রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে একটি পাণ্ডুলিপি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে একটি পাণ্ডুলিপি

ঘামরাঙা আঁকবাঁকা পরিশ্রমের ইতিবৃত্ত: কবিদের পাণ্ডুলিপি

রথো রাফি

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২০, ২০২৩

মসৃণ, নির্ভুল, সুসজ্জিত ও নির্মেদ কবিতা পড়তে পড়তে আমরা প্রায়শই এসব লেখার পেছনে কবিদের বিপুল ও দীর্ঘকালীন, সচেতন ও সংবেদনময় পরিশ্রমের ইতিবৃত্তটি ভুলে যাই। বলছি কবিতা লিখতে চাওয়া লোকের উদ্দেশ্যে। এমনতর লেখার এটাও একটা প্রলক্ষণ যে, ভালো লেখা নিজের গা থেকে পরিশ্রমের ঘর্মচিহ্নসমূহ তুলোটকাগজের মতো শুষে ফেলে। ফলে পড়ার সময় আমাদের পক্ষে পরিশ্রমের এই ইতিবৃত্তটি উপলব্ধিতে আনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমি নিজেও এ বিষয়টি ভুলতে বসি অনেক সময়। তখন ভাবি, অনেকেই হয়তো এই বিপুল পরিশ্রমের গোপন অধ্যায়টি বিস্মৃত হতে চান আমার মতো। আর ভুলে গিয়ে একসময় ভাবেন, লেখা ভালো হচ্ছে না বা অন্য কিছু। উৎসাহের হিম পরিস্থিতি তাকে ঘিরে ফেলে।

 

এ সময় কবিদের পান্ডুলিপি হয়তো আমাদের অনেকটা উদ্ধার করতে পারে, পরিশ্রমী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে উদ্দীপক হতে পারে। এটা কিন্তু ততটা পরনির্ভরতা নয়। একজন কবি ভাষা ও শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে, বিষয় ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেমন নিজ ভাষা এবং নিজ সংস্কৃতির কাছেই সাধারণত হাত পাততে বাধ্য হন, এই বিষয়টিও তেমনি। তবে এটা একধরনের ন্যূনতম পরনির্ভরতাও, যেখানে প্রতিভাবানের সাথে প্রতিভাবানের কথাপোকথন চলে, আত্মঅক্ষচ্যুত না হয়েই।

 

আহা, লিখতে লিখতে লেখার ভিতর শব্দ কাটতে কাটতে কাটাকুটি কিভাবে একইসাথে কবিতা ও ছবি হয়ে উঠতো তার পান্ডুলিপিতে। কাটা অংশগুলি জুড়ে গিয়ে অনাকাঙক্ষার পটভূমি বা জগৎ যেন সমমূল্যে ও সমমর্যাদায় জাগ্রত হতে চায়। ফলে লেখার ফাঁকে ফাঁকে এক ত্রুটি থেকে আরেক ত্রুটির দিকে লতিয়ে চলে রেখা, গোচর হতে থাকে ত্রুটির আত্মীয়তা নির্মাণ। লেখায় অবহেলিত হলেও ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাদেরও আলাদা মূল্য রয়েছে। সেই দাবিতেই তাদের এই হয়ে ওঠা। এবার ক্রটি-লেখা হয়ে ওঠলো ছবির পটভূমি। লেখা ও ছবি: একই পটে দুটি সহোদর, একই তলে ভাসমান ও সহাবস্থানরত। যেন শেওলা ও কুচুরিপানা, কিংবা ফসল ও আগাছা দুটিই সমগুরুত্বপূর্ণ। বরীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গেই এসব বলা। কবিতা শুধু নয়, ছবি শুধু নয়, উভয়ই: ছবিতা।

 

পুষ্কর দাস গুপ্তের কথা মনে পড়ছে, এ প্রসঙ্গে, যিনি ছবিতা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের থেকে পুষ্করের উদ্দেশ্য ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথে রেখা আর কবিতা পাশাপাশি একে অপরের ফাঁকে অবস্থান করলেও যেন দুটো আলাদা সত্তা যেন যমজ বলে প্রতীয়মান, তিনি কবিতা আর ছবিকে একদেহ বা একাত্মা করতে চাননি। কিন্তু পুষ্কর তা চেয়েছিলেন, তার ক্ষেত্রে কবিতা ও ছবি একই দেহে মিশে যাওয়া একে অপরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অর্থাৎ একীভূত সত্তা, আলাদা-কিছু নয় যেন, ভেদরেখা লীয়মান, কিন্তু লুপ্ত নয়, সূক্ষ্মশ্রমে উদ্ধারযোগ্য।

 

কিভাবে ছন্দের স্রোতে ভেসে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত কুচুরিপানা, আর তা দু’হাত ঠেলে সরাতে হয়, তারই অভিজ্ঞান এসব, বয়স্ক, দীর্ঘশ্রমে সমৃদ্ধ রবীন্দনাথেরও এ কাজ চালিয়ে যেতে হয়, নিরবিচ্ছন্নভাবে, আর কাঙ্ক্ষিত শব্দ সাধনের ধ্যানে, তা আমাদের অনুপ্রেরণা হতেই পারে বৈকি। স্বতঃস্ফূর্ততা সে অনুধ্যানের ধন, ধূলো ঝেড়ে পাওয়া তুচ্ছ কিন্তু দুর্লভ ও মহামূল্যবান স্বর্ণকণা। যার প্রতিভায় একাধিক জাতির পাঠক ও বিজ্ঞ সমালোচক ও চিন্তাশীল পণ্ডিতরা মুগ্ধ, তারই চালিয়ে যেতে হয় এমনতর কাণ্ডকারখানা, বড় অনায়াস নহে প্রতিভারও সোনার ফসল- এই উপলব্ধিই কবিদের পান্ডুলিপির এক বড় উপহার আমাদের প্রতি!

 

স্বতঃস্ফূর্ততা একা আসলে কিছুই নয়। শিশুরা কি এ গুণ থেকে বঞ্চিত? না। কোনো মানুষই বঞ্চিত নয় এ গুণ থেকে। কই শিশুরা, বা যে কেউই, একটা ভালমানের কবিতা যে কোনো মুহুর্তে বা আকস্মিকভাবে কখনই লিখতে পারে না তো। স্বতঃস্ফূর্ততা নাকি অন্য কিছুর অভাব তার? অভাব তার অভিজ্ঞতার। কবিতা লেখা ও শ্রমের ভেতর দিয়ে ভাবনাকে প্রকাশের অভিজ্ঞতার, পাঠের ভেতর দিয়ে ভাবনার দশদিগন্ত ঢুঁড়ে বেড়ানোর, অভাব তাকে সংবেদন-অনুবাদের দক্ষতার। এই সব কিছুই শ্রমের ব্যাপক অনুশীলনের ভেতর দিয়েই অর্জিত হয়। শ্রমের ভেতর দিয়েই অর্জিত হয় ভাষা।

 

স্বতঃস্ফূর্ততা শব্দটির পেছনে আসলে দীর্ঘকালীন অনুশীলনের অকথিত ইতিহাস রয়েছে, যদিও তা কেমন অপ্রধান হয়ে পড়ে পাঠকের কাছে। কোন কবির জীবনের প্রথম কবিতাটি কেন একটা সফল কবিতা হয় না, তা কি ভাবি আমরা? তা হলে আর আমরা কেবল স্বতঃস্ফূর্ততার কথা বলতাম না; এর সাথে যোগ করতাম আরো অনেক বিষয়ই। আর এটা সত্য যে, এতো কিছুর পরও স্বতঃস্ফূর্ততা অর্জিত না হলে লেখকের লেখা চালিয়ে যাওয়া মুশকিল শুধু নয়, এ না হলে, শিল্পমানে, সুরে, স্বরে, স্বাতন্ত্র্যে বেজে উঠে না সংবেদন-প্রজ্ঞার যুগল উদ্ভাসনা।

 

রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপিতে ত্রুটিগুলো ছবি হয়ে উঠতে গিয়ে যেখানে কালি লেপ্টে গেছে, ঢেকে ফেলেছে প্রথম প্রয়াসের ভেসে আসা শব্দগুলোকে, সেখানে আর শব্দগুলো উদ্ধার করতে পারি না, পাণ্ডুলিপি পাঠে। জানতে পারি না হারানো শব্দটির বদলে যে শব্দটি আজ পাঠের সুযোগ পাচ্ছি, তা কি ঐ শব্দের পুরো বদলি, নাকি আংশিক, সমার্থক নাকি বিপরীতার্থক। নাকি প্রসঙ্গ পাল্টানোর কারণে, নাকি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কারণে পুরোই বদলে গেছে। কবিতাটিতে ফলে সূরের, বা বিষয়ের, বা ভাবনাদ্যূতির কি পরির্বতন ঘটেছে। উজ্জ্বল না নিস্প্রভ করার কাজে এসেছে, জানতে পারি না আর। অর্থাৎ, কবির গোপন কাজের একটা অনুধাবনরেখা আর অনুসরণ করতে পারি না। হয়তো বা এখানে ছিলো কবিতাকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করার কোন নতুন প্রকৌশল। কবি হিসেবে হয়তো সেখানে একধরনের ঠকার সূক্ষ্ম অনুভব জাগে আমাদের। কিন্তু পাঠক হিসেবে সেখানে কবিদের জয়ই ঘোষিত হয়। আবার কবিদের নোট বইটাই নাকি আসল, বলেছিলেন মায়াকোভস্কি, তবে তা যার নোটবই তার চর্চার জন্যে, আর বলেছিলেন, আসলে তা অন্যের কাজেও আসতে পারে, সেটাও কম নয়।

 

এবার আসি জীবনান্দ দাশে। রূপসি বাংলার পান্ডুলিপি দেখলে মনে হয়, কি পরিশ্রমটাই না করতে হয় একজন কবিকে, একটি শব্দের সংকোচন বা প্রসারণ ঘটিয়ে কবিতার অভিপ্সা-অনুকুল স্বরের সাথে ও পটভূমির সাথে দারুণভাবে মিলিয়ে দিতে, আরও শক্তি শালী করে নিতে কবিতাকে, আরও মুগ্ধতা ও মগ্নতা সঞ্চারী করতে বাগভুবনকে। কবিদের মাথায় যে অসীম যাচাই বাছাই, সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার যে বিপুল যজ্ঞ, তার-ই কণামাত্র মূর্ত হয়ে আছে পাণ্ডলিপির ঐসব পৃষ্ঠায়।

 

আবার সুধীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৬ বছর পর কবিতার সংস্কার করে চলা, এবং যেখানে তিনি সংস্কার চালিয়েছেন, সেই কপিটা দেখতে পেলেও আমাদের হয়তো অনেক উপকারে আসতো।

 

সমর সেন তার ছাপা কবিতাকে পুনরায় সংশোধন করে কাব্যগ্রন্থে স্থান দেন। তার কাব্যিক-বাক্যে শব্দের এমন অদলবদল আমাদেরকে অনেক শিক্ষা দিতে পারে।

 

টিএস এলিয়ট তার বিখ্যাত কবিতাটা তো সম্পাদনার জন্য এজরা পাউন্ডকেই দিয়ে দেন। এবং সম্পাদনার পর প্রকাশ হয়ে পৃথিবী তোলপাড় করে ফেলে। কিন্তু আধুনিক কবিতার ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী ভাবনার বিশুদ্ধতা এখানে বেশ মার খায় না কি? সে শুধু কবিতার স্বার্থেই। একজনের কবিতায় অন্যের হাত চলবে না, তাকে নাকচ করে দেয় শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবির শ্রেষ্ঠ কবিতাটি। তার ওই কবিতার পাণ্ডুলিপি আমাদের সে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দেয়!

 

ডব্লিউ বি ইয়েটস তার এক কবিতা দ্যা ডাব (এগনিয়াসের প্রতি) এর শেষ দুই লাইন কেন কেটে দেন বহুবছর পর? একবার লেখা হয়ে গেলেও কবিতাটির লেখা বা পরিমার্জন যে অনেকবছর ব্যাপী বা বহুবছর পরও অনুভূত হতে পারে সে কথা আমরা কজন ভাবি? একটা লেখা এভাবে নিজের ভেতর লেখকের মনন পরিবর্তনের সাপেক্ষে কত নাজুকভাবে কম্পমান, তা ভাবলে লেখার অক্ষত চেহারা বলে কিছু তো লেখকের কাছেই টিকে থাকে না। কিন্তু এই দীর্ঘকালীন রদবদল দুর্লভ বলেই আমাদের বাঁচোয়া। ইয়েটসতো প্রথমে প্রবন্ধ বা গল্পের মতো রূপরেখা তৈরি করতেন, পরে ক্রমে ক্রমে কবিতায় উত্তীর্ণ করতেন সেটাকে। গদ্য কবিতাকে ছন্দোয়ময় কবিতায় প্রকাশ করাও কবির অভিপ্রায় হয়ে উঠতে পারে। এবং দুটো দশাই প্রকাশিত অবস্থায় আছে বোদলেয়ারে।

 

তো একই কবিতা দুই ধরনে, নাকি দুটি আসলে একই বিষয়ে হলেও দৃষ্টিকোণের কোথাও হয়তো ভিন্নতা নিয়েই বিরাজ করছে এক আত্মার দুই দেহ? আমরা সাধারণত এটা খেয়াল করি না। তবে তাও বিবেচনায় আনা জরুরি নিশ্চয়। আর স্বতঃস্ফূর্ততার কথা যদি বলি, একই লেখা দুই ধরনের বাক-কাঠামো নিয়ে কিভাবেই বা বিরাজমান থাকে, আমাদের চোখের সামনে?

 

আবার অনেকে একই কবিতা খণ্ড খণ্ড করে বহু বছরে একটি কবিতাকে পূর্ণতা দেন। তাদের ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততার মুহূতর্গত অস্তিত্বকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবো আমরা? কিংবা যখন একজন কবি একটা পঙক্তি নির্মাণে হাজারটা বিন্যাস ঘেটে একটা গঠনকে বাছাই করেন, এবং ছন্দের সাথে বা স্বরের সাথে বা চিন্তার সাথে বা সংবেদনের বা আবেগের সাথে খাপ খাইয়ে নেন? লিখনোত্তর একটা বাগসংগঠনের দেখা পাই আমরা। কিন্তু লিখন-মূহুর্তে, বা পরে হাজারো পরিমার্জনা আর সংশয়ের তর্কাবর্ত বাদ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ততাকে কিভাবে ভাববো আমরা? পাণ্ডুলিপি এই জটিলতা উপহার দিয়ে হয়তো স্বতঃস্ফূতর্তা নিয়ে যে সংস্কার তাকে পরিশোধন করে দিতো, আরো একটু নিখুঁত করে তুলত।

 

লেখক: কবি