রবার্ট ফ্রস্ট

রবার্ট ফ্রস্ট

জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘ফ্রস্টের কবিতা: প্রাত্যহিক জীবনের দর্শন’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০২০

রবার্ট ফ্রস্ট যেমন স্বচ্ছন্দে লিখতে পারেন দীর্ঘ ন্যারেটিভ কবিতা, তেমনি তিনি অনায়াস ও স্বতঃস্ফূর্ত ছোট পরিসরের লিরিকধর্মী কবিতা রচনায়ও। তিনি যেমন হতে পারেন আবেগে টলোমলো, তেমনি আবার হতে পারেন নিঃস্পৃহ ও নিরাসক্ত, রচনা করতে পারেন নিজের সাথে দ্রষ্টব্য ঘটনার নিরাবেগ দূরত্ব। মাঝে মাঝে তার কবিতায় ঝলকে উঠে বাকসংযমের অপূর্ব নমুনা।

Out Out কবিতায় যে ছোট্ট ছেলেটি করাতকল দিয়ে কাঠ কাটতে যেয়ে করাতের উপর হাত পড়ে হাতটুকু ছিন্ন হয়ে রক্তপাতে মারা যায়, তার মৃত্যু দৃশ্যকে মাত্র তিন শব্দের পরম সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তিতে ফ্রস্ট বর্ণনা করেন, Little less Nothing। মৃত্যুপথযাত্রী ছেলেটিকে ঘিরে থাকা দর্শকেরা শুনতে পায় নিঃশেষিত হচ্ছে বালকটির জীবনপ্রদ্বীপ, কমে আসছে হৃৎপিণ্ডের শব্দ: সামান্য—  সামান্যতর— অতঃপর নৈঃশব্দ্য।

তারপর সবাই ফিরে যায় যার যার কাজে, যেন কারো মৃত্যু নিয়ে দীর্ঘসময় শোক করবার বিলাসিতার সময় তাদের নেই। জীবন ও জীবিকার টানাপোড়েন তাদেরকে প্রায়শই উপভোগ করবার সুযোগ দেয় না প্রকৃতির রূপ ও বিভা।

এক আশ্চর্য নিরাসক্ত ভঙ্গিতে তিনি নিউ ইংল্যান্ডের মানুষের যাপিত জীবনে শ্রমশীলতা, জীবিকার অনিশ্চয়তা ও বেঁচে থাকার নির্মম আকুতি চিত্রিত করেন। জীবনের উপরিতলকে খুঁড়ে খুঁড়ে তিনি এমন সব উপলব্ধি তুলে আনেন যা একই সাথে সহজ ও গভীর, অন্তরঙ্গ ও অপরিচিত। তিনি জীবনকে কবিতা করে তোলেন, কথোপকথনকে করে তোলেন সংরক্ত দর্শন, মানুষী অনুভবের স্বতন্ত্র ও সূক্ষ্ম বিনুনি।

দুই.
আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্টের বহুল উদ্ধৃত কবিতা মেন্ডিং ওয়াল। কবিতাটির শুরু কথকের ঘোষণা দিয়ে, something there is that does not love a wall আর সমাপ্তি Good fences make good neighbors ঘোষণায়। ফ্রস্টের সব কবিতাতেই থাকে কোনো না কোনো প্রজ্ঞাবাক্য, আর থাকে আলাপচারিতা। আলাপে আলাপে উন্মোচিত হয় মত, ভিন্নমত আর ঐকমত্যের আপাত অদৃশ্য কিছু পরিসর।

ফ্রস্টের উল্লেখ করা দুটো বিপরীত ভাবনা বা মতের উভয়টিতেই থাকে কিছু সত্য ও কিছু সীমাবদ্ধতা। তার একটা বৈশিষ্ট হচ্ছে, তিনি তার কাব্যের কথককে অনেক সময়ই আইরনিকালি উপস্থাপন করেন, কথকই তার স্পোকস ম্যান নয় সদা-সর্বদা।

তো, এই কবিতাটির কথা মনে পড়লো ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসী নীতির বিষয়ে। প্রথমে তিনি দেয়ার তুলতে চেয়েছিলেন এরপর সিদ্ধান্ত বদলে তিনি বেড়া নির্মাণের কথা বলেন। ফ্রস্টের মেন্ডিং ওয়াল কবিতাটিরও ভরকেন্দ্র ওয়াল আর ফেন্স এর পার্থক্যের উপরে দাঁড়ানো। কবিতার কথক চান সমস্ত দেয়াল ভেঙে দিতে। কারণ প্রকৃতি দেয়াল পছন্দ করে না (something there is that does not love a wall)।

দেয়াল ক্ষয়ে যায় রোদে-বৃষ্টিতে, মাটির ঢিবিও সমান হয় জলে–হাওয়ায়। অন্যদিকে, কবিতার কথকের প্রতিবেশী ঐতিহ্যপন্থী, তথাকথিত রক্ষণশীল। তিনি তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পদের মালিকানার ধারণায় অটল আস্থা রাখেন, তার কাছে সীমানা চিহ্নিতকরণ ও মালিকানা নির্ধারণ গুরুত্বপুর্ণ। জল ও জমির মালিকানার প্রশ্ন, অবশ্য ভিন্ন নান্দনিক কোণ থেকেও ফ্রস্ট  তোলেন— stopping by woods on a snowy evening কবিতায়।

কবিতাটির প্রথম লাইনেই তিনি স্বত্বের প্রসঙ্গ তোলেন— Whose woods these are I think I know। এই প্রশ্নের অগোচরে লুকিয়ে থাকে আরেকটি প্রশ্ন। এই বনের প্রকৃত মালিক কে? যিনি এর ভূমির মালিক কিন্তু এই বনাঞ্চল থেকে থাকেন দূরের কোনো গ্রামে, যিনি বনের রূপ উপভোগ করতে জানেন না, তিনি? নাকি বনের ও পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশের মান্দ্র সৌন্দর্যে বিহ্বল যিনি, তিনি? যাহোক, Mending Wall কবিতার বয়স্ক প্রতিবেশী দেয়াল দেখেন না কোথাও; দেয়ালকে তিনি বলেন ফেন্স বা বেড়া।

বেড়া বেয়ে ওঠা যায় সহজেই, ওই পারও দেখা যায় অনায়াসেই। তার মতে, Good Fences make good neighbours। প্রতিবছর দেয়াল মেরামতের সূত্র ধরেই দেখা হবে দুই প্রতিবেশীর, কথা হবে, চলা হবে। কবিতাটির একটি মজার মুহূর্ত হচ্ছে, যে-কথক দেয়াল তৈরির বিরুদ্ধে সে-ই দেয়াল মেরামতের জন্য ডেকে আনে তার প্রতিবেশীকে, দুজনে হাঁটে, হাত লাগায় সংস্কার কাজে। এভাবে যোগাযোগের এক মুহূর্ত তৈরি হয়। ওয়াল আর ফেন্সের পার্থক্য ট্রাম্প হয়তো নিয়ে থাকবেন তারই দেশের মহান কবি রবার্ট ফ্রস্টের কাছ থেকে।

তো, এত হলো ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যোগাযোগের প্রসঙ্গ, জাতিতে জাতিতে বা ভিনদেশের ক্ষেত্রে, অভিবাসী বা অনাবাসীদের ক্ষেত্রে এটির প্রয়োগ কীরূপে হইবে?

তিন.
বাড়ি ছেড়ে আমরা বাসায় যাই অথবা বাসা ছেড়ে বাড়ি। ঈদে ও পার্বণে আমরা দেশে যাই। দেশ ও বাড়ি শব্দগুলো ভালো লাগে। এগুলো আসলে জায়গা নয়। এগুলো সম্পর্কের নাম। বলা হয়, উই গো হোম। ইংরেজিতে হোম একই সাথে Noun ও Adverb হিসেবে বসে। to Dhaka হলেও টু হোম বলা হয় না। হৃদয় যেখানে, হোম সেখানে, বাড়ি সেখানে, দেশও সেখানে। বাড়ির সাথে জড়িয়ে থাকে অর্গানিক স্মৃতি, কাতরতা। স্নিগ্ধ ও পরিব্যাপ্ত। বাসাবাড়ি বলেও শব্দ আছে একটি। বলা হয়, বাসাবাড়ি করছেন কিছু?

আমাদের হৃদয়ের নানা গোপন অন্বেষণ ধরা থাকে ভাষায়, শব্দের সংকরে, ফ্রয়েড মশাই বলেছেন। বাসার একাকিত্ব ঘুচাতে বাড়ির সমবেত সম্পর্কের অনুভব যোগ করে বলি, বাসাবাড়ি। রবার্ট ফ্রস্টের ডেথ অব আ হায়ার্ড ম্যান নামের একটি কবিতা আছে। কবিতাটি স্বামী ও স্ত্রীর কথোপকথন, তাদের একদার গৃহকর্মী সাইলাসকে নিয়ে। এক অপূর্ব মানবিক মুহূর্ত রচিত হয়েছে কবিতাটিতে। স্বামী ওয়ারেন প্রশ্ন তোলে স্ত্রী মেরির ‘সাইলাস বাড়ি ফিরে এসেছে’ বাক্যের বাড়ির অর্থটুকু নিয়ে। ওয়ারেনের কাছে হোম হচ্ছে, ফিরে আসা ও আন্তরিকভাবে বের হওয়ার হওয়ার পারস্পারিক সম্পর্ক—

Home is the place where
when you have to go there
They have to take you in.

অন্যদিকে স্ত্রী মেরির কাছে বাড়িতে ফিরে আসা সময়, যোগ্যতা ও বরণের সাথে সম্পর্কহীন— Something you somehow haven’t to deserve.

স্ত্রীর মনে হয়, সাইলাস বাড়িই এসেছে। স্থান রূপান্তরিত হয় সম্পর্কে আর সম্পর্ক রূপান্তরিত হয় স্থানের মেটাফোরে। সমগ্র জগতই প্রশংসা করে তাকে, যে যোগ্য। হোমই একমাত্র জায়গা যেখানে প্রবেশে ও অবস্থানে কোনো বিশেষ যোগ্যতা লাগে না। বাড়িতে দুর্বলই সকলের স্নেহের পাত্র; অযোগ্যই সকলের মায়ার বাধনে বাঁধা। রুগ্ন মেয়েটি যেন মায়ের চোখের মনি। সকল দুয়ার বন্ধ হলেও খোলা থাকে অন্য কোনো দুয়ার; সকল প্রদীপ বন্ধ হলেও একটি পিদিম মিটিমিটি জ্বলে। এমন কেউ থাকে, এমন কেউ আসে, সকলে মুখ ফিরিয়ে নিলেও যে মুখ ফিরিয়ে নেয় না, সকলে দূর দুর করে তাড়িয়ে দিলেও যে দুহাত বাড়িয়ে রাখে।

কেউ থাকে, কেউ আছে সবার। সম্পর্কের অযুক্তিটুকু মানবিক। স্বার্থের  হিশেবের বাইরেরটুকুই আমাদের সত্যকার মানুষিতা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক