জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘লিবারেলিজম’

প্রকাশিত : জুন ২৮, ২০২০

লিবারেলিজমের বাংলা সাধারণত করা হয়, উদারনীতিবাদ। একে স্বাধীনতাবাদ বা খাহেশাতবাদ বললেও অত্যুক্তি হবে না। এর ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, বিবর্তনও জটিল। সাধারণত জন লককে এর প্রবক্তা বলা হলেও ইউরোপীয় রেনেসাঁস, রিফর্মেশন আন্দোলন, আর এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের সাথে লিবারেলিজমের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগ আছে। পশ্চিমা চিন্তায় অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে যা পরিচিত সেটার ভেতর থেকে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে লিবারেলিজমের জন্ম। একটা এন্টি-অথরিটারিয়ান পলিটিকাল ক্রীড হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা হয়। লিবারেলিজম মানুষকে ভাবে স্বাধীন ও যুক্তিশীল সত্তা হিশেবে, যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, নিজের পছন্দ অনুসারে বাছাই করতে পারে। গুড লাইফের কোনো সংজ্ঞা রাষ্ট্র চাপিয়ে দেবে না জনগণের উপর, বরঞ্চ রাষ্ট্র একটা অধিকার-কাঠামো দেবে যেখানে ব্যক্তিমানুষ নিজের মূল্যবোধ, ধর্মবিশ্বাস ও  জীবনযাপন প্রণালি বাছাই করে নেবে।

সমাজ পরিসরে, ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব ও ব্যক্তির প্রাথমিকতাকেই স্বীকার করে নিতে হবে। সমাজ বলে আসলে তেমন কিছু নাই, আছে ব্যক্তিসমষ্টি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, ব্যক্তি তার সম্পদ অর্জন করবে, ব্যয় ও উৎপাদনে সে স্বাধীন। ব্যক্তিস্বাধীনতা, সুখ ও অধিকার লিবারেলিজমের চাবিশব্দ ও চাবিধারণা। রাষ্ট্রের কাজ ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে রক্ষা করা। মার্গারেট থ্যাচার তো একবার বলেই ফেলেছিলেন, সমাজ বলে কিছু নেই, আছে ব্যক্তি ও পরিবার। ব্যক্তিমানুষের সর্বোচ্চ সুখ নিশ্চিত করবার উপযোগবাদী দর্শনই হচ্ছে লিবারেলিজম। ব্যক্তিমানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্যেই আইন। লক, এডাম স্মিথ, আর জন স্টুয়ার্ট মিল লিবারেল দর্শনের প্রধান পুরোহিত। প্রধানত তাঁদের চিন্তার ফল হিসেবেই লিবারেল আইডিয়াজগুলো পশ্চিমা সমাজে কর্তৃত্বশীল ও গ্রহণীয় হয়েছে। আমেরিকান বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব ও শিল্পবিপ্লব— এই তিনটি বিপ্লব লিবারেলিজমের দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত রচনা করেছে। আমরা এই ছোট নিবন্ধে, সংক্ষেপে, লিবারেল দর্শনের দার্শনিক উৎস ও ইতিহাস অনুসন্ধান করবো। দেখব, দর্শন কীভাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতির হাত ধরে বৈশ্বিক ও সর্বজনীনতার দাবিদার হয়ে ওঠে।

জন লক একাই পশ্চিমা রাজনৈতিক লিবারেল থটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্যের যোগানদাতা। তিনি বিশ্বাস ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতার কথা বলেন। তার A letter concerning Toleration (1689) এ ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্টদের মধ্যে দ্বন্দের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি যুক্তি নিয়ে আসেন ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে। প্রথমত, তিনি বলেন, কোনো জাগতিক বিচারক (Earthly judges) সে হোক রাষ্ট্র বা ব্যক্তি— নির্ভরযোগ্য উপায়ে বিবাদমান ধর্মগুলোর Truth-claim বা সত্য হওয়ার দাবিকে পরীক্ষা বা মূল্যায়নে সক্ষম নয়। দ্বিতীয়ত, যদি একক কোনো ধর্মের সত্য-দাবি মেনে নেয়াও হয় তবে সবাইকে সেই বিশ্বাসে বিশ্বাসী করতে ভায়োলেন্সের দরকার পড়বে। তৃতীয়ত, যদি সবাইকে একক ধর্মাবলম্বী করতে বল প্রয়োগ করতে হয় তবে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। সবচেয়ে ভালো, সমাজে বিশ্বাসের বৈচিত্র্য থাকা। এভাবে প্রত্যেকে যার যার ধর্ম পালন করবে এবং সমাজে ধর্মবিশ্বাসের বৈচিত্র্য থাকবে এবং রাষ্ট্রে কোন ধর্ম জনগণের উপর চাপিয়ে দেবে না— এই মতগুলোর বিকাশ ঘটে। ১৭৬৩ সালে The Treatise on Tolerance নামে ভলতেয়ারেরও একটি বই বের হয়। যাহোক, স্মরণযোগ্য যে, জেফারসনের আমেরিকার যে স্বাধীনতার ঘোষণা (১৭৭৬), এই ঘোষণা বিপুলভাবে লকের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত।

জন লকের টু ট্রিটিজ অব গভার্ণমেন্ট (১৬৮৯) বলে একটা বই আছে। এটার পরিপ্রেক্ষিত ব্রিটেনের গৌরবময় বিপ্লব (The Glorious Revolution,1688) যা রক্তপাতহীন বিপ্লব (ব্লাডলেস রেভ্যুলেশন) নামেও পরিচিত। প্রথম ট্রিটিজে, তিনি রবার্ট ফিলমার নামক আরেক দার্শনিকের বই প্যাট্রিয়ার্কার ধারণাগুলোকে খণ্ডন করেন। লক দেখান, গড কোনো রাজা বানান না, রাজার কোনো দৈব অধিকারও নেই। দ্বিতীয় ট্রিটিজে, তিনি বাইবল থেকে যুক্তি দিয়ে দেখান আদমের তিনটি অধিকার আছে— লাইফ, লিবার্টি আর প্রোপার্টি। রাষ্ট্রকে জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পদকে রক্ষা করতে হবে। যদি রাষ্ট্র জনগণের এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় তবে জনগণের অধিকার থাকবে সরকার উৎখাতের। জনগণ রাজাকে তাদের সার্বভৌমত্ব দান যেমন করতে পারে, তেমনি আবার ফিরিয়েও নিতে পারে। থমাস হবস উল্টো কথা বলেছিলেন, জনগণ তার সার্বভৌমত্ব রাজাকে দিতে পারে শুধু, কিন্তু ফিরিয়ে নিতে পারে না। জন লকের এই অধিকারের ধারণা আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রায় পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে, পশ্চিমা রাজনৈতিক দর্শন ও অর্থনীতিচিন্তা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবেই ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব ফেলে ও ফেলেছে। জেফারসন রচিত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের দিকে তাকালে লিবারেল ফিলোসফি ও লিবারেল রাষ্ট্রের ধারণা স্পষ্ট হবে— We hold these truths to be self-evident, that all men are created equal, that they are endowed by their Creator with certain unalienable Rights, that among these are Life, Liberty and the pursuit of Happiness. That to secure these rights, Governments are instituted among Men, deriving their just powers from the consent of the governed, That whenever any Form of Government becomes destructive of these ends, it is the Right of the People to alter or to abolish it,
and to institute new Government, laying its foundation on such principles...

এটি প্রায় পুরোপুরি জন লকের মতের প্রতিধ্বনি। Life, liberty and Pursuit of Happiness এই তিন নীতিকে Ameican Dream বলা হয়। প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন, সমান, ও সুখ পাবার অধিকারী। জাগতিক ও শরীরী সুখ ও সফলতা আমেরিকার লিবারেলিজমের মূলমন্ত্র। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নীতিতে ঠিক হলেও বাস্তব প্রয়োগ ক্ষেত্রে, কালোরা কিন্ত শত শত বছর ধরেই অধিকার-বঞ্চিত আমেরিকার জমিনে। ১৮৬৩ তে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ স্পীচের ১০০ বছর পর ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথারের বক্তৃতাতেও (I have a dream by Martin Luther King Jr) আমেরিকার লিবারেল দর্শনে কালোদের অধিকার স্বীকৃত হওয়ার কথা বলা হলেও দশকের পর দশক গেলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায় নাই। লিবারেল দর্শন তত্ত্ব ও বাস্তব প্রয়োগে সবসময়ই কিছু ব্যতিক্রমের ধারণার উপর ভর করে এগোয়।

জার্মান দার্শনিক উইলহেম ভন হামবোল্ড (১৭৬৭-১৮৩৫) যুক্তি দেন, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে তখনই মেনে নেয়া যায় যখন অপরের ক্ষতি থেকে আরেক ব্যক্তিকে রক্ষা করবার প্রশ্ন আসবে। হামবোল্ডের The limits of State Action (লেখা ১৭৯০ এর দিকে, মরোণোত্তর প্রকাশ ১৮৫২ সালে) বইটি থেকে জেমস স্টুয়ার্ট মিল তাঁর On Liberty (১৮৫৯) বইয়ে Harm principle গ্রহণ করেন, যেটি লিবারেল ফিলোসফির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পিলার— আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারবেন, যতক্ষণ না তা অপরের ক্ষতি করে। আমাদের স্মরণে আসতে পারে, ফ্রয়েডের প্লেজার প্রিন্সিপালের কথা, যেখানে ফ্রয়েড বলেন, আত্মতুষ্টির বা আত্মসুখের নীতি আমাদের (Id এর) চালিকাশক্তি। Civilization and its discontents এ দেখাচ্ছেন, মানুষের ইন্দ্রিয়সুখ বা আনন্দের যে স্বাধীনতা, সভ্যতার আইন-কানুন এসে তাকে অবদমিত করেছে, মানুষের দুখের কারণ হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ, শৃঙখলা, ডিসিপ্লিন ইত্যাদি আমাদের কামনা-বাসনাকে অবদমিত করে মনোবিকারে জন্ম দেয় বলেও ক্লাসিকাল ফ্রয়েডিজম জানায় (ফ্রয়েডের অনেক রকম পাঠ আছে)। একটু দূরবর্তী হলেও, এ কথা অবশ্যই বলা যাবে, নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতাতেই সর্বাধিক সুখ নিশ্চিত হবে বলে ফ্রয়েডেরও একরকম বিশ্বাস। মানুষের মনের অতল অনুসন্ধান ফ্রয়েডের অবদান স্বীকৃত হলেও ফ্রয়েডের নানা রকম সমালোচনা-পর্যালোচনা-নবপাঠ আছে। ফ্রয়েডকে সাইকোলজিকাল লিবারেলিজমের প্রবক্তা হিসেবেও পাঠ করা যাবে।

প্রসঙ্গত বলা যায়, ফ্রয়েড যেটাকে অবদমন বলতে চায় ইসলাম সেটাকে সবর বা ধৈর্য বলে। ইসলাম ও লিবারেলিজম প্রসঙ্গে অন্যপর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের জন্যে সর্বোচ্চ ভালো বা সুখের তত্ত্ব নিয়ে মিল হাজির হন। তাঁর মতে, সমাজের অধিক সংখ্যক মানুষের সুখের জন্যে কিছু সংখ্যক মানুষের আত্মত্যাগ যুক্তিসংগত ও প্রয়োজনীয়। এই তত্ত্ব অপরের কষ্টকে খুব বেশি আমলে আনে না। সুখবাদী এই তত্ত্ব, একজন নিরীহ লোকের প্রাণের বিনিময়ে হলেও ৫ জন অপরের সুখ নিশ্চিতে গড়রাজি হবে না। আগেই বলেছি, সর্বোচ্চ সুখ নিশ্চিত করা ও তার ব্যবস্থা করা লিবারেল ফিলোসফির লক্ষ্য। Adam Smith চান জনগণ ও জাতিকে সুখি করার তত্ত্ব দিতে। তাঁর অন্যতম লক্ষ্য ছিল মানি সিস্টেমটা বুঝা। কনসুমার ক্যাপিটালিজমের পক্ষের লোক তিনি। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রধান তাত্ত্বিক। অর্থনৈতিক লিবারেলিজমের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। একটা ভাল ক্যাপিটালিস্ট সোসাইটি কাস্টমারদের শুধু চয়েসই অফার করে না, যাতে তারা তাদের বাছাই করবার স্বাধীনতাকে প্রয়োগ করতে পারে তা শেখানোর ব্যবস্থাও করে। সেল্ফ-ইন্টারেস্টই অর্থনীতিকে সচল রাখে। আত্মস্বার্থ পূরণের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মিটলেই সমাজ উপকৃত হবে।

অর্থনৈতিক প্রাণী হিসেবে আত্মস্বার্থ পূরণের ঝোঁক মানুষকে প্রোসপারিটি বা সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। একে তিনি Enlightened Self-interest বলেন। স্মিথ এক কসাইয়ের উদাহরণ দেন। কসাই মাংস বিক্রি করে কোন উপকারের মনোভাবের জন্যে না, বরঞ্চ লাভের জন্যে। কসাইয়ের এই লাভ করাটা অন্যেরও উপকার হয়। তিনি ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত The Wealth of Nations এ দেখান কী করে একটা জাতি উন্নতির শিখরে উঠতে পারে। তিনটি জিনিস প্রধানত তিনি এখানে আলোচনা করেন— শ্রমবণ্টন, মজুরি ও বাজার সম্প্রসারণ। একজন ব্যক্তি অনেক ধরনের কাজ না করে বিশেষ কোনো কাজ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, প্রোডাকশন টাইমও কম লাগবে। এজন্যে প্রয়োজন কর্মবণ্টন। আবার, সবাই সমান মুজুরি পাবে না। কঠিনতম কাজের জন্যে অধিক বেতন প্রযোজ্য হওয়া উচিত আর, দরকার বাজার সম্প্রসারণ যাতে এক দেশ আরেক দেশের পণ্য থেকে উপকৃত হতে পারে। তিনি ভোগ ও উৎপাদনের স্বাধীনতার কথা বলেন। তবে তার অর্থনীতি দর্শনের অন্তর্নিহিত (Underlying) কথা হচ্ছে, প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের পরিচয় হলো, সে স্বাধীন ভোক্তা ও সুখ সন্ধানি। লিবারেলিজম মার্কেট ইকনোমির মধ্যেও স্বাধীনতার মায়া তৈরি করে।

লিবারেলিজমের ব্যতিক্রম তৈরির বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মিল যখন স্বাধীনতার কথা বলেন, তখন কিন্তু তিনি ভারতীয়দের স্বাধীনতার অধিকার স্বীকার করেন না, আবার মিল্টন তার ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে ক্যাথলিকদের বাদ দেন। এইভাবে Making exceptions বা ব্যাতিক্রম রাখা লিবারেল চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লিবারেলিজমের নানা ঘরানার সমালোচনা আছে। তবে লিবারেলিজমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও শক্তিশালী সমালোচনা করা হয় মার্ক্সবাদী ও ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে। মার্ক্সবাদ আর লিবারেলিজমের পার্থক্য বোঝাতে ফরহাদ মজহার লেখেন— লিবারেলিজমের গোড়ায় রয়েছে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার, আর মার্কস সারা জীবন লড়েছেন উৎপাদনের উপায়ের উপর সামাজিক মালিকানা কায়েমের জন্য।... তাছাড়া লিবারেলিজম ব্যক্তিতন্ত্র বা ব্যক্তির অধিকারকে সামাজিক বা সামষ্টিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে করে, মার্কস মনে করেন ব্যক্তিতন্ত্র একান্তই লিবারেল বা বুর্জোয়া সমাজের আদর্শ। ব্যক্তি লিবারেলিজমে নিজের স্বার্থকে সমাজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে মনে করে। মার্কস তার উলটা, ব্যক্তি বুঝুক বা না বুঝুক ব্যক্তি সমাজের বাইরে না, অতএব ব্যক্তির মুক্তি সমাজের মধ্যে, সমাজের বাইরে মানুষের মুক্তি নাই। মার্কস ব্যক্তির স্বার্থ আর সমাজের স্বার্থের দ্বন্দ্ব মোচনের জন্য সারা জীবন কাজ করেছেন। লিবারেলিজমের ভিত্তি সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা, মার্কস তার উলটা। মার্কসের পুরা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই হচ্ছে দেখানো যে সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা কিভাবে পুঁজির রূপ পরিগ্রহণ করে, এবং বিপ্লবী রাজনীতির কর্তব্য কেন পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক উচ্ছেদ করা, যেন মজুরি দাসত্ব থেকে মানুষ মুক্তি পায়, উৎপাদনের উপায়ের উপর সামাজিক মালিকানা কায়েম করতে সক্ষম হয়।

তবে মার্ক্সবাদী সমালোচনা পশ্চিমের এনলাইটেনমেন্ট ঘরানারই। মার্ক্স নিজেই জার্মান এনলাইটেনমেন্ট, ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদ, আর ফরাসি রাজনৈতিক চিন্তার সন্তান। সংক্ষেপে লিবারেলিজমের দার্শনিক বক্তব্যগুলোকে নিম্নে সংক্ষেপে উল্লেখ করলাম যাতে তাদের কয়েকটি ধরে পরবর্তীতে ইসলামি পর্যলোচনা হাজির করা যায়—

* জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে সুখ অর্জন, বিকাশ ও সমৃদ্ধি। ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যক্তি সুখকে বর্ধিত করে। ব্যক্তির বেছে নেয়ার (Personal Choice) স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে (Individual liberty) বাড়িয়ে দেয়। লিবারেলিজমের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে লিবার্টি। কোনো কিছু লিবারেল ফিলোসফির ভেতরে পরে কিনা সেটি বুঝবার উপায় হচ্ছে, এটির লক্ষ্যের ভেতরে ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রসঙ্গ আছে কিনা।

* ব্যক্তি সমষ্টির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ব্যক্তি আলাদা ও অনন্য। নিজের ভালো-মন্দ ও স্বার্থ এর চূড়ান্ত যাচাইকারী ব্যক্তি নিজেই।

* আইনের শাসন। ব্যক্তি যাতে স্বাধীনতা উপভোগ করে বিকাশ ও অগ্রগতি লাভ করতে পারে তাই দরকার আইন৷ আইন ব্যক্তির জীবন, সম্পদ ও স্বাধীনতা রক্ষা করবে। এইটা নিউলিবারেলিজমে Good Governance বা সুশাসন নামে হাজির আছে।

* কোনো পবিত্র গ্রন্থের উপর নির্ভরশীলতা নয়, নির্ভর করতে হবে যুক্তি ও অভিজ্ঞতার উপর। ব্যক্তি স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবে, ব্যক্তি স্বাধীন থাকবে ধর্মপালনে। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার।

* সীমিত শাসন ও সরকার। সরকার ও রাষ্ট্র ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তি ও জনগণের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না যতক্ষণ তা অপরের ক্ষতির কারণ হয়।

* কর্তৃত্ববাদী প্রতিষ্ঠান বা আধিপত্যশীল মতাদর্শকে এবং ক্ষমতা ও যেকোন শৃঙ্খলা-ব্যবস্থাকে ক্লাসিকাল লিবারেল ফিলোসফি সন্দেহের চোখে দেখে। ব্যক্তির ইচ্ছা, কামনা ও বাসনাই প্রাধান্য পাওয়ার উপযুক্ত।

* স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলা। ব্যক্তি শুধু সেই শৃঙ্খলা মানবে যেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হয়। যেমন, মানুষের ভাষার বিধি বা শৃঙ্খলা মানতে অসুবিধা নাই।

* মুক্ত বাজারের মাধ্যমেই মানুষের চাহিদা পূরণ সর্বাধিক হয়। প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে সুখের উপযোগের সম্ভাবনা তৈরি হয়। অর্থনৈতিক উদারবাদে রাষ্ট্রের নিয়েন্ত্রণের চেয়ে বাজারের নিয়ন্ত্রণ বা অদৃশ্য হাতকেই অধিক পছন্দনীয় ভাবা হয়।

* সহনশীলতা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লিবারেল আইডিয়া। যেমতের সাথে দ্বিমত, সে মতের অধিকারকে স্বীকার করা লিবারেলিজমের অন্যতম স্তম্ভ। যদিও বাস্তবে এর বিপরীত বহু চর্চা পশ্চিমে দেখা যায়।

* ব্যক্তির যত অধিকার ও স্বাধীনতা তা প্রযোজ্য নন-এগ্রেসিভ ইন্ডিভিজুয়াল, অ-আগ্রাসী বা অহিংস ব্যক্তিদের জন্যে প্রযোজ্য।

* ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পদ ভালো, যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব সংঘাত খারাপ। তবে, পশ্চিমের বাস্তব প্রয়োগক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার অজুহাতে, আসলে নিজেদের জাতীয় স্বার্থে যুদ্ধসহ যেকোন নীতিই তাদের কাছে অগ্রহণীয় নয়। বিশেষ সংস্কৃতিচর্চাকে প্রগতিশীল ঠাওড়ানো, যুদ্ধ ও বাণিজ্য, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে লিবারেল মতাদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার তৎপরতা চিন্তা ও প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নাম নিয়ে লিবারেল আদর্শ হিসেবেই গৃহীত।

* সিভিল সোসাইটি উদারনৈতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সিভিল সোসাইটি রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে মধ্যস্ততা করে, আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করে। যেমন, নানারকম ভলানটারি অর্গানাইজেশন, ক্ষেত্রবিশেষে পরিবার ও চার্চ।

* জন্ম, ভূগোল, বংশ দিয়ে মানুষকে মূল্যায়ন না করে মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে তার ব্যক্তিগত গুণাবলি দ্বারা।

চমস্কির মতে, আধুনিক কালে লিবারেলিজম হচ্ছে অনেকটাই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। যাহোক, বিংশ শতকের আশির দশকে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোলান্ড রিগান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ও অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রীডম্যানের হাত ধরে নিওলিবারেলিজমের ধারণা জনপ্রিয় হয়। এটার মূল প্রিন্সিপালগুলোর বিস্তারিত আলোচনা আলাদা করে করা যাবে।

খুব সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলেও, লিবারেল অনেক আইডিয়ার সাথে ইসলামের পার্থক্য চোখে পড়বে। লিবারেলিজম ভোগবাদ (Consumersim) ও সুখবাদের (Hedonism) দিকে ঠেলে দেয়। লিবারেলিজম সমাজের সেকুলারাইজেশন ঘটায়। সেকুলারিজম ধীরে ধীরে ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোকে তিরোহিত করে। লিবারেল সমাজ সেই ধর্মীয়মূল্যবোধ বা নীতিগুলোই শুধু মানে যেগুলো তাদের ইচ্ছে বা বাসনার সাথে যায়।

ইসলাম নিজের ইচ্ছে বা বাসনাকে খোদা বানাতে নিষেধ করেছে। মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে, সৃষ্টিগত দিক থেকে সে গাফিল, তাই তার হেদায়াত প্রয়োজন। মানুষ তার জন্যে যে জীবন-ব্যবস্থা রচনা করে তাতে বাসনা-ইচ্ছে, ব্যক্তিগত, শ্রেণিগত বা দলগত স্বার্থ লেপ্টে থাকবে। ইসলাম মানুষকে তার খাহেশাতের উপর ছেড়ে দেয় না। আবার, ইসলামে মানুষের নানা ক্যাটেগোরাইজেশন আছে— মুসলিম, কাফির, মুশরিক, মুনাফিক, জিম্মি ইত্যাদি। সবার স্বাধীনতা ও অধিকারের সীমা-পরিসীমা ইসলানমে ডিফাইন্ড।

লিবারেলিজমের মূল প্রতিপাদ্যের সাথেই ইসলামের ভিন্নতা। আর ওই মূল থেকে উৎসারিত শাখা প্রশাখার প্রায় সবগুলোর সাথেই ইসলামি চিন্তাজগতের বিরোধ রয়েছে। ইসলামে মানুষ স্বাধীন নয়। সে আল্লাহর দাস। বান্দা। আল্লাহ তার মনিব, যে মনিবের করুণা তার ক্রোধকে ছাড়িয়ে যায়, যে মনিব শাস্তির ক্ষত্রে ইনসাফ করেন, যে মনিব দাস হেঁটে এলে মনিব দাসের দিকে দৌড়ে আসেন, যে মনিব তাঁর দাসকে ক্ষমা করেন, পথ দেখান, নির্দেশ দেন, পুরস্কৃত  করেন বেশুমার আর শাস্তি দেন অপরাধের পরিমাণ অনুসারে, তিনি ক্ষমাও করেন, অনুশোচনার সুযোগ দেন। কিন্তু মানুষকে নিজ খেয়াল অনুসারে চলতে নিষেধ করেন। মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয়, সে দাস। নবিজী (সা.) আগে দাস, তারপর রসুল।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক