প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

খন্দকার সোহেলের আত্মগদ্য ‘বইজীবন আর বউজীবন’

প্রকাশিত : মে ১৫, ২০২০

যে জীবনে চ্যালেঞ্জ নেই, যে জীবনে দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-রাগ-ক্ষোভ-অভিমানের বালাই নেই, সেই জীবন পানসে। যে জীবনে কিছু অকৃতজ্ঞ মুখের দেখা না মেলে, সেই জীবন ভালো অভিজ্ঞতার নয় মোটেও। যে জীবনটিতে নিজেই হওয়া যায় নিজের মোটিভেশনাল স্পিকার সেই জীবন সুখের-আনন্দের।

আমার জীবনটা তাই ফাটাফাটি, আজকালের ভাষায় বিন্দাস! সব আছে। কিছু কিছু ব্যাপার আছে ডাবল ডাবল, ট্রিপল কিংবা আরও আরও... আবার ঠিক একই সময়ে দুই-দুইটি কাজের হাতছানি, দুই দুইটি স্বাপ্নিক ব্যাপার, দুই দুইটি ঘটনার অঘটন সম্পন্ন হবার ব্যাপারটিও ঘটেছে একাধিকবার। এইটা খুবই এনজয় করি আমি।

জীবনে যেদিন প্রথম চাকরির জন্য ইন্টারভিউর তারিখ পড়লো, যে সময়টায় পড়লো ঠিক একই সময়ে থিয়েটার স্কুলে ভর্তির পরীক্ষা! চাকরির বারোটা বাজিয়ে ছুটলাম থিয়েটার স্কুলে ভর্তি হতে... যেদিন বড়ো ভাইয়ের বিয়ে সেদিনই পাবলিক লাইব্রেরিতে জাতীয় শিশু কিশোর নাট্যোৎসবে আমার রচিত ও নিদের্শিত একটি নাটকের প্রদর্শনী। বেছে নিলাম নাটকের প্রদর্শনীকেই।

দিল্লীতে সার্ক লিটারেরি ফেস্টিভ্যালে প্রকাশক হিসেবে আমন্ত্রিত হলাম। খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম। কিন্তু একদিন পরেই ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। অতিথির সম্মান বাদ দিয়ে ছুটলাম দর্শনার্থী হিসেবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা পরিদর্শনে। যে বছরটায় শুরু হলো জীবনসংসার নামের নতুন একটি অধ্যায়ের সেই বছরই অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আমার প্রথম স্টল নেয়ার অভিজ্ঞতা। সেই অর্থে বইজীবন আর বউজীবন আমার হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে সমান্তরালে।

প্রায় এক যুগ। বইজীবনে প্রোডাক্ট পাঁচ শতাধিক। যদিও অভিজ্ঞতা বলে প্রকাশক বই নামের প্রোডাক্টের মালিক নিজেদের বলতে পারেন না। তবে পাহারাদার বলতে পারেন। কারণ এই প্রোডাক্টের মালিক লেখক। লেখকের মর্জি রক্ষার দায়িত্ব প্রকাশকের। মর্জি ভালো তো প্রোডাক্ট ঘরে, মর্জি খারাপ তো প্রোডাক্ট ভ্যানিশ!

ফ্ল্যাশব্যাকে যদি বইজীবন আর বউজীবন নিয়ে গবেষণা করি তাহলে নির্দ্বিধায় দেখতে পাই, বউকে বাদ দিয়ে বইয়ের দিকেই ছুটে গেছি বারবার, বহুবার। বউ শুধু দেখেছে। তাকিয়ে থেকেছে। মুখ দিয়ে নয়, কথা বলেছে চোখ দিয়ে। অসংখ্যবার অনেক কিছু বলার চেষ্টা করেছে। এখন বুঝতে পারি অনেক কিছুই শোনা হয়নি। শুনিনি। বউয়ের চোখে বহুবার অসহায়ত্বের ছাপ রেখে ছুটে গেছি কত কত সম্পর্ক নির্মাণ আর বিনির্মাণে। থাকেনি অনেক সম্পর্ক। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে লাভক্ষতি, দেনা আর পাওনার অজুহাতে। পকেটে ক্যালকুলেটর আর ব্যাগে হিসেবের খাতা নিয়ে ঘোরাফেরা করা সেই সকল সম্পর্কের পেছনে ব্যয় করা সময় আর মুহূর্তগুলো এখন আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। আমি চোখ ঘোরাতে চাইলেও পারি না। চোখ ঝাপসা হতে চায়। কিন্তু হতে দিই না। যে জীবন গ্যাছে, যে সময় গ্যাছে তার দিকে তাকিয়ে অযথা দুঃখ বাড়ানো আমার পোষায় না। আমি নতুন দিকেই ছুটতে চেয়েছি একটা জীবন। ছুটেই চলেছি বারবার।

আর এই ছুটে চলার সাহসটা পেয়েছি হয়তো সংসার নামের মায়াটা টিকে গেছে বলেই। টিকে আছে বলেই। হ্যাঁ, এখনও দিব্যি টিকে আছে বউয়ের ঘর। সংসার নামের এক অদ্ভুত মায়ায় তাই টিকে আছি একটা যুগ। বউজীবনে প্রোডাক্টের সংখ্যা দুই। বর্ণ আর বিভোর। তাদের নিয়েই ঘরদোর।

এখন প্রতিটা মুহূর্ত ‌ক্যালকুলেটের আর হিসেবের খাতা নিয়ে আমারও বসতে খুব ইচ্ছে হয়। একসময়ের অধস্তন, কমবয়সী কিংবা অদক্ষ-অযোগ্যরা যখন চোখের সামনে দিয়ে এসি গাড়িতে বসে সাঁইসাঁই করে ছুটে যায় আমি তখন রিকশায় বসে নেচারাল বাতাসেই কেন স্বচ্ছন্দ? প্রশ্ন করি নিজেকে। বারবার করি একই প্রশ্ন। উত্তরও খুঁজি।

উত্তর মেলে না। একসময় টের পাই, সংসার নামক যে প্রতিষ্ঠানটি টিকে গেছে কিংবা যার জন্য টিকে গেছে, সেই নির্মোহ মানুষটির সঙ্গ পেয়েছি বলেই হয়তো মোহ বা লোভ-লালসা-প্রাপ্তির খাতাটা কখনও খুলতেই ইচ্ছে করেনি। আজ সেই নির্মোহ মানুষটির সঙ্গে সংসারজীবনের কঠিন অথচ মায়ার বাঁধনে ১১টি বছর কাটিয়ে দেয়ার দিন। আজ মৌয়ের বৌ হবার দিন। এই দিনটাতেই পেয়েছিলাম তাকে। যদিও কখনও তাকে বলা হয়নি মুখে। "পাইলাম। আমি তাহাকে পাইলাম"।

লেখক: প্রকাশক, ভাষাচিত্র প্রকাশনা সংস্থা