
চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী
পর্ব ১৪
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : এপ্রিল ৩০, ২০১৯
বেশ কিছুদিন যাবৎ বলবো বলবো করেও কিছু বলে উঠতে পারছি না। মনের ভেতর অজস্র শব্দ বুদবুদের মতো ভেসে উঠে আবার তলিয়ে যাচ্ছে কোথায়? এ কি অদ্ভুত এক বিতৃষ্ণা! এমনও হয়। কাউকেই আর কিছু বলার ইচ্ছে নেই যেন আমার, ততটুকুই বলা যতটুকু না বললেই নয়। এ আসলে অনেক বেশি বলতে চেয়ে সামান্যই বলে উঠতে পারার ক্লান্তি। কত প্রতিবাদ গলা অবধি উঠে এসে দলা পাকিয়ে আটকে গেছে রোজ। সেই না বলা ভাষাদের অনেক অভিমান যেন আজ ফেনার মতো তলিয়ে যাচ্ছে গভীরে। এ জীবন যতটুকু অবলোকন করা যায় আমার যৎসামান্য মনে হচ্ছে, লাইক দ্য টপ অফ অ্যান আইসবার্গ! তলানির খবর মেলে তখন যখন কোনো জাহাজ এসে ধাক্কা খায়, ভেঙে দু`টুকরো হয়।
ইচ্ছে করে কোনো পাহাড়ের মাথায় গিয়ে বসি, শীতলে। শুভ্র তুষার যেখানে ঢেকে রেখেছে অরণ্যের বুনো যৌবন, তাকে গলানোর সাধ্য নেই কোনো তাপাঙ্কের। ইচ্ছে করে বসি ধ্যানাসনে, যোগমুদ্রায়। কঠোর তপস্যার বিহ্বলতাহীন অতীন্দ্রিয়যোগে ইচ্ছে করে দেখে নেই যা ইন্দ্রিয়াতীত। ইচ্ছে করে সেই মহাশূন্যতার প্রেয়সী হতে।
একবার এক শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি আমাকে নিরীক্ষণ করে বলেছিলেন, ‘তোমার সন্ন্যাস যোগ আছে। কপালের রেখাগুলি তাই বলে।’ কেমন সে সন্ন্যাস তা জানা নেই, তবু শেকল কাটা বা শিকড় থেকে বিচ্ছিন্নতার যে তাড়না তা যে আসলে ব্যথা সহ্য না করতে পারার ভয় তা জানি। ব্যথার প্রতি এত সঙ্কোচ কিসের? নাকি আনন্দ বেদনা অতিক্রান্ত কোনো অতিস্থির জলাশয়ে নিজেকে নিমজ্জিত রাখার জন্য এই তপযোগ! আমাদের গাড়ি চালাতো এক ভাই, সে প্রায় দার্শনিক, একদিন বললো, ‘আচ্ছা, এই যে লোকনাথ বাবা বলেছেন, রণে বনে জঙ্গলে যেখানেই হোক বিপদে পড়লে তাঁকে স্মরণ করতে, তা তিনি সংসারের বিপদের কথা কিছু বললেন না কেন?’ আমি বললাম, ‘সে সময় তুমি হনুমানকে ডেকো।’ আসল কথা হলো ওই `রণ`, `বন` , `জঙ্গল` তিনটেই হলো সংসার, কিংবা সংসার তার চেয়েও দুর্গম। যে তা অনুভব করেনি, সে হলো গিয়ে ওই সুখী কি এক জন্তু আছে তার মতোই, স্থূল!
আজকাল মনে হয়, সব শব্দ উচ্চারণ না করাই ভালো। এক একটি শব্দের মধ্যে দিয়ে অনেক আগুন ক্ষয় হয়ে যায়, যে উত্তাপ বেঁচে থাকার জন্য জরুরি। তবে আমার মতো একটা কম কথা বলা মানুষ আরো নীরব হয়ে গেলে যে বিপদ তা বুঝি। আবার আমার মতো একটা শান্ত মানুষ যে ভেতরে ভেতরে অসম্ভব বেপরোয়া ও উদ্ধত হতে পারে তাও সকলের অবিদিত নয়। যেটা আজকাল ভীষণ ভাবে জ্বালাচ্ছে তা হলো ,`মুড সুইং`। তাই অনেক ফোন ধরি না, অনেক মেসেজের রিপ্লাই দেই না। কি বলতে যে কি বলে ফেলবো তখন বিপদ হবে।
বরং অন্য জীবনটাকে জানতে ইচ্ছে করে, ঘুরিয়ে দেখলে নিজেকেই। ভূতের সিনেমা এনজয় করতে গেলে যে গুণটা লাগে, অর্থাৎ `সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ` (অবিশ্বাসের প্রত্যার্পণ), সেটা না থাকলে নিজেকেও জানা হয় না। নিজেকে জানতেই বিশ্বাস লাগে সব থেকে বেশি। ভূতের সিনেমা দেখতে বসে কেঁপে উঠি বলে যারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টাটি করে, তারা আসলে অন্যত্র আমার এই শিহরণ দেখতে পায় না বলেই তো করে।
একসময় ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র নিয়ে অনেক পড়াশুনো করেছিলাম। সে কথা জানলে অনেকেই, মানে পুরুষমানুষগুলোর কথাই বলছি আরকি, সরাসরি তাদের হাতটা আমার কোলের দিকে বাড়িয়ে দিতো, ‘একটু দেখে দাও না প্লিজ।’ আমি যত বলি, ‘আরে হাত নয়, হরোস্কোপটা দাও,’ সে তো কিছুতেই বোঝে না ভাগ্যান্বেষীর দল। সেরকম, সবকিছুর জন্যই একটা নিমিত্ত লাগে, কিংবা ছল! যেমন, আমার এই না বলতে চাওয়া...
তা বলে, আমাকে ছলনাময়ী ভাবলে ভুল হবে। আমি মোটেও তা নই। লগ্নপতি শনি আমার তুঙ্গে। আমি তপস্বিনী...
লেখক: কবি