্যনির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের নাটক ‘যে জীবন ফড়িংয়ের’। এ নাটকের অনন্য একটি চরিত্র হচ্ছে ‘মুদ্রা’। সে একজন হতাশ কবি। হাসেম তার বন্ধু। এ বন্ধুটা আবার ক্ষুধার্ত এক দার্শনিক। হাসেম মূলত হকার পত্রিকা বিক্রি করে। কিন্তু তার পত্রিকা কখনো বিক্রি হয় না বলে খাবারের খোঁজে তাকে ডাস্টবিনের আশপাশে ঘুরতে দেখা যায়। নাটকজুড়ে রয়েছে জীবন-সন্ধানী কিছু সংলাপ, যা আমাদের চেতনাকে ঘা দ্যায়। ক্ষুব্ধ এবং ক্ষুধার্থ সেই সংলাপগুলো একত্রিত করে লিখেছেন শুভাশীষ শুভ

আপনি ও আপনারা জানতে চেয়েছেন, আমি কে? আপনারা বলছেন আশরাফুল মাখলুকাত, মানুষ। কিন্তু আমি হলাম সেই কাঠামো, যে একটা মাংস, পোশাক, সভ্যতা ইত্যাদি ইত্যাদি বয়ে বেড়াচ্ছে। আমার মগজ আনা হয়েছে বার্কিংহোম প্যালেসের কোনও রেফ্রিজরেটর থেকে। আর তা রাখার শক্ত খুলি দিয়েছে পেন্টাগন। এই দারুনণ মেরুদণ্ড ইজ মেড বাই জাপান। আমার বুকের হাড়গুলো একেবারে খাঁটি ইন্ডিয়ান। আমার চোখজোড়া বানিয়ে আনা হয়েছে ভ্যাটিকান সিটি থেকে। দৃষ্টির গভীরতা দিয়েছে এথেন্স। জ্ঞানের সীমানা চীনের প্রাচীরে সমাহিত কনফুসিয়াস। আমার কবরের জমি একেবারে খাঁটি বাংলাদেশি। আমি দুর্ভিক্ষের চেয়ে তীব্র। কিন্তু আমি একজন হতাশ মানুষ।

আমি বিট জেনারেশনের আহ্বানে জন্মেছিলাম। জুরিখে একদল বেয়ারা শিল্পী লা-ভলতয়ের পত্রিকার পাতায় আলপিনের খোঁচা মারতেই উনিশ শতকের জীর্ণ কোমর থেকে আমি বেরিয়েছি। ভারতবর্ষের অলিতে-গলিতে আমার চোখে প্রজন্মের হাহাকার দেখে হাংরি হাংরি বলে গান তুলেছিল একদল উন্মাদ কবি। আমি সেবার হাংরিদের প্রতিনিধি হয়েও জন্মেছিলাম। জলে নামলে মাছ আর ডাঙায় হাঁটলেই সরীসৃপ। গিয়েছিলাম জলপরিদের দেশে। পাকস্থলির দেয়ালে শিংমাছের খোঁচা লাগতেই বুঝেছিলাম, খিদের যন্ত্রণা কীরকম শিরশিরিয়ে ওঠে। কিন্তু বিশ্বাস করুন বন্ধুরা, আমি পাকস্থলি চাইনি। চেয়েছিলাম মগজের শুশ্রুষা। সে দেশে প্লেটোও ছিলেন। তার ওপরের দেয়ালে মহামতি সক্রেটিস, আহ! তাদের কারো কোনও পাকস্থলি ছিল না।

দার্শনিকদের পেট থাকতে নেই। তাদের কেবলি ভাবনা আর সেই ভাবনায় উঠে আসে নারী। নারীর নিষ্পাপ বিস্মিত হাসির জন্য আমি পৃথিবীর সবকিছুকে বড় অথবা ছোট করে দিতে পারি। কবিরা কিছু পায় না। উপাসনালয়ের বাইরে জুতা রেখে গেলে জুতা চুরি হয় না। বাসে চাপলে পকেটমাররা পকেটে ব্লেড চালায় না। নারীকে কামনা করে, স্পর্শ পায় না। নারী তো নরম, শিমুল তুলার মতো সুন্দর। একটি আপেলগাছের নিচে আমি হাজার বছর ধরে বসে থেকেছি। আপেল খেয়ে খেয়ে ক্লান্ত হয়েছে পাকস্থলি। তবু নারীর স্পর্শ পাইনি কোনোদিন। অথচ নারী যাকে ভালোবাসে, সেই লোকটি তার নিজের জীবন উৎসর্গ করে যাচ্ছে টাকার কাছে। তার দেহে শক্ত মেদের প্রাচীর। ত্বক আয়নার মতো তীব্র। শহরের সবচেয়ে উঁচু দালানগুলো প্রতিফলিত হয়, এমন আয়নার মতো তীব্র। ঠোঁটের পাশে শতভাগ কর্পোরেট অহংকার। হৃদপিণ্ডের পাশে কসথেটা সাইনথেটা টেনথেটা রুটওভার। মানে ছোটখাটো হিসেবের মেশিন। ভালোবাসা বিকিয়ে যাচ্ছে শেয়ার বাজারের সূচকে।

সব নাকি জীবনের নিরাপত্তার জন্য। নিরাপত্তাই যদি শেষ কথা হতো, তাহলে মাতৃগর্ভের প্রবল নিরাপত্তার ভিতরে থেকে যেতাম। এই ধুলোর পৃথিবীতে আর আসতাম না। কিন্তু আমার মা-বাবা ও পূর্বপুরুষরা যে কথা বলতে পারেনি, সে কথা বলতে চেয়েই আমার এই পৃথিবীতে আসা। আজো পত্রিকায়, নিউজ পোর্টালগুলোতে ছেপেছে, অন্ধকার রেস্টুরেন্ট থেকে জোড়ায় জোড়ায় আটক। আমাদের সংবাদ মাধ্যেম আর প্রশাসন এতটাই দায়িত্ব জ্ঞান যে, গোড়া উৎপাটন না করে চলছে আগা সংস্কারের কাজ। মৃত্যুর পর আমি আমার কবরটি উইল করে রেখে যেতে চাই পৃথিবীর সব প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য। কবরের ওপরে থাকবে ফলবতী গন্ধম অথবা আপেল গাছ। যার মাথায় আপেল পড়বে সে পাবে অসূর্যস্পর্শা প্রথম নারী। অথবা নিউটন আর তার ডায়মন্ড নামে আরাধ্য কুকুর। পৃথিবীর প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য যারা সুযোগ্য আবাশভূমি গড়ে যেতে পারেনি। তাদের কাছে এইসব পাগলের প্রলাপ বলেই মনে হয়। আমি আসলে পাখি হয়ে জন্মাতে চেয়েছিলাম। ছোট্ট চড়ুই, শহরে ম্যাটপাই বন্দুক আবিষ্কার হওয়াতে আর পাখি হয়ে জন্মানোর সাহস হলো না।

মানুষ হয়ে জন্মিয়ে লাভ হয়নি কোনো। বুক ফুটো হয়ে বাতাস বেরিয়ে যেতে পারে যখন তখন। গোলমেলে ট্রাফিক নিয়মে পিষিয়ে যেতে পারে গাড়ির চাকা। যখন তখন মরো, যখন তখন বাঁচো। কিন্তু... কিন্তু আমরা সবাই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। ব্রেকিং নিউজ। অভিজাত শপিংমলে আগুন। পিলখানায় সামরিক বিদ্রোহ। ভেঙে পড়েছে রানা প্লাজা। ক্যান্টনমেন্টে সংস্কৃতিকর্মী ধর্ষণ ও খুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় সংঘর্ষ। প্রেসক্লাবে মানববন্ধন। শাহবাগে গণজোয়ার। ছবিরহাটে আমরণ অনশন। কিন্তু আমরা সুখি, বিস্ময়কর এবং হতাশ।

মৃত্যু একটি বিকল্প ধারণা মাত্র। বেঁচে থাকলে হয়তো পৃথিবীর কোনো একটা নিয়ম বদলে যেত। কবি তার কাঙ্ক্ষিত নারীকে পাবে, এই নিয়ম পৃথিবীতে নেই। কবির মাংস খসে পড়বে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাবে যুগোপদ প্রেম আর পুঁজিপতিদের চেনা ফাঁদ। তা কি হয়? কিন্তু আমি জানি, পৃথিবীর পথে পথে আবারো ফসল ফলবে। নদীর ঘ্রাণ লেগে থাকবে শিশুর নাকে। সব ফুলে পুজো হবে সব দেবতার। দেবতারাও সাম্যবাদী হবেন নিশ্চয়ই। মানুষ মরছে আমি মরছি তুমি মরছো। তুমি মরছো সবাই সবাই মরছে সবাই সবাইকে খাবে। বাস্তুসংস্থান, আমরা মরেছি বহুবার, আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু হয়েছে যতবার। এবং জন্মেছি যতবার। আমাদের শেষকৃত্য হবে শূন্যতায়। এন নেরিয়াল অব চিউরি, শূন্যতায় শোকসঙ্গীত। কেননা আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব। আশরাফুল মাকলুকাত। আমরা ভীষণ সুখি, বিস্ময়কর এবং হতাশ।