
শ্রেয়া চক্রবর্তী
চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী
পর্ব ৫৮
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৪, ২০২০
আইসোলেশন ১০
সকালে উঠে বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকি। আজকের দিনটা কেন? আই অ্যাম লুজিং মাই হোল্ড ট্যু সামথিং, স্লোলি, ভেরি স্লোলি। যত গাঢ় বিষ তত সময় নিয়ে কাজ করে। যেন আমার কোনও অতীত নেই! সেই শর্তে নেই কোনও ভবিষ্যৎ। শুধু মুহূর্ত নিয়ে বেঁচে থাকা কী ভীষণ অসহনীয়!
মাথার ভেতর অজস্র শেকল। শুধু এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি পৌঁছে যাওয়ার সহজ চলাচলটুকু নিয়ে আমি কীভাবে যে বেঁচে ছিলাম! রক্ত ফেটে বেরতে চায় যেন আজ ফিনকি দিয়ে। রোজ ভুরুর নিচে একটা একটা করে অসামঞ্জস্য রোম গজাতে দেখি। সময়ের হিসেব থাকে না কিছু গুটির ভেতর খোলস ছাড়ার।
পৃথিবী কি কোনও ব্ল্যাক ম্যাজিকের ভেতর আছে নাকি? আমি কে? কে আমি? আমগাছটাও মরে গেল আমার শৈশবের। হোয়াট দিজ হোল ফাকিং ওয়ার্ল্ড ইজ রানিং আফটার? আমাকে আজ নিশি ডাকুক...
আইসোলেশন ১১
মাটির অনেক গভীর থেকে উঠে আসা শেকড় বাকড় বুনোলতা ক্রমশ আমাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলতে চাইছে যেন মাটির সাথে। কিছুতেই ছাড়িয়ে উঠতে পারছি না, এমন বাঁধুনি। মরার মতো শুয়ে থেকে কেবল ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে চেয়ে আছি।
দেখছি দিন গিয়ে রাত আসছে। রাত ফিকে হচ্ছে ভোরে। অরণ্যের গভীরে অদ্ভুত জীবজন্তুরা ডেকে উঠছে। দূরের নদীতে পাথরে লেগে জলের কলকল শব্দ। আরও কিসের গুঞ্জন বুনোঘাসে? অথচ কেউ আমার ধারেকাছে অবধি নেই। কী অদ্ভুত এই বেঁচে থাকা!
এত মন খারাপ সাথে নিয়ে আমি চলে যেতে চাই না।
আইসোলেশন ১২
এই অভিশপ্ত সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ কারো প্রেমে পড়বে কি আর? মনে পড়ে যায় `টাইটানিক` সিনেমায় জ্যাক ও রোজের অসাধারণ প্রেমকাহিনির কথা। নিজে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পড়তেও রোজের জীবন সুরক্ষিত করেছিল সে। এমন মহান ভালোবাসা কদাচিৎ ঘটে। আকস্মিকও।
একটা নিটোল সময়ের ভেতর দিয়ে চলতে চলতেও আমাদের ইল্যুশন ভেঙে যায়। প্রেম আসলে এক কল্পনা। বাস্তবকে সেই কল্পনার উত্তীর্ণ প্রবাহে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখা মুশকিল হয়। মানুষ তো আসলে জানোয়ার। যৌনতা বরং সহজ ও স্বাভাবিক। প্রেম ট্রেম সবার কম্ম নয়। যে পারে সে পারে, কবিতা লেখার মতোই।
সকলেই যেমন কবি নয়, কেউ কেউ কবি; ঠিক তেমন কেউ কেউ প্রেমিক, সকলেই নয়।
আইসোলেশন ১৩
একটি নতুন উপন্যাসের কাজ শুরু করেছি। এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় গল্পের নায়ক একা স্বকথনে বিভোর। সেটাই লিখছিলাম। হঠাৎ শুনি বৃষ্টি নামলো ঝমঝম। উপন্যাসের সন্ধ্যা আর বাস্তবের সন্ধ্যা কেমন এক হয়ে গেল। বাস্তব বলে আসলে কিছু আছে? যে উপন্যাসের চরিত্র আমি, ঈশ্বরের লেখনিতে তার নেক্সট চ্যাপ্টার বলে কিছু হয় না। মনোবৈজ্ঞানিক ধারায় তার একটা অস্পষ্ট আভাস থাকে মাত্র।
এই আকস্মিকতার নামই `বাস্তব`, যে কোনও মোড় থেকে যার গন্তব্যের ডিরেকশন অজস্র অভিমুখে স্পার্কের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমার মাঝে মাঝে স্পষ্ট মনে হয়, কেউ আমাকে লিখছে। কোনও এক অদৃশ্য হাত। তাঁর লেখনিতে আমি যেভাবে বিকশিত হচ্ছি আমার লেখক সত্তাও সেভাবেই বিকশিত হচ্ছে।
আইসোলেশন ১৪
ফুটিয়ে ঢেলে বেলে এসবের থেকে গুলে ফেটিয়ে সেঁকে কিংবা ভেজে খেয়ে নিতেই আমার বেশি ভালো লাগে। এই যেমন আজ ডিমের সাথে গুলে নিলাম আটা আর দুধ। সঙ্গে পেঁয়াজ কুচি, লঙ্কা কুচি আর সামান্য নুন। ব্যাস ভেজে নিলেই গোলা রুটি তৈরি। ডিম আমার প্রিয় খাবার। পুষ্টিকর এবং সহজপাচ্য। এই এক ডিম দিয়েই কত রকম পদ বানানো যায় খুব সহজেই।
আজকের ওয়েদার বেশ সিনিস্টার। একটা রহস্য রহস্য মেজাজ আছে। মেঘ ডাকলেই সেতু এসে আমার কোলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আজকাল ওর একটা অদ্ভুত ধরনের খিদে পাওয়া শুরু হয়েছে। কী খাবি জিজ্ঞেস করলেই বলে, কার্টুন!
কোথা থেকে শিখেছে জানি না, মাঝে মাঝেই এসে টুক করে চোখ মেরে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার আমাকেও ওর মতো করতে উৎসাহ দিচ্ছে, মাম্মা ওপেন ওয়ান আই!
গতকাল দেখলাম কাটার দিয়ে পেন্সিল ছুলে সেই ছোলা অংশ মেঝেতে ছড়াচ্ছে। তারপর এসে জানিয়ে গেল, ওগুলো নাকি `অ্যানিমাল ফুটপ্রিন্টস`! আমার শুধুই অবাক হওয়ার পালা।
কালার করতে বসেছে হয়তো। বললাম, ‘কোলাব্যাঙটা রঙ করো।’ কোলাব্যাঙ চুলোয় গেলো। রঙ করা শুরু হবে কোলাব্যাঙ বাদ দিয়ে জগতের সর্বত্র, যেমন কালো রঙের পেন্সিল কাটার মোম রঙ ঘষে ঘষে সবুজ হয়ে যাবে। ড্রইং খাতার কভার হলুদ থেকে কমলা। ইরেসার সাদা থেকে নীল। বিছানার চাদরে সবুজের ওপর কালো হিজিবিজি। সোফার হ্যান্ডেল বাদামি থেকে লাল। এইসব হয়ে গেলে নিজের হাত ও পায়ের নখে উঠবে মোম রঙের নেইল পলিশ। দেখে মনে হবে, সারা পৃথিবী রঙ করে ফেলবে একদিন।
এছাড়া রয়েছে সোফা থেকে মেঝেতে একশোবার ভল্ট খাওয়া। খেলনা বাটি পুতুল ওসবে তার তেমন ইন্টরেস্ট নেই। সাইকেলের প্যাডেলে পা ভালো মতো পৌঁছয় না। ওই নিয়েই বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা এমন স্টাইলে চষবে যেন বাড়ির ধেড়ে ছেলে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে! অবাক হওয়ার পর্ব আরও আছে। কাল আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো, মাম্মা, শুধু আমি আর তুমি যদি থাকি কেমন লাগবে? বললাম, তুমি তো আমার পেটের ভেতর আমার সাথে একাই ছিলে। কেমন লাগতো? বললো, একা একা কি আর ভালো থাকা যায়? চলবে
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক