জগলুল আসাদের কলাম ‘জায়োনিস্ট রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটিশদের ভূমিকা’

প্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০২৩

ইসরাইল নামের রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটেন ও পরবর্তী সময়ে আমেরিকার যে ভূমিকা তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ হাজির করেছেন ঐতিহাসিকরা। সভ্যতার নিশানবরদার এই ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যিক শক্তির হাত ধরে কত কত অন্যায় যে সংঘটিত হয়েছে, তার হিসাব অগোচরেই রাখা হয় । আমরা ইজরাইলি-ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আভি শ্লাইমের ইশারা ধরে জায়নিস্ট কলোনিয়াল প্রোজেক্টে ব্রিটেনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার বিস্তার ঘটাবো।

জায়োনিস্ট রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটিশদের ভূমিকার বিস্তারিত বর্ণনা পাই আভি শ্লাইমের বেলফোর এন্ড ইটস কনসিকোয়েন্স The Balfour declaration and its consequences নামক রচনায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেইন তিনটি চুক্তি করেছিল যেটির প্রত্যেকটি আরেকটির সাথে সাংঘর্ষিক। একটাকে মান্য করলে, অপরটি আপসেআপ বাতিল হয়ে যায়। যেমন, ১৯১৫ সালে ব্রিটেইন শরিফ অফ মক্কার সাথে প্রতিশ্রুত বদ্ধ হলেন, উসমানি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আরবের শাসন ক্ষমতা ও প্যালেস্টাইনও তাদের হাতে থাকবে।

কিন্তু ১৯১৬ সালে আরব রাষ্ট্রসমূহকে ভাগাভাগি করে নিজেদের প্রভাব বলয় বা Sphere of influence এ আনার জন্যে ব্রিটেইন ফ্রান্সের সাথে এক গোপন চুক্তি করে। চুক্টিটি সাইকস-পিকট নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী, দক্ষিণ ইজরাইল ও প্যালেস্টাইন, জর্দান, দক্ষিণ ইরাক ইত্যাদি অঞ্চল থাকবে ব্রিটেনের, আর ফ্রান্স নিয়ন্ত্রণ করবে সিরিয়া, লেবানন, ইরাকের উত্তরাংশ  ইত্যাদি।

আবার ১৯১৭ সালে বালফুর ঘোষণার মাধ্যমে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্যে জাতীয় আবাসভূমি National home for the Jewish প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আরবদেরকে পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত স্বাধীনতা দেবার যে প্রতিশ্রুতি ব্রিটেইন দিয়েছিল, সেটার সাথে বালফুর ঘোষণা পুরোই সাংঘর্ষিক। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালফুর লিখেন, “প্যালেস্টাইনের বর্তমান বাসিন্দাদের সাথে আমাদের পরামর্শের প্রয়োজন নেই। জায়নিজম ভুল হোক বা শুদ্ধ হোক তা ৭ লক্ষ আরবের আশা-আকাঙ্খার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

অথচ আরবরাই ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ৯৪ শতাংশ। বালফুর ঘোষণা নিয়ে দুই ধরণের মতামত আছে। একটা হিউম্যানিটারিয়ান স্কুল, আরেকটাকে বলে ইম্পেরিয়ালিস্ট স্কুল। মানবতাবাদী ঘরানা মনে করে, একটা প্রাচিন জনগোষ্ঠীকে তাদের পূর্বপুরুষদের সুপ্রাচীন ভুমিতে ফিরিয়ে দেবার মহতী প্রচেষ্টা এটি। অন্যদিকে ইম্পেরিয়ালিস্ট স্কুল এই ঘোষণাকে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী হিশেবনিকেশের ফল বলেই মনে করে। উল্লেখ্য যে, অধিকাংশ ঐতিহাসিকই মনে করেন, বালফুর ঘোষণা ব্রিটেনের বৃহত্তর সাম্রাজ্যিক বিবেচনার ফল ।

বালফুর ঘোষণার সময় ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লয়েড জর্জ। যারা অটোম্যান সাম্রাজ্যকে ভেঙে কিছু ক্লায়েন্ট স্টেইট তৈরি করতে চেয়েছিল তাদের নেতা ছিলেন জর্জ ফ্লয়েড। তাছাড়া টম সেগেভের মতে, লয়েড জর্জের জায়োনিজমকে সমর্থনের পেছনে জায়োনিস্টদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে তার একটা ভুল ও অতিরঞ্জিত ধারণা ছিল। তিনি মনে করতেন, ইহুদিদের রাশিয়া, আমেরিকা ও সাবটারেনিয়ান অঞ্চলে এদের প্রভাব আছে। তার জানা ছিল না যে, জায়নিস্টরা জুইশ কমিউনিটির একটা ক্ষুদ্র অংশ। অনেক ইংরেজ ইহুদিরা জায়োনিজমের ভেতরে যে অন্তর্গত জাতীয়তাবাদী চেতনা সেটার বিরোধী ছিলেন। জর্জ লয়েডের মন্ত্রী পরিষদের একমাত্র ইহুদি সদস্য ছিল মন্টেগু।

ব্রিটিশ ক্যবিনেটে  Anti-semitism of the present Government শিরোনামে তিনি চারপাতার একটা স্মারকলিপি প্রদান করেন। যেখানে তিনি বলে, জুডাইজম একটা ধর্ম, এটি কোন জাতি নয়। জুইশ স্টেইট তৈরি করার কোন অর্থ হয় না। প্যালেস্টাইনের ইহুদিরাষ্ট্র ব্রিটেন, আমেরিকা বা অন্যান্য জায়গায় বসবাসকারী ইহুদীদের সমানাধিকারের বিরুদ্ধে।

আভি শ্লাইম বালফুর ঘোষণাকে আরবের প্রাণকেন্দ্রে ইহুদি রাষ্ট্রকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতীক বলেছেন। প্যালেস্টাইনি আরব জনগোষ্ঠীকে ভিটেমাটি ছাড়া করবার জন্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জুনিয়র এলাই ছিল এই জায়নিজম। কারণ জায়নিজমের লক্ষ্যই ছিল, ইউরোপিয় ইহুদিদেরকে প্যালেস্টাইনে এনে বসতি গড়া। আবার, ব্রিটিশদের লক্ষ ছিল প্যালেস্টাইনে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখা, সে ক্ষেত্রে জায়োনিজম প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ উপস্থিতিকে লেজিটিমাইজ করে। এভাবে তারা একে অপরের সহযোগী হয়ে থাকে।

তবে ঐতিহাসিকরা দেখান যে, জায়নিজমকে সমর্থন ছাড়াই, অর্থাৎ ইসরাইলে ইহুদিরাষ্ট্র গঠনে তৎপরতা ছাড়াই তারা তাদের প্রভাব ধরে রাখতে সক্ষম ছিল। কারণ আরবরা ইতোমধ্যেই ব্রিটিশদের মিত্র ছিল। আরব অঞ্চল তুর্কি খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে রাজিও ছিল, সে ক্ষেত্রে প্যালেস্টাইনকে তাদের অধীনে রাখলে ব্রিটিশ প্রভাব অক্ষুণ্ণ থাকত। তাই ব্রিটিশ স্বার্থের জন্যে বালফুর ডিক্লারেশন ছিল a colossal strategic blunder। আভি শ্লাইম বলেন, বালফুর ঘোষণা একই সাথে crime and mistake। প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে এটা ছিল ব্রিটেনের ক্রাইম, আর ব্রিটিশ পলিসির দিক থেকে এটা ছিল এক মিসটেইক। কারণ এটার ইতিবাচক ফল ব্রিটিশ শাসন ভোগ করতে পারে নাই ।

ইসরাইলের পুরোনো ধারার ইতিহাসবিদগণ বলেন, শেষদিকে ব্রিটিশরা প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র-গঠনের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু ইলান পাপের নেতৃত্বে ইসরাইলের রিভিশনিস্ট ধারার ইতিহাসবিদরা দলিল প্রমাণ সহকারে দেখান যে, ব্রিটেন ইসরাইল রাষ্ট্রের অভ্যুদয়কে সমর্থন করেছে এবং প্যালেস্টাইনি রাষ্ট্রের উদ্ভবকে সবসময় বাধাগ্রস্তই করতে চেয়েছে।

লেখক: শিক্ষাবিদ