ছফার পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ

সানোয়ার রাসেল

প্রকাশিত : জুলাই ১৬, ২০১৯

`আমার দক্ষিণের জানালা বরাবর একটি আমগাছ। গাছটি যথেষ্ট উঁচু নয়। শাখা-প্রশাখা, পত্র-পল্লব মিলিয়ে গাছটির নিজস্ব একটি সংসার রয়েছে। এই গাছের নিবিড় পাতার আড়ালে কাকেরা রাত্রিযাপন করে। ভোরের অনেক আগে থেকে দোয়েলেরা শিস দিতে থাকে। একটু বেলা হলে এক ঝাঁক বুলবুলি কোত্থেকে উড়ে এসে ডালে ডালে ছুটোছুটি করে। আসে ঝুটি শালিক, গাঙশালিক। দুটো ঘু ঘু যখন ডাকে, আমার গ্রামের ছাড়া ভিটির কথা মনে পড়ে যায়।`

ছফার এই লেখাটুকু যখন পড়ি তখন আমাকে স্টেশন বানিয়ে একটা স্মৃতির রেলগাড়ি কু ঝিকঝিক করে প্রবেশ করে। সেই গাড়িতে করে চলে আসে আমার ফেলে আসা গ্রাম, শৈশবের শহরতলী, বাড়ির সামনের আম-জাম-নারকেল বৃক্ষেরা আর উঠানে, টিনের চালে, বৃক্ষশাখে চরে বেড়ানো প্রচুর বিহঙ্গ। এইভাবে ছফা আমার ভিতরে প্রবেশ করে যায়। আমি তার `পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ` পাঠ শেষ না করে বের হতে পারি না।

ছফার সাথে প্রথম পরিচয় তার `অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী` দিয়ে। এরপর `যদ্যপি আমার গুরু`। `পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ` উপন্যাসটি আমার তৃতীয় ছফা পাঠ। তিনটি বইয়েই ছফা নিজেই প্রবলভাবে উপস্থিত।

ভাষার সহজ প্রয়োগ, বক্তব্যের ঋজুতা ও মতপ্রকাশের বলিষ্ঠতা আমাকে আকৃষ্ট করে ছফাপাঠে। এই বইটিও সেই সব গুণাবলী থেকে বঞ্চিত নয় মোটেও।

এই উপন্যাসে পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গরা ছফার পার্শ্বচরিত্র, বরং বলা ভালো ছফা ও অন্যান্যরাই এদের পার্শ্বচরিত্র। কেননা সমস্ত বয়ান, ঘটনার বর্ণনা ও স্মৃতিচারণ ঘটেছে পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গদের ঘিরেই।

সুশীল ছফার পালক ছেলে। ছাদের উপরে মৃতপ্রায় তুলসি ও নয়নতারার চারা সুশীলের যত্নে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। তাদের বেড়ে ওঠা দেখতে দেখতে ছফার মধ্যেও সুশীলের আনন্দ সংক্রামিত হয়। তুলসি ও নয়নতারাকেও তার কাছে বাড়ির ছেলে বলেই মনে হতে থাকে। ছফা বলেন, `তুলসি এবং নয়নতারার ফুল দেখে আমার জীবনের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস নতুন করে জন্মায়। আমার ভেতরে কে যেন বলে যেতে থাকে তোমার জীবনে দুঃখ-কষ্ট যাই আসুক, তুমি ভেঙে পড়বে না। একসময়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার সুযোগ তুমি পাবে। নীরবে তুমি কাজ করে যাও, ফুলের বাবার সাধ্যি নেই, না ফুটে থাকতে পারে।` তুলসি ও নয়নতারা ছফার মধ্যে যেই অনুপ্রেরণা জাগায়, তা আসলে ছফা আমার মধ্যেই যেন ছড়িয়ে দেন।

ছফা বলেন, `আল্লাহতায়ালা তাঁর গোপন বাতেনি শক্তির একটা অংশ বৃক্ষ জীবনের মধ্য দিয়ে ক্রিয়াশীল করেছেন। এ কারণেই একদিন মানুষকে বৃক্ষের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়।` তিনি বৃক্ষদের ডাক শুনতে পান বলে বিশ্বাস করতেন। হয়তো বৃক্ষ সবার সাথেই কথা বলে, কেউ কেউ তা বোঝে। বৃক্ষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা সকলের নেই। ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের মাঠ জুড়ে চাষ করেন। বেগুন, বাঁধাকপি সহ হরেক রকম সবজি ফলান। রীতিমত চাষার মতোন যত্ন নিয়ে। তিনি ইত্তেফাক পত্রিকার রিপোর্টার নাজিমউদ্দিন মোস্তানকে সঙ্গে নিয়ে বস্তির বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখান। ক্ষেতের প্রথম সবজি দিয়ে বাচ্চাদের তরকারি রান্না করে খাওয়ান। তাদের সেই আনন্দ ছফা কোনদিন ভুলতে পারেন না। আরও অনেক কিছুই ছফা ভুলতে পারেন না।

ছফা ভুলতে পারেন না তার শৈশবের বিশাল আমগাছটিকে। যেটা তার বাবা ছফা ও তার মায়ের নানাবাড়িতে বেড়াতে যাবার সুযোগে কাটিয়ে ফেলেছিলেন। ছফা বলেন, `আমার সেই রবিবৃক্ষ কেটে খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়েছে। আমি কথা বলতে পারলাম না। বোবা হয়ে বসে রইলাম। আমার বুকে সেই যে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী ক্যাপসুল করে ঢুকিয়ে দিলেও সে ফাঁক ভরাট হবে না।` ছফার এই শূন্যতাবোধ আমার শৈশবের কত শুন্যতার শেকড় ধরে টান দেয় সেটা কি তিনি জানতে পারেন?

ছফা বলেন, `যে পাখি পোষে, তার মনে অবশ্যই ধারণা থাকে, পাখি দাগা দিয়ে মারা যাবে অথবা পালিয়ে যাবে`। আমি বাক্যটি পড়ে থম ধরে বসে থাকি! এত সত্য আর গূঢ় কথা এইভাবে বলে দিলেন! আমি ছফার শালিক, টিয়ে, দোয়েল, পাতিকাক, দাঁড়কাকের গল্পে হারিয়ে যেতে থাকি। পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণে হারিয়ে যেতে যেতে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। ছফাপাঠ শেষ হয়, কিন্তু ছফা তার সমস্ত ভাবনা নিয়ে আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকেন।

একুশে বইমেলা ২০১৮