
চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী
পর্ব ১৫
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : মে ০২, ২০১৯
বরাবরই বয়োজ্যেষ্ঠদের ভালোবাসা পেয়েছি আমি, নারী পুরুষ নির্বিশেষে। একটা অতিরিক্ত আদরও। এটা আসলে ওয়েভ লেনথের ম্যাচিং। আমার থেকে বয়সে দশ কুড়ি ত্রিশ চল্লিশ বছর এগিয়ে আছে যারা তাদের পার করে আসা পথে প্রতি দশ কিলোমিটার অন্তর আমার মানস যাত্রায় আমি রেখে এসেছি এক একটি কাল্পনিক মাইলস্টোন। বয়স তো কেবল এক সংখ্যামাত্র। সত্তর বছর বয়সেও মানুষ কি ভয়ঙ্কর অপরিণত ও অনভিজ্ঞ হতে পারে, তাও দেখেছি। বাট আই অলয়েজ ওয়ান্টেড ট্যু লুক বেয়ন্ড... ট্যু দ্য ফার অফ... যাকে বলে কিনা `সু... দূর` অবধি।
নিপুণ মায়ের সাথে যখন দেখা হয় তখন আমার বয়স তেইশ। উনি বললেন, ‘কে বলেছে? তোর পাক্কা আশি!’ তা বলে যে আমি সবই দেখতে পেয়েছি, এমন নয়। আমার অনেক স্বপ্নালু বিভ্রম আছে। আমি অনেক মরীচিকাও দেখেছি। মোটের ওপর সেটা দেখতে পাইনি, যেখানে দেখার মতো কিছু আছে বলে আমার জানাই ছিল না। আসলে সবটাই তো চেতনা কিংবা সচেতনতার এক একটি স্তর। সবগুলোকে স্পর্শ করা যায় না এক সুরে বাঁধা তানপুরায়।
যারা আমার সমবয়সী ও বন্ধু, তাদের আমার ওপর অন্য এক অধিকারবোধ আছে। তারা আমাকে বুঝলো কি না বুঝলো, তাতে তাদের ভারি বয়ে গেছে। তারা আমাকে না বুঝেই ভালোবাসে, কিংবা খ্যেপু ভেবে সঙ্গ দেয়। আমিও এভাবেই তাদের সাথে চলতে পছন্দ করি, যেখানে আমার গ্রহণযোগ্যতার কোনো বিশেষ মাপকাঠি নেই। যেখানে আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশেষ সচেতনতারও প্রয়োজন হয় না। আর যারা আমার থেকে ছোট তাদের অনেকাংশের কাছেই আমি দূরের কিংবা দুর্বোধ্য। এই দূরত্ব ভাঙা বা গড়ার ভেতর কোথাও আমার কোনো সচেতন প্রয়াস নেই।
জীবনে প্রভাবিত হওয়া আর প্রভাবিত করা— এই দুইয়ের মধ্যে প্রথমটা কোনো পূর্বনির্ধারিত শর্ত মেনে হয় না। কারণ প্রভাবিত হওয়ার একটি বয়স থাকে, যে বয়সে মানুষের সারল্য থাকে। প্রভাবিত হওয়ার বয়সে প্রভাবিত করার পূর্বনির্ধারিত শর্ত মেনে যে বাসের পাশের সিটটিতে এসে বসে আমি তাকেই বলি, `ভাগ্য`। তারপর সে নিজের মতো করে কখনো বা দুমড়ে মুচড়ে কখনো টানটান করে বেঁধে যেমন খুশি ভেঙে গড়ে নেয় আরেকটি জীবনকে। জীবনে এমন এক একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসার অভিজ্ঞতা হলো এক একটি মাইলস্টোন। কারো কারো জীবনে এমন মাইলস্টোন বা টার্নিং পয়েন্ট একাধিকবার এসে পড়ে।
কে কতখানি প্রভাবিত হয়েছে তার ওপরেও নির্ভর করে কে কতখানি প্রভাব ফেলবে। একটা বয়সের পর প্রভাবিত হওয়া সহজ নয় আর, মনটা যখন ভেঙেচুড়ে একেবারে দুরমুশ হয়ে গেছে, অথবা সারল্য নেই আর তেমন করে। কিন্তু প্রভাবিত করার জন্য অতিরিক্ত এক শক্তি চাই, যেটা খাটানোর মতো ইচ্ছা না থাকলে ওই নিজের ভেতর কেবল এক দিকশূন্যপুর হয়ে বসে থাকা।
আমি তিনটে মাইলস্টোন পার করে এসেছি এখনো অবধি, জানি না আর কতগুলির অপেক্ষায় আছি। তবে পিছিয়ে না যেতে চাওয়ার মতো অনমনীয়তা বা গুণহীনতা যাই বলো না কেন, তার দরুণ কারো কারো কাছে দুর্বোধ্য হয়ে থাকার সুবাদে কিংবা অপযশে কারো প্রতি অবিচার করে ফেলেছি কিনা জানি না, হয়তো বা নিজের প্রতিই করেছি।
খেয়াল করেছি, যাদের কাছে আমি দুর্বোধ্য বোধের অগম্যতার আড়ালে তারাই আমাকে চেয়েছে সবথেকে বেশি, অনেকটা ওই সাপের মাথার মণিটির মতো, আত্মশ্লাঘার মতো টনটনে বিষে সিক্ত যে অমৃতের পথ চিরদুর্গম হয়ে আছে।
লেখক: কবি