
জাকির তালুকদারের গল্প ‘আমার বন্ধু শবনম’
উপন্যাস ১
প্রকাশিত : জুলাই ১০, ২০২০
আমার পকেটে সেদিন ছিল ১৫ টাকা। তখনো আমি মানিব্যাগ ব্যবহার শুরু করিনি। আসলে এতই অল্প টাকা থাকত কাছে যে মানিব্যাগে রাখলে তার ইজ্জতই চলে যেত। কেবলে লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছি। বেতন খুব কম। এরমধ্যেই প্রেমের বিয়ে সেরে ফেলেছি। মানে ভেবেছিলাম বিয়ে যখন করবই তাহলে শুধু শুধু দেরি করা কেন? বাচ্চার বাপও হয়েছি। বউ-বাচ্চা, ভাই-বোন, মা-বাবা মিলে বাড়িতে মানুষ বেশ কয়েকজন। বেতনের টাকাতে চলা খুব মুশকিল। সবাই কোনোমতে বেঁচে থাকছি তখন।
শবনম জিগ্যেস করে, না খায়্যা থাকার অভ্যাস হইছিল আপনের?
একেবারে না খেয়ে থাকতে হয়নি। তবে টানাটানি ছিল খুব। কারো শখ-আহ্লাদ কিছু পূরণ করা যেত না। তাই সকলেই অসন্তুষ্ট ছিল আমার উপর।
শবনম ঝাঁঝের সাথে বলে, তা ক্যান হইবো? আপনের ইনকাম যে কম সেইডা ভাবতো না ক্যান কেউ?
আমি একটু হাসি। বলি, অভিমান সকলেরই হয়। আমিও তো ছাত্রজীবনে আব্বা ঠিকমতো টাকা পাঠাতে না পারলে খুব অভিমান করতাম। জানতাম যে তার পক্ষে এটা অসম্ভব। তবু অভিমান করতাম। তাই আমার ওপরও অভিমান করবে সবাই এটাই স্বাভাবিক।
শবনম ঠোঁট ওল্টায়, এমন সব কথা কন আপনে! বুঝি না। তা ১৫ ট্যাকার কথা তুললেন ক্যান?
ঐদিন আমার ছেলের দুধ ফুরিয়ে গিয়েছিল। বিকালের মধ্যে দুধের টিন না কিনতে পারলে দুধ পাবে না বাচ্চাটা। তাই বুকের মধ্যে সারাদিন হু হু করছিল। কিন্তু দুধের দাম ২০০ টাকা। কীভাবে জোগাড় করব টাকা!
চিন-পরিচিত মানুষ আছিল না? ধার করবার পারতেন।
ধার চাইতে পারতাম না শবনম। কার কাছে চাইব। সবাই তো আমার অবস্থা জানে। কারো কাছে ধার চাইলে সে হয়তো ভাবতে পারে আমি তার ঋণের টাকা শোধ করব কোত্থেকে? সেই কথা তো বলেও ফেলতে পারে মুখের ওপর। সেই অপমান সহ্য করব কেমন করে?
শবনমের কণ্ঠে শ্লেষ, প্যাটে নাই ভাত, তার আবার অপমান! দোকান থাইক্যা বাকি নিবার পারতেন।
আমি হাসি। বলি, এখন ফোন করলে দোকানদার তার গুদামের সব দুধের কৌটা ভ্যানে করে পৌঁছে দেবে আমার বাড়িতে আধাঘণ্টার মধ্যে। কিন্তু তখন সে একটা কৌটাও বাকিতে না-ও দিতে পারত। কারণ তখন আমি কেউ না।
অফিস থেকে বেরিয়ে ভাবছি বাচ্চার জন্যে দুধ না নিয়ে কীভাবে যাব বাড়িতে! বাচ্চা দুধ পাচ্ছে না সেটা দেখার চেয়ে আমার মরে যাওয়া ভালো।
তখন কী করলেন?
আমি বললাম, একটা উপায় মাথায় এলো হঠাৎ। গেলাম হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে।
শবনম বলে, মানে ঐ যে রক্তের দোকানে?
থ হয়ে গেলাম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্লাড ব্যাংকের এর চাইতে সঠিক বাংলা দেশের বড় বড় বিলাতফেরত ভাষাতাত্ত্বিকদের পক্ষেও করা সম্ভব না। আগের কথার খেই ধরলাম, অপারেশন হবে যেসব রোগীর তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় ব্লাড ব্যাংকে। দাঁড়ালাম কাউন্টারের পাশে। কোন গ্রুপের রক্ত দরকার সেই কাগজ নিয়ে লোকজন কাউন্টারে আসছে। বেশিরভাগকেই বলা হচ্ছে রক্ত নেই। একজন এসে বলল তার এবি পজেটিভ রক্তের দরকার। উত্তর এল, রক্ত নেই। লোকটা হতাশ হয়ে সরে দাঁড়াল। কী করবে ভাবছে। আমি কাছে গিয়ে বললাম যে আমার গ্রুপ এবি পজেটিভ। রক্ত আমি দিতে পারি। কিন্তু আমাকে ২০০ টাকা দিতে হবে। পেলাম ২০০ টাকা। ওহ! তখন যে আমার কী আনন্দ! দুধের টিন কিনে সোজা রিক্সা নিয়ে বাড়িতে।
একটা অদ্ভুত শব্দ করে শবনম। বোঝা যায় ফুঁপিয়ে ওঠা রোধ করার চেষ্টা হচ্ছে এই শব্দটা। কিছুক্ষণ আমার হাতের ওপর বোলায় নিজের হাতের তালু। কথা বলার সময় কণ্ঠটা একটু ভাঙা শোনায় তবু। বলে, এই কথা তাইনেরে কইছেন?
কাকে?
আপনের বউরে।
মাথা নাড়ি, না শবনম। তাকে বলিনি। কাউকে বলিনি। এই যে এত বছর কেটে গেছে, কখনো কাউকে বলিনি। আজ তোমাকেই শুধু বললাম।
আমারেই বা কইলেন ক্যান?
প্রশ্নটা আমি নিজেকেও করি। সত্যিই তো। কেন শবনমকে বললাম? আমার সংবেদনশীল বন্ধুর সংখ্যা এখন তো কম নয়। তাদের কাছে বলেও তো বুক হালকা করতে পারতাম। আর বুক হালকা করার দরকারটাই বা কী? কত ঘটনা, কত অপমান, কত প্রত্যাখ্যান, কত গ্লানি, কত দুঃখ, কত অসহায়ত্ব জমা হয়ে আছে। এটাও সেভাবেই থাকত। এতদিন সেভাবেই ছিল। হঠাৎ-ই কেন আমি উৎসমুখটিকে খুলে যেতে দিলাম? ম্লানমুখে বলি, কেন যে তোমাকে বললাম তা আমি ঠিক জানি না শবনম।
শবনম বলে, আমি বুঝছি।
আগ্রহের সাথে জানতে চাই, কী বুঝলে?
সবই বেচা-বিক্রি। আপনে রক্ত বেচছেন, আমি গতর বেচি। আপনের গতর থাকলে, আপনে মাইয়া মানুষ হইলে হয়তো আপনেও গতর বেচতে লাইনে খাড়াইতেন।
আমি ধাক্কা খাই। এতটা বোধহয় আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। আমি নারী হলেও এই পেশাটি নিতে পারতাম না। কিন্তু শবনমের সমীকরণের সান্ত্বনাটুকু কেড়ে নিতে ইচ্ছা করে না। জিগ্যেস করি, তোমার বড়ভাই আসেনি এই মাসে?
কণ্ঠে বিরক্তি শবনমের, আসেনি আবার! আইছে। ট্যাকা নিছে। বাপ-মায়ের লাইগা ভাত-কাপুড় আর ওষুদের ট্যাকা দিছি। পান-দোক্তার ট্যাকাও দিছি। হ্যার ছাওয়াল-মাইয়ার লাইগা জামা-কাপুড় কিন্যা দিছি। যাওনের ভাড়া দিছি। রাস্তাত খাওনের ট্যাকাও দিছি।
শবনম পরিবারের কাছে বলে রেখেছে সে ঢাকাতে গার্মেন্টে কাজ করে। বেতন পায় সাত তারিখে। তাই প্রতিমাসের ঠিক আট তারিখে ওর ভাই এসে হাজির হয়। শবনম তো বলে যে তার ভাই ঠিকই জানে সে কী করে। কিন্তু আড়ালটা দু’জনের কেউ ভাঙে না।
বলি, তোমার কত কষ্টের টাকা। নিজের জন্য জমা না করে তুমি ওদেরকে দিয়ে দাও। তোমার অসুখ-বিসুখ হতে পারে। অনেক রকম বিপদ হতে পারে। তখন তোমার টাকার দরকার হবে। সেই সময় তো ভাই তোমার পাশে দাঁড়াবে না। আগেও যেমন দাঁড়ায়নি। তবু তুমি তোমার সব টাকা মাসে মাসে ওদের জন্য দিয়ে দাও শবনম। কেন দাও বলতে পারো?
শবনম মুখ বাঁকায়, ফকিরের লাহান সামনে খাড়া হয়। তাই দিই।
না। সত্যি কথাটা হচ্ছে, তুমি ওদের সবাইকে ভালোবাসো। কোনো প্রতিদান পাবে না জেনেও ভালোবাসো। আর ভালোবাসার মানুষদের হাতে কিছু তুলে দিতে পারার যে সুখ সেই সুখটা তুমি উপভোগ করো। আমিও করেছি এতগুলো বছর।
শবনম বসা থেকে উঠতে উঠতে বলে, কীসব আউলা-ঝাউলা মার্কা কথা কন! কিছুই বুঝি না। তয় এইডা বুঝি যে আপনে একখান পাগল। চলবে