গুলজার

গুলজার

গুলজারের ৫ কবিতা

জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

প্রকাশিত : আগস্ট ১৯, ২০২০

সম্পূরণ সিং কালরা। পৃথিবী তাকে গুলজার নামে চেনে। ১৮ আগস্ট ছিল তার জন্মদিন। ১৯৩৬, মতান্তরে ১৯৩৪ সালের ১৮ আগস্ট দিনায় শিখ পরিবারে তার জন্ম। দিনা ব্রিটিশ ভারতের ঝিলম জেলা, বর্তমানে এটা পাকিস্তানে অবস্থিত। দেশত্যাগের পর চলে আসতে হয় দিল্লির রওশন আরা বাগে। সেখানে ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করেন তিনি। বম্বের (মুম্বাই) খালসা কলেজ এবং ন্যাশনাল কলেজ কম্বেতে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন বিদায় জানান প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াকে। সাহিত্য, সংগীত ও চিত্রকলার সঙ্গ এবং চমৎকারিত্ব কবিতা-পাগল মাতৃহীন একাকী যুবককে গড়ে তুলছিল কবি করে, শিল্পী করে। পরবর্তী সময়ে চলচিত্রের বর্ণাঢ্য জগতে তার কৃতীয় অবদানের জন্যে সকলেই তাকে চেনে, কখনো গীতিকার, কখনো চিত্রনাট্য রচয়িতা, কখনো চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি কবি গুলজার। তরুণ কবি সঙ্গীতা দাশ তার দুটো কবিতা মূল হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। গুলজারের জন্মদিনে ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে এই শ্রদ্ধার্ঘ্য...

পোশাক

আমার জামা কাপড়ের মাঝে টাঙানো রয়েছে
তোমার পোশাক
বারবার কেচে দিই আমি, আর শুকিয়ে নিয়ে
নিজের হাতে ইস্ত্রি করি,
তবু ভাঁজের দাগ মোছে না তার।
শত ধুয়ে তুলতে পারি না অতৃপ্তি, অভিযোগের কালশিটে

জীবন কত সহজ হতো
যদি সম্পর্ক পোশাক হতো
আর বদলে নেয়া যেত কামিজের মতো।

বই

বন্ধ আলমারির কাচ থেকে উঁকি দেয় বই
বড় সাধ নিয়ে চেয়ে থাকে তারা।

মাসের পর মাস দেখা হয় না আমাদের আর
যেসব সন্ধ্যা কাটত তাদের আসঙ্গে,
এখন প্রায়ই কেটে যায় কম্পিউটরের পর্দায়।
বড় উতলা হয়ে থাকে বই...
ঘুমের ভিতরে হাঁটার অভ্যাস হয়েছে তাদের এখন।
বড় সাধ নিয়ে চেয়ে থাকে তারা।

যে বোধের কথা শুনিয়েছিল বই,
যা অবিনশ্বর,
সেসব আর খুঁজেও মেলে না এই ঘরে।
যে সম্পর্কের বুনট শোনাতো বই
আজ সব অকৃত, বাঁধন ছেঁড়া।
একটি পৃষ্ঠা ওল্টাতে দীর্ঘশ্বাস উড়ে যায় কেবল

কত শব্দের অর্থ ঝরে পড়েছে
কথাগুলো যেন পাতাহীন শুকনো ডাল
যে শব্দ জন্ম দেবে না আর কোনো বোধ
কত সব প্রাচীন ঐতিহ্য
মাটির পেয়ালার মতো পড়ে আছে বিক্ষিপ্ত।
কাচের গ্লাসের কাছে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে সেসব।

জিভে আস্বাদিত হয়েছিল যে পাতা ওল্টানোর স্বাদ
এখন আঙুলের একটি ক্লিকে একটি পলক পড়ে কেবল
একের পর এক খুলে যেতে থাকে সব পর্দায়
বইয়ের সাথে যে যোগাযোগ ছিল জন্মান্তরের,
ছিঁড়ে গেছে।
কখনো বুকের উপরে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি,
কখনো কোলের উপরে,
কখনো হাঁটুর উপরে রেখেছি,
যেন পুঁথিপুটে ঝুঁকে বসেছি প্রার্থনার মতো,
মন্ত্রোচ্চারণে ছুঁয়েছি।

সেসব অধীত জ্ঞান তো মিলবে এর পরেও
কিন্তু সেই যে বইয়ের ভিতরে হঠাৎ পাওয়া যেত,
শুকনো ফুল
আর সুগন্ধি চিঠি
বই ধার নেয়া,
হাত থেকে পড়ে যাওয়া আর কুড়িয়ে নেয়ার অজুহাতে গড়ে উঠত যে সম্পর্ক,
তাদের কী হবে?
সেসব হয়ে ওঠা হয়তো হবে না আর!

ভ্রমণ

কাল ঘুরতে নিয়ে যাব তোমায়
সমুদ্র ঘিরে যে চক্রাকার রাস্তা
রাত্তিরে হারের মতো ঝলমল করে সমুদ্রের গলায়

অনেক দূর যাব ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে
ঘোড়ার খুরের শব্দে কিছুক্ষণের জন্য মনে হবে
আমরা রাজা

গেটওয়ে অব ইণ্ডিয়ায় তাজমহল হোটেল দেখবো
বিদেশ থেকে জোড়ায় জোড়ায় আসে হনিমুনে,
এখানেই এসে ওঠে

আজ রাতে ফুটপাথে ইট রেখে
ইরানি হোটেল থেকে পাওয়া বিরিয়ানি গরম করি
আর আজ রাতে হনিমুন পালন করি চলো এই সিঁড়ির নিচে।

মাটি জাদু জানে

কিছু একটা আছে আমার এই বাগানের মাটিতে
এ জমি কি জাদুকরি?
মাটি জাদু জানে!

যদি পেয়ারার বীজ পুঁতি, এ পেয়ারা দেয়
যদি আধখাওয়া জাম ফেলি মাটিতে তো জামও দেয়
করলা দিলে করলা... লেবু থেকে লেবু!

ফুল চাই যদি, গোলাপি ফুল দেয়
যে রঙ দিই আমি, সেই রঙ ফিরিয়ে দেয়।
মাটির গহীন অন্তরে লুকিয়ে রেখেছে সব রঙ?
অনেক খুঁড়েছি কিন্তু বেরোয় না কিছু...!
মাটি জাদু জানে!

মাটি জাদু জানে
খেল দেখায় অনেক
লম্বা নারকেল গাছ তুলে ধরে এক আঙুলে
পড়ে যায় না!
খুব ঝাঁকায়, হাওয়ায় এলোমেলো দোলে
মাটি কিন্তু স্থির রাখে বৃক্ষ।

শরবত, দুধ, জল আমার হাত থেকে
কিছু পড়লেই ঢকঢক গিলে নেয়
কত জল খায় মাটি!
যতই দাও গিলে নেয়
জগে করে দাও অথবা বালতিতে
অথবা সারাদিন ধরে কল খুলে রাখো
অদ্ভুত পেটুক, পেট ভরে না কিছুতে
শুনেছি, নিজের ভিতরে লুকিয়ে রাখে নদী!

মাটি জাদু জানে!

মাটির নিচে কি চিনির গুদাম আছে?
অম্লের পাথর আছে কোনও?
ফলের ভিতরে এমন মিঠে ভরে দেয় কিভাবে?
কোথা থেকে আনে সব?

ডালিম, বরই আর আমের ভিতরে, আপেলের ভিতরে
মিষ্টি, সব মিষ্টি আবার আলাদা আলাদা
পাতা বিস্বাদ অথচ ফল মিঠে
মুসম্বি মিষ্টি আর লেবু টক!
নিশ্চিত জাদু জানে মাটি!

ওদিকে দেখ, বাঁশ স্বাদহীন, নীরস
আর আখের ভিতরে এত রস?

মাটির হাতে কি চুম্বক আছে?
যা উপর থেকে পড়ে সব মাটির কাছে যায়
পাখি হোক বা উল্কা!
মাটি জাদু জানে!

কুয়ো বোজানো হচ্ছিল

কুয়ো বোজানো হচ্ছিল
দম আটকে আসছিল কুঁয়োর
কয়েক মণ মাটি ফেলা সারা
বহু তক্তা কাটা হয়েছে

দু’ধার থেকে লোহার রড সাজিয়ে
প্রবীণ মিস্ত্রী ডেকচিতে সিমেন্ট গুলে ছড়িয়ে দিচ্ছে চারধারে
কুয়ো বোজানো হচ্ছিল।

ডানা ঝাপটিয়ে কুয়োর জলে স্নান সারতো
চিন্তিত সে আজ...
পিপুল শাখায় উড়ে বেড়িয়েছে সারা দুপুর
বড় অস্থির হয়ে আছে ঘুঘু।
সন্ধিৎসু পাখি বুঝতে পারে না
একটা জ্যান্ত কুঁয়োকে মানুষ কেন কবর দিচ্ছে!