জগলুল আসাদের গদ্য ‘সূরা ফাতিহার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গ’

প্রকাশিত : মে ১০, ২০২০

মানুষের চাওয়াকেই প্রথম পরিশুদ্ধ করবার দরকার হয়। আমরা চাইতে জানি না, আল্লাহই শিখিয়ে দিচ্ছেন কী চাইতে হবে। আসলে মানুষের কী চাওয়া উচিত, প্রথমত এই শিক্ষাই দেয়া হয়েছে সুরা ফাতিহায়, এমন বাকভঙ্গিতে যে, মানুষ যখন সুস্থ হৃদয় ও আকলের অধিকারী হবে, তার হৃদয়ের পারমার্থিক অনুভূতিটুকু প্রকাশিত হবে এমন ভাষাতেই। কীভাবে খোদার অসীমত্বের কাছে সসীম বান্দা চাইবে, এটা খোদা শিখিয়ে না দিলে বান্দা যে নিজ আকাঙ্ক্ষা আর বাসনার অন্ধগলি হাতড়ে বেড়িয়ে হবে দিশেহারা! বান্দার হৃদয় কোন ভাষায় সাক্ষ্য দেবে ও আকুতি প্রকাশ করবে, কোন চাওয়াটাই ‘ফিতরাত’ এর চাওয়া হওয়া উচিত, তা-ই শেখানো হচ্ছে এই সুরায়। দোয়ার ভাষাটা যেন আমাদের মুখ থেকে বের করা হচ্ছে, যেন কলুষযুক্ত হৃদয়ের, আব্দের চাওয়াটা এমনি হবে। তাই এই সুরায় ‘আমি’ নেই, আছে ‘তুমি’। ‘তাদাব্বুরে কোরান’-এ আমিন আহসান ইসলাহীর এই জবাবে পাওয়া যাবে অনেকের এই প্রশ্নের উত্তর যে, কোরান তো আল্লাহর কিতাব, তাহলে ফাতিহায় কেন বলা হলো, আমাকে সরল পথ দেখাও...।’

সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালকের। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। সমস্ত প্রশংসা-কৃতজ্ঞতা আল্লাহর। কারণ কি? কারণ জগতসমূহকে তিনি প্রতিপালন করেন। চূড়ান্ত বিচারে প্রশংসা-ধন্যবাদ তারই যিনি উদ্ভব ঘটান, লালন করেন, প্রতিপালন করেন। আল্লাহকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে রব বা প্রতিপালক হিশেবে। আল্লাহকে প্রশংসা করা হচ্ছে তিনি রব্বিল আলামিন বলে, অর্থাৎ জগতসমূহের প্রতিপালক হিশেবে। তার মানে জগত শুধু একটি নয়, একাধিক; বলা ভালো অজস্র। মানবজগৎ ছাড়াও আছে ‘প্রাণী’ ও ‘অপ্রাণী’র আরো আরো জগৎ। নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহ, ভাষা, রঙ, আকার, লিঙ্গ, অণু-পরমাণু ইত্যাদি দ্বারা চিহ্নিত যত জগত আছে সবার ও সবকিছুর প্রভু পালনকর্তা আল্লাহ। সব কিছুই সৃষ্ট আল্লাহতায়ালা কর্তৃক। সব কিছুর সৃষ্টি, যত্ন, সামঞ্জস্যবিধান ও পরিণতি এক আল্লাহরই কর্তৃত্বে, যিনি রব।

আবার `আলামিন` শব্দের একটা ধাতুগত অর্থ পড়েছিলাম মনে পড়ে, মাওলানা আব্দুর রহীমের সুরা ফাতিহা নিয়ে একটা বইয়ে। `আলাম` মানে যে জিনিস অপর জিনিস সম্পর্কে জানার মাধ্যম হয়। তাই এই জগৎ ও এর নানা প্রপঞ্চ আসলে জানারও মাধ্যম। এই জগৎ না-দেখা কিছু একটার জানান দেয়। ‘জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান’। জানা জগৎ থেকে অজানা জগতের সন্ধানের সূক্ষ্ম জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রস্তাবনাও আছে সুরাতে।

আর রাহমানির রাহিম। আল্লাহতায়ালাকে বলা হচ্ছে রাহমান ও রাহিম। বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহ রব বা প্রতিপালক, এবং তাঁর এই প্রতিপালন-কার্য বা রবুবিয়াতের ভিত্তি হচ্ছে তার রহমত। কারণ আল্লাহ নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ‘আর রাহমানির রাহিম’ বলে ৷ আর-রাহমান মানে পরম করুণাময়। অর্থাৎ যার ভালোবাসা ও দয়া সর্বত্র ও সবার মাঝে ও জন্যে প্রবাহমান। আর আর-রাহীম মানে বিশেষ দয়ালু। অর্থাৎ তিনি বিশেষভাবে দয়ালু মুমিনদের প্রতি, মুমিনের জন্যে তার কিছু রহমত নির্দিষ্ট। রাহমান নির্বিশেষ, আর রাহিম বিশেষ। মরহুম মাওলানা আমিনুল ইসলাম মজার একটি ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন। রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের জন্যে রাষ্ট্রের সাধারণ আইন আছে, কিন্তু যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তাদের জন্যে রয়েছে রাষ্ট্রের বিশেষ আইন ও বিশেষ কিছু সুবিধা। আল্লাহর রাজত্বে মুমিন-অমুমিন সবাই তাঁর সাধারণ করুণার ভাগীদার, আর মুমিনরা পান তাঁর রবের বিশেষ নজর। রাহমান শব্দটির ভেতরে তাৎক্ষণিক, বর্তমানতা আর অস্থায়িত্বের ব্যঞ্জনা আছে। আর রহমানের ভেতরে আছে স্থায়িত্ব ও প্রবাহমান ভালোবাসা ও দয়ার প্রসঙ্গ।

আল্লাহর দয়া ও ভালোবাসা নিয়ে হৃদয়-তোলপার হাদিস এসেছে বোখারি ও মুসলিমে, আল্লাহ রহমতকে একশো ভাগ করেছেন। তার মধ্যে নিরানববই ভাগ তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আর পৃথিবীতে একভাগ অবতীর্ণ করেছেন। ওই এক ভাগের কারণেই সৃষ্টজগৎ একে অন্যের উপর দয়া করে। আল্লাহর ইবাদতের কথা বলার আগে আল্লাহ তাঁর ভালোবাসার কথা বলে নিলেন আগে। পরের আয়াতেই আল্লাহ মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, বিচার দিবসের মালিক তিনি। মালিকি ইয়াওমিদ্দীন। ভালোবাসার কথা বলার পর আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালে যেন মনে করিয়ে দিচ্ছেন দায়িত্বশীল আচরণের কথা। কারণ তিনি বিচার করবেন। তাই আল্লাহর ভালোবাসার ও করুণার যেন অমর্যাদা করা না হয়।

সুতরাং আল্লাহ সম্পর্কিত উপরোক্ত জ্ঞানের দাবি এই যে, ইবাদত করতে হবে কেবল তাঁরই। আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি এবং কেবল আপনারই সাহায্য চাই— ইয়াকানা`বুদু ওয়া ইয়াকান`স্তাইন। বহুবচনে বলা হয়েছে বাক্যটি। আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং কেবল আপনারই সাহায্য চাই। এই আয়াতে তাওহীদের শিক্ষা ফুটে উঠেছে, ব্যক্ত হয়েছে তাওহীদে উলুহিয়াতের নীতি। ইবাদত হবে শুধুই আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট, শুধুই আল্লাহর জন্যে ৷আর সাহায্যও চাইতে হবে শুধু আল্লাহর কাছেই। অন্য কারো কাছে নয়। তাওহীদের বিপরীত শিরক। শুধু আল্লাহরই কাছে চাই এই বলে মুমিনকে শিরকের ক্ষমার অযোগ্য মহাপাপ থেকে মুক্তির পথ দেখানো হলো এই আয়াতে কারীমাতে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রকৃত ক্ষমতা নেই কাউকে সাহায্য করবার। আবার আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর সাহায্য চাইতে হবে। সুরা বাকারায় আল্লাহ মুমিনকে সাহায্য চাইতে বলেছেন সালাত ও সবরের মাধ্যমে। ‘আমরা কেবল আপনারই ইবাদত করি ও কেবল আপনারই সাহায্য চাই।’ এখানে বান্দাকে উপস্থাপন করা হয়েছে বহুবচনে, ইঙ্গিত হচ্ছে, ইবাদত করতে সবাই, সবাই মিলেই হতে হবে আব্দিয়াতের চিহ্নায়িত (Signified)। মুমিনদের ‘আমরাত্ব’ (We-ness) প্রকাশক এই অভিব্যক্তিতে ‘উম্মাহ’ চেতনা সুস্পষ্ট। মুমিনরা ‘আমরা’, আর বাকিরা ‘তারা’।

প্রথম তিন আয়াতের দাবি এই যে, ইয়াকা না`বুদু। মানে, আমরা আপনারই ইবাদত করি ও করবো। আর ‘আপনারই সাহায্য চাই’ এর দাবি সবচেয়ে বড়। যে সাহায্য যার নাম হেদায়াত সেই প্রসঙ্গ আসা। পরবর্তী তিন আয়াত কারা হেদায়াতপ্রাপ্ত আর কারা নয়, তার অনবদ্য আলোচনা।

সাহায্যের একটি আরবি হচ্ছে নসর। এই শব্দ থেকেই এসেছিল আনসার শব্দটি অর্থাৎ সাহায্যকারী। তবে এই আয়াতে নসর ব্যবহার না করে ব্যবহার করা হয়েছে ‘নাসতাইন’ শব্দটি, যেটি এসেছে মিশারি আল খারাজ জানাচ্ছেন, ‘আউন’ শব্দ থেকে। যার অর্থ Assistance বা সহায়তা৷ নসর হচ্ছে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ বিষয়ে সাহায্য। আর নাসতাইন শব্দের ভেতরে সর্বসময়েই সহায়তার দ্যোতনা আছে। কেবল আল্লাহর কাছেই আমরা সর্বসময়ে সাহায্য চাই। প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্তে সহায়তা চাই।

এই সাহায্য চাওয়ার একটা রূপ হচ্ছে জীবনে চলার সঠিক পথের সন্ধান। ইহদিনাস সিরাতুল মুস্তাকিম। আপনি আমাদের সরল-দৃঢ় পথ দেখান। হিদায়া, হাদিয়া, হুদা, হেদায়াত একই মূল থেকে উদগত। ইহদিনা মানে হাত ধরে বা সাথে থেকে পথ দেখিয়ে নেয়া। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে তিনি যেন আমাদের নিজে সারাক্ষণ আমাদেরকে সঠিক-সোজা পথে রাখেন।

সিরাত শব্দের অর্থ পথ। এটি এবসলিউটলি সিংগুলার, এই শব্দের প্লুরাল নেই। পথের আরেকটি আরবি হচ্ছে সাবিল, যার বহুবচন আছে। বান্দা চাচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকিম— সরল ও সোজা পথ, ভারসাম্যপূর্ণ পথ, এমন পথ যা কোনও এক দিকে ঝুঁকে পড়ে না। যে পথই একমাত্র নিশ্চিতভাবে ঠিক পথ। অজস্র বক্র পথের মধ্যে একটি সোজা পথ। বান্দা আল্লাহর কাছে চাচ্ছে সেই একক সরল ও মধ্যপন্থি পথের সন্ধান যেখানে সে দৃঢ় থাকতে পারবে।

সেই পথের পরিচয় কি? শুধু কি পথ চিনলে চলবে, নাকি চিনে দেওয়ার দরকার পরবে পথের সঙ্গী ও দিশারীদেরও? যে পথ বাঞ্ছিত নয়, সেই পথের পথিক কারা, কিইবা পরিচয় ভ্রান্ত পথের— জানা দরকার তা-ও। পথ হবে সরল-সোজা। আর যেই পথের পথিক হচ্ছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামতপ্রাপ্তরা, আল্লাহ বান্দাকে শেখাচ্ছেন সেই পথ চাইতে— সিরাতুল্লাজিনা আনআমতা আলাইহিম। নেয়ামতপ্রাপ্ত কারা তাঁদের পরিচয় ছড়িয়ে আছে পুরো কোরান জুড়ে। তাছাড়া স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে নেয়ামতপ্রাপ্তদের বর্ণনা সুরা নিসার ৬৯ নং আয়াতে— যারা আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করে, তারা নবি, সিদ্দীক, শহিদ এবং নেককার লোকদের সঙ্গী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ নিআমাত দান করেছেন, তারা কতই না উত্তম সঙ্গী।’ নবি, সিদ্ধিক, শহিদ ও সালেহীন (সৎকর্মশীলরা) যে পথের পথিক, সেই পথেই যুগে যুগে বর্ষিত হয়েছে খোদার সন্তুষ্টি ও নেয়ামত। এর বিপরীতে সুরা ফাতিহায় উল্লেখ আছে ভ্রান্ত দুটি গোষ্ঠীর। ইন্টারেস্টিং হচ্ছে, এই সুরাতে পথের বৈশিষ্ট চিহ্নিত হয়েছে পথিক ও তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য দ্বারা। ‘সেই পথ নয় যেই পথ অভিশপ্ত (মাগদুব) ও পথভ্রষ্টদের (দাল্লীন)’। মাগদুব হচ্ছে তারা যাদের জ্ঞান ছিল কিন্তু জ্ঞানানুযায়ী আমল করেনি, আর দাল্লিন হলো তারা যারা অজ্ঞান, ফলে তারা যে কাজ করে তা বেঠিক হয়। তফসিরবিদরা বলেন, ইহুদিরা অন্তর্ভুক্ত প্রথম দলে, দ্বিতীয় দলে নাসারারা। অনুসরণীয় ও পরিত্যায্য, বন্ধু ও শত্রু, আল-ওয়ালা আল-বারার নীতিও যেন ঘোষিত হলো সুরাটিতে।

এই সুরার প্রথম তিন আয়াতে ঘোষিত হয়েছে আল্লাহর পরিচয় সংক্রান্ত জ্ঞান— আল্লাহতায়ালা রব, রাহমান, রাহিম, মালিক। তারপরই এসেছে, সেই জ্ঞানের আলোকে আল্লাহর বান্দার আল্লাহর ইবাদত করবার ও তার কাছে সাহায্য চাইবার র‍্যাশনাল চয়েজের কথা, স্বাধীনভাবে ও স্বেচ্ছায় আল্লাহর আব্দ বা দাস হওয়ার কথা। তারপরেই আসে তিন শ্রেণির মানুষের কথা, যারা নিয়ামতপ্রাপ্ত, যারা অভিশপ্ত ও যারা পথভ্রষ্ট। নিয়ামতপ্রাপ্তরা স্রষ্টার জ্ঞান অনুযায়ী ইবাদত করে, কিন্তু অভিশপ্তদের জ্ঞান আছে আমল নাই আর পথভ্রস্টদের আমল আছে কিন্তু জ্ঞান না থাকায় তারা সত্যবিচ্যুত। সুরাটিতে জ্ঞান ও কর্ম, আল্লাহর ভালোবাসা ও বান্দার দায়িত্ব, আল্লাহর পরিচয় ও বান্দার পরিচয় এতো অপূর্ব ভারসাম্যে আলোচিত হয়েছে যা বিস্ময় জাগানিয়া। প্রতিটি অংশ আরেক অংশের সাথে যুক্ত, এক আয়াত আরেক আয়াতের সাথে পরিপূর্ণ ভারসাম্যে স্থাপিত।

সুরাটি নিয়ে রচিত হয়েছে বড় বড় কিতাব। মানুষের কী সাধ্য এই ছোট্ট সুরাটির বড়ত্বকে পুরো বুঝে ওঠা। শত শত তাফসিরে উন্মোচিত হয়েছে এই সুরার নানামাত্রিক অর্থগত, দার্শনিক ও ভাষিক ব্যঞ্জনা, এবং আরো উন্মোচিত হতে থাকবে ক্রমাগত... শুধু চাই আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক