জগলুল আসাদের কলাম ‘ফিতনার দিনে নির্জনবাসই নিরাপদ’

প্রকাশিত : এপ্রিল ৩০, ২০২০

ফেসবুক ও ইউটিউবের বাইরে থাকা আলিমদের আমরা চিনি না। বাংলাদেশে অবশ্যই বড় ফকিহ ও মুহাদ্দিস আছেন। তাদেরকে প্রাসঙ্গিক রাখা তাদের সহবতে-থাকা তালেব ইলমদের অবশ্য কর্তব্য বলেই মনে করি। দীর্ঘদিন ইলমচর্চায় ও গবেষণায় নিয়োজিত আছেন, হয়তো কিতাব লিখেছেন যা বাজারের বিজ্ঞাপনী ডামাডোলে আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে, অনুপ্রাণিত করছেন অপরকে গভীর ইলম অর্জনে— এমন আলিমকে আলোয় আনা, তাদের বক্তব্য ও লেখাকে সামনে আনা, তাদের নসিহতকে জনগণের সম্মুখে হাজির রাখা জরুরি প্রয়োজন। আর ইলম যে উঠে যাচ্ছে, চারপাশের সোরগোলে তা কিন্তু লুকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

আমাদের প্রতিভাবান তরুণ আলিম আছে অনেক, কিন্তু বয়স ও চিত্তচাঞ্চল্যে তাদের গুটিকয়েক এমন বাহাসে নিয়োজিত হয় প্রায়শই, যেগুলোতে উম্মাহর কোনও পারলৌকিক কল্যাণ বা জাগতিক লাভ আছে কিনা বুঝা দুরূহ। তাদের ইলমি পরিসরে এটা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ। তবে অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝি, বয়স ও জীবনাভিজ্ঞতার একটা পর্যায়ে না এলে মননে স্থৈর্য ও ইলমে পরিপক্কতা আসে না। সমকালের জন্যে প্রয়োজনীয় বয়ান হাজির করা আসলেই কঠিন, যা শুধু নির্দিষ্ট কিছু কেতাবি বুঝ দিয়ে সম্ভব না। যদিও বিপরীত উদাহরণও ইতিহাসে আছে, জানি। কিন্তু আমাদের কালটা বড্ড চঞ্চল, বড্ড জটিলতায় ভরা, নানা মতাদর্শ ও ফ্যাসাদে পূর্ণ।

কারো ভেতরে হয়তো ইলমের গভীরতা আছে, কিন্তু কীভাবে অপরকে উম্মাহ থেকে খারিজ করা যায় এই আবেগের চপলতাও আছে সাথে। মনের ভেতরে না থাকলেও অন্তত বাক্যপ্রয়োগে ও কথার ভঙ্গিতে ধারণা হয় যে, যত কম লোক নিয়া বেহেস্তে থাকা যায় তা তার বা তাদের জন্যে তত ভালো। অনেকেরই মনে হয়, এই লোকের যা লেখা, আর ওই লোকের যা বক্তব্য, তাতে তাদের কাছে গেলেই মনে হয় কাফের ফতোয়া দেবে, নাহয় কমপক্ষে বিদআতি লকব তো জুটবেই। চাইলেও শুধু তাওহিদ, রিসালাত আর আখিরাতে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে একতার অনুভব গড়াও প্রায় অসম্ভব। মূল বিষয় নয়, শুধু শাখাগত মাসলায় কোনও গ্রুপের সাথে একমত হলেই আপনি কেবল মুমিন বা সম্পর্ক রাখার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

আপনার মুখে ঈমানের স্বীকৃতি তাদের দিল ভরাবে না, আততায়ী হয়ে আঁতের খবর বের করার আগপর্যন্ত অনেকের সাধ মিটবে না। ফেসবুক পরিসরে বিভিন্ন দ্বীনি লেখায় বা বক্তব্যে কী পরিমাণ তর্ক-বিতর্ক ও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়, তা দেখলে যে কোনও নিরীহ ঈমানদারের ঈমান হারা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আর কোনও নন-মুসলিমের যদি ওই বাহাস-বিতর্ক চোখে পড়ে, তাহলে তার কাছে ইসলামের যে রূপ প্রকটিত হবে, তাতে ইসলামের অনুসারী হওয়া তো দূরের কথা, তফাতে থাকতে পেরে সে নিজেকে ধন্যবাদ জানাবে। ভাষার যে ব্যবহার ও আলোচনার যে বিষয় থাকে, তাতে সাধারণ শিক্ষিতমহল তাদের সাহচর্যের ফয়েজ লাভের কথা ভুলেও চিন্তা করবে না। সাধারণ মানুষ আলিমদের কাছে যাবে, খুব খেয়াল করে দেখবেন, সে সুযোগও খুব কম।

আলিমরাও সাধারণ মানুষের কাছে যে যাবেন বেহেস্তের পথ দেখাতে, সেটাও বিরল ঘটনা! সবাই জান্নাতুল ফেরদাউস নিয়া ব্যস্ত, জান্নাতের অপরাপর স্তরেও যে কেউ যাইতে পারে বা যাবে, সেটা তাদের মাথায় আর থাকে না। সামান্য ত্রুটিতেই কারো সব কিছুকে ব্যর্থ করে দিতে পারলেই যেন নিজের ঈমানের জজবায় সন্তুষ্ট থাকা যায়। ব্যাখ্যা করতে করতে এমন সব বিষয়কে আমরা ঈমানের বিষয় বানিয়ে ফেলি, যা নবি (সা.) ও তাঁর সাহাবারা করেননি। সাহাবাদের মোবারক জামাত আমাদের চোখের সামনে থাকে না। থাকে নিজের ইলমের প্রতি সন্তুষ্টি, অন্যের ত্রুটির প্রতি কঠোরতা আর নিজেকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা। নবিজীর আগমন ঘটেছিল সুসংবাদ দিতে ও সতর্ক করতে, আর অনেককে দেখে মনে হয় তার বা তাদের আগমন ঘটেছে অভিসম্পাত করতে, অধিক সংখ্যক লোকের জন্যে জাহান্নামের সুবন্দোবস্ত করতে।

আমরা বলতে পারি না যে ঈমান ঠিক নাই। বলতে হয়, আকিদা ঠিক নাই। ঈমানের জায়গায় আকিদা শব্দ আমাদের ভালো লাগে। কারণ ঈমানের বিষয় তো ৬-৭ টা, কিন্তু আকিদার বিষয় শাখাপ্রশাখা মিলিয়ে গোটা ত্রিশেক বা কমবেশি। তালিকাতে আইটেম বেশি থাকলে জুতমতো আইটেম ধইরা কইষা গালি দেয়ার আত্মতৃপ্তির থেইকা কেইবা নিজেরে মাহরুম রাখতে চায়! কাউকে আপনি পূর্ণ অনুসরণীয় ভাবতে পারবেন না একালে। কারো ভেতরে পাবেন অপূর্ব আখলাক কিন্তু ইলমের স্বল্পতা; কেউ বা প্রবল ইলমসম্পন্ন কিন্তু উম্মাহ-চেতনা নাই; কেউবা কঠোর কেতাবি কিন্তু ইনসানের প্রতি দরদবিরহিত; কেউবা প্রবল উম্মাহ-চেতনাসম্পন্ন কিন্তু ইলমের খামতি; কেউবা তর্কে প্রবল পারঙ্গম কিন্তু তাকওয়ায় ঘাটতি; কেউ আবার অপরের প্রতি কঠোর, দ্বীনকে কঠিন করাই তার কাছে তাকওয়া; কেউ নিজের প্রতি কঠোর কিন্তু অপরের প্রতি কোমল।

আসলে নবির সিফত ছড়িয়ে আছে নানা জায়গায়, নবির পর একক কারো মধ্যে তা আর ঘনীভূত নাই। সেই আলিমরাই সামনের প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন যারা অস্থির বাহাস নয়, স্থির একাডেমিক এপ্রোচে আগ্রহী। উম্মাহর সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে ভাববেন, ইসলামকে সভ্যতা আকারে বুঝবেন, শরিয়াতের উদ্দেশ্যের দিকেও তাকাবেন, মানুষকে বুঝবেন, শুধু কথা বা লেখা নয়, মানুষের প্রতি ও মুমিনের প্রতি দরদবোধ করবেন ও মুমিনকে এক দেহ ভাববেন। যেসব বিষয়ে আসলেই ইখতেলাফ আছে সেসব বিষয়ে সবার মধ্যে একটিই মত প্রতিষ্ঠা করবার উচ্চাভিলাষ না দেখিয়ে নিজের কাছে যেটা সহিহ মনে হয় সেটা নিজে আমল করবেন, অনুসারীদেরকে ভিন্নমত সম্বন্ধেও জানাবেন। নিজ ভূখণ্ডের রাহবার হওয়া কঠিন কাজ, আর উম্মাহর কাস্টোডিয়ানশিপ নেয়া তো আরো কঠিনতর।

নবি (সা.) সাহাবাদের কাছে প্রিয় হয়ে ছিলেন কেন? কারণ আল্লাহ তাকে বানিয়েছিলেন আল আমিন, সাদিক, দরদী, অন্যকে সাহায্যপ্রবণ, মুমিনের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠাকারী, বিধানকে সহজকারী, মিষ্টভাষী, আর হুসনে খুলুকের অধিকারী। এই হুসনে খুলুক একাই, শত তর্ক-বিতর্কের চেয়ে ইসলামের সৌন্দর্যটুকু তীব্রভাবেই উন্মোচনে সক্ষম। তা হোক অনলাইন পরিসর বা অফলাইনে। একালে যারা আমাদেরকে দ্বীনি ক্ষেত্রে দিশা দেবেন, তাদের বহুমুখী যোগ্যতার অধিকারী হওয়ার দরকার হবে বলে মনে করি। ইসলামের অন্তত কোনও একটি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞতার পাশাপাশি ইসলামের সামগ্রিক জ্ঞানব্যবস্থা, অনুভূতি কাঠামো, প্রচলিত প্রতিটি মতাদর্শ সম্পর্কে যথাবিহিত জ্ঞান, ধৈর্য, মানুষের প্রতি দরদ, আল্লাহভীতি, হুসনে খুলুক, মানুষের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া দরকার।

তাদের কাছেই মানুষ শুধু যাবে এমন যেন না হয় শুধু, তারাও মানুষের কাছে যাবেন। সবাই যাতে জান্নাতে যেতে পারে সেই দিশা দেখাবেন কোমলতায়, দরদে। ফেসবুক কিন্তু একটা বাজার, একটা বহু বর্ণিল গণজমায়েত, এখানে সব কথা ও আলাপ করতে নেই। এখানে আলাপ হওয়া উচিত তা-ই নিয়ে যা আমার দৈনন্দিন জীবনকে আল্লাহমুখী করবে, হালাল খেতে ও পড়তে উৎসাহিত করবে, মানুষের মধ্যে আদল প্রতিষ্ঠা করতে উদ্দীপিত করবে, যা কিছু অন-ইসলামি ও বাতিল মত, সেগুলোকে খণ্ডন করবে, ইসলামের বিধিবিধানের ব্যাপারে মুমিনের মনে সন্তুষ্টি যোগাবে। নিজেদের ভেতরে তর্ক করে দুর্বল হয় শুধুমাত্র হতভাগারা। অন্ধকার নিয়ে কথা বলবো, কিন্তু আলোও যেন জ্বালাই। আর একাডেমিক এপ্রোচে আলোচনা ও লেখা শিখে উঠি, নিজের মতকে দু`একজন বিশেষজ্ঞকে দেখাই বা জেনে নিই।

বাংলাদেশে যদি ইসলাম বিষয়ে পিয়ার-রিভিউড্ জার্নাল বের হতো, বিরাট কাজ হতো। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বা ভক্তকুলের প্রতাপে নয়, অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও ইলমের সঠিকতার জোরে টিকে থাকার শর্ত তৈরি জরুরি। আমরা সাধারণ মুমিনরা ফেসবুকীয় যে কোনও বিতর্ক থেকে নিজেদের হেফাজতে রাখি, যদিও আমরা কেউই নিজেদের সাধারণ মুমিন ভাবতে চাই না। দশ-বিশটা কিতাব পড়ে সবাই আমরা অসাধারণ! নিজের জীবন ও বলয়ে ইসলাম আনার চেয়ে অপরের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, নিজের বুঝকে একমাত্র বুঝ ভেবে অপরের উপর চাপিয়ে দেয়ার ইচ্ছে চুলকানির মতোই আরামপ্রদ। সাধারণ মুমিন থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি যেন পাই, এই চেষ্টাই ভালো। নানা মত, তর্ক ও বাহাসের প্রচার-প্রসারের অবাধ সুযোগের এই কালে নির্জনবাস, মানে দীনের যতটুকু জানি সে অনুসারে আমল করা, কাঙ্ক্ষিত মনে হয়।

আর নিজের অধীনস্তদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করা ও আমলে উদ্দীপিত করা, অনেক বড় কাজ। জাস্ট কোরআন, কোরআনের তাফসির, হাদিসগ্রন্থ, বিশেষত সেইসব অংশ যা নিজের জীবনে বা সমাজের প্রয়োজন ও পালনীয়, নবিজীবনী ও টুকটাক মাসয়ালা মাসায়েলের বইই যথেষ্ট। আর প্রচুর তাওবা করা, আর আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা, কারণ সত্যিকার ওয়ারাসাতুল আম্বিয়ার অভাবে আমাদের আমলে, ইলমে ও ঈমানে অনেক ঘাটতি। আমাদের সাধারণদেরই দায় বেশি কান্নার, আস্তাগফির করবার। আমাদের কান্না কেউ কেঁদে দেবে না, আমাদেরকে বেহেস্তের পথ কেউ আর দরদ ভরা কণ্ঠে দেখাবে ব`লে মনে হয় না। সমাজে সহিহ বুঝ যারা দেবেন তারা নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত, `অপ্রয়োজনীয়` তৎপরতায় নিমগ্ন, ইলমের তাজাল্লিতে ও নিজ পথকেই একমাত্র সহিহ ভেবে প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনের পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলে, অগ্রাধিকারের প্রশ্নটিকে বিদায় করে নিজেদের অজান্তেই এক ভয়বহ কূপে ডুবন্ত।

নিজেরা পাঠে মনোযোগী হই, আর ভালো কাউকে পেলে আরবি শিখে নেয়া জরুরি হবে। যেটুকু পথ ছোটবেলায় ইসলামিয়াত বই থেকে পাইছেন, সেটুকু সম্বল করে আল্লাহর উপর ভরসা করে এগিয়ে যেতে হবে। ফিতনার দিনে নির্জনবাসই নিরাপদ। কেউ ভরসা করবার নেই, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক