জগলুল আসাদের গদ্য ‘মৃত্যু ও মুসাফির-জীবনের স্মরণিকা’

প্রকাশিত : জুলাই ৩০, ২০২০

ইসলামের সবচেয়ে শ্রমসাধ্য ইবাদত হজ্জ। আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য এ ইবাদাতের শর্ত। হজ্জ যেন জীবিত অবস্থায়ই মৃত্যুর জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি। দু`টুকরো সাদা কাপড় পরে দেহকে কিছুটা আবৃত করে থাকা মৃত্যু ও মুসাফির-জীবনের স্মরণিকা।

হজ্জগমনেচ্ছু ব্যক্তি আত্নীয়-প্রতিবেশী সবার কাছে ক্ষমা চান, ঋণ পরিশোধ করেন, যদি আর ফিরে না আসা হয়— এই আশংকায়। বিত্তশালী ও ক্ষমতাবান ফকিরি বেশে অবস্থান করেন আরাফার ময়দানে, তাওয়াফ করেন কাবার চারিধার। ইহরাম বাঁধার পরপরই নিষিদ্ধ হয়ে যায় সমস্ত আপাতসিদ্ধ কাজগুলো। হাজিকে একাত্ম হয়ে থাকতে হয় সব প্রাণের সাথে, জড়বস্তুর সাথেও। নিষিদ্ধ হয়ে যায় যেকোনো প্রাণী হত্যা, গায়ে বসা একটা মশা মারাও অনুমোদিত নয় তখন; সম্ভবত ময়লা লাগলেও সেটাকে মুছে ফেলা বিধেয় নয়। অনুভুতি ও কর্মে সর্বসৃষ্টি ও প্রাণের প্রতি মমতা চর্চাও হজ্জ্ব্বের শিক্ষণীয় দিকের একটি।

নারী-পুরুষ, গোত্র, বর্ণ, সমস্ত ভূগোল ও পরিচয়ের ভেদ ভুলে এক স্রষ্টার প্রার্থনায় মগ্ন হওয়া মানুষের ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য নিদর্শন এটি। সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানো, তাওয়াফের সময় `রমল` (শক্তি-শৌর্য্য নিয়ে হাঁটা) করা গতি ও আমরণ কর্মমুখর থাকার প্রতীকী শিক্ষা দেয়।

হজ্জের মতো এমন বিপুলায়তন ধর্মীয় আয়োজন আর হয় না। হজ্জ এজেন্সিগুলোর আর্থিক কর্মযজ্ঞ থেকে লাভালাভের হিশেব-নিকাশ ছাড়াও হজ্জে আছে সম্মিলনের শক্তি, ঐক্যবদ্ধতার ইশারা, লক্ষাভিসারী মানবস্রোতের উপর খোদায়ী রহমতের ইংগিত, আছে মানুষের বিন্দু অস্তিত্বে মহাজাগতিক অনুভবের এন্তেজাম।

বিশ্বসমাজের উপর হজ্জের নৈতিক প্রভাবও মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। সমাজের সব অগ্রগতি স্পর্শযোগ্য বা টানজিবল নয়। হজ্জ করার আগের ও পরের মানুষটি এক হওয়ার কথা না। বাকি জীবনের আমল ও আখলাক দিয়ে হজ্জকে আল্লাহর দরবারে মঞ্জুর করানোর জন্য হাজিকে সচেষ্ট থাকতে হয় বলে প্রচলিত আছে। এবারের লক্ষাধিক হাজি নিরাপদে হজ্জ শেষে ফিরে এসে তাদের সম্মিলিত নৈতিক প্রভাবে সুন্দর পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলুন, এই প্রার্থনা। তাদের এই প্রভাব ধরা পড়বে না হয়ত জিডিপি-জিএনপির প্রচলিত হিশাবে। রক্তশূন্যতায় ভোগা এ জাতি ও উম্মাহ ফিরে পাক অভিজ্ঞান, অনুভব ও কর্মের চাঞ্চল্য। সম্মানিত হাজিদের সবার জন্য নিরাপত্তা ও কবুলিয়াতের দোয়া করি আমরা।

হজ্জের সত্যিকার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বুকে ধারণ করে তারা ফিরে আসুন আমাদের জমিনে। হজ্জ্ব মজবুত করুক আমাদের সমাজের আধ্যাত্মিক-পরমার্থিক ভিত্তি, এই প্রার্থনা।

যারা হজ্জ্ব যেতে পারছি না, তাদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ জ্বিলহাজ্জের প্রথম দশ দিন। জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম ১০ দিনের নেক আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল উত্তম নয়। আর ঈদের আগের দিন ফজর থেকে শুরু করে ঈদের পরের তিনদিন পর্যন্ত (৯ জ্বিলহাজ্জ ফজর থেকে থেকে ১৩ জ্বিলহাজ্জ আছর পর্যন্ত) প্রতিটি ফরজ নামাজ শেষে একবার করে তাকবিরে তাশরিক উচ্চারণ করে বিশ্বের মুসলমানরা যেন একাত্ম হয়ে যায় হাজিদের সাথে। আরাফার দিন (হজ্জ্বের দিন) রোজা রাখার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মুসলিমরা তাওহিদ ও আব্দিয়াতের চেতনায় একদেহ ও এক আদর্শিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজের অস্তিত্বকে বাঙ্ময় ও দৃশ্যমান করে তোলে।

উম্মাহচেতনার এমন প্রদর্শনী, এমন আধ্যাত্মিক ঐক্য, আব্দিয়াতের এমন সামষ্টিকতা ইসলামের মর্মশাঁস। উম্মাহ-চেতনা নিয়ে দুটি হাদিসে নববি উল্লেখ করে গুটিয়ে আনছি লেখাটি—

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনদের পরস্পরের ভালোবাসা, অনুগ্রহ, হৃদ্যতা ও আন্তরিকতার উদাহরণ হচ্ছে একটি দেহ বা শরীরের মতো। যখন দেহের কোনো একটি অঙ্গ আহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন সারা দেহের সবগুলো অঙ্গই নিদ্রাহীন হয়ে পড়ে এবং কষ্ট-যন্ত্রণায় জরাগ্রস্ত ও কাতর হয়ে পড়ে।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)

২. মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরের মতো যার এক অংশ অপর অংশকে শক্ত গাঁথুনিতে ধরে রাখে। উদাহরণ দেখাতে গিয়ে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর এক হাতের আঙুলকে অপর হাতের আঙুলের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেখালেন। (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক