জুয়েল মাজহারের কবিতা ‘ভিন্ন রণ-অভিজ্ঞতা হইতে আসি’

প্রকাশিত : মার্চ ১৯, ২০২০

হে মানুষের ভালোবাসার চোরসকল, যে তোমরা আমা হইতে উত্তম, সেই তোমাদিগের প্রতি অসমাপ্ত রূপে নিবেদন করি... ভয়ে... এই পঙ্‌ক্তিসকল। আমেন!

বাঙ্ময় পঙ্‌ক্তিসকলকে— যাহা অপরের— আমি ঈর্ষা করি! তৎহেতু, গোপনে, একাগ্রচিত্তে, তাহার না-দেখা বার্লিক্ষেতের ছায়ায়, তৃণ-আড়ালে বসিয়া, ক্রমাগত, আপন খড়্গ শানাই! অপরের হস্তচালিত আর গৃহলালিত হে, পঙ্‌ক্তিসকল!

তোমাদিগের রচয়িতা যে-শাহানশাহ, আর যে তোমাদিগের পালয়িতা সমূহ বিনাশ তাহার— এই আমা হস্তে! যে আমি অব্যর্থ আর কঠোর; আর তোমরা অপারগ হইবে আপনাদিগকে রক্ষায়। যতক্ষণ লাবণ্য তোমাদের ঘিরিয়া রহে। তাহা উবিয়া যাইবে! কর্পূরের ন্যায়।

কিন্তু আমি, মেঘ-বিদারক
আমি বজ্রের গুরু আর তাহার পালয়িতা;

পর্বতের ন্যায় বরফসমেত আর রূঢ়-শীতল!
চূড়ায় বজ্র আর লৌহ-শলাকাসহ মৌনী আমি সদানিম্নগামী প্রপাতের নির্ঘোষসহ বিরাজি করি।

আর আমার ধ্যান ও ধাবন সত্য— চৈত্রদিনে সূর্যের ন্যায়;
যাহা আয়নার ভিতর বর্ণকে পাঠায় তার গরিমাসহ।
যে সমুদয় রঙের আধার আর বিচ্ছুরক। আর যে উদয়াস্তের রূপকার;

দিবাভাগে সেই সূর্যই আমার অপরূপ ললাটশোভা!

আমি চক্ষু নিবদ্ধ করিয়াছি অসীম অ-তিতিক্ষায়— তোমাপানে;

আর, তোমার নধরকান্তি পালয়িতার বক্ষপিঞ্জরের পানে;
..ক্রূর বাজপক্ষীর ন্যায়!

মম ঈগলচঞ্চুপ্রতিমানাসিকা
দূর হইতে
তোমারূপ শিকারের প্রতি
ক্রমধাবনশীল।
আর তোমরা নিমেষেই ছিন্নভিন্ন;

প্রধূমিত তোমাদের দুর্গশিখর ও ত্রিপলাচ্ছাদিত গোপন সৈন্যনিবাস!

নিশ্চয় তোমরা অচিরেই অজস্র বাজের ভক্ষ্য!
যেমতি তোমাদিগের নগ্ননধরকান্তি পালয়িতা;

আর আমি ক্রূর আর অ-তিতিক্ষু বাজের পালয়িতা।

সকল পক্ষবিধুনন আমার। কেননা আমি সর্বত্রগামী। আর অবধান করো যে, আমার খরবেগ নদীতটের অতি সন্নিকটেই তোমাদিগের বসতি;

বৃক্ষ আর পত্রশোভিত, সৌন্দর্যলালিত গৃহের অলিন্দে তোমাদের দেখি। আর আমি ধাবন করি ধীরে... যেমতি শশকের প্রতি ধাবন করে বাজপক্ষী। আর আমি পাঠাই তাহাকে— ক্রূর বাজপক্ষীকে--তাহার বক্র নখরসহ, যাহার অক্ষিগোলকের ভিতরে ফলিত এক শীতল চাহনি; আর তাহা সদা-নিবদ্ধ তোমাদিগের প্রতি
আর তোমাদিগের নগ্ন-নধর পালয়িতার প্রতি!
আর জানিবে, এই আমাহস্তে
অত্যাসন্ন আর অবধারিত তোমাগের বিনাশ।

যে তোমাদের পালয়িতা— যে তোমাদের শাহান শাহ, তাহার বিনাশ এই আমাহস্তে— জানিবে!

আর তাহা সত্য!
আর স্বচ্ছ তাহা দিবালোকের ন্যায়;
আর তাহা অবধারিত!
জীমূতে বজ্র যেমতি!

এবে আইস, তোমাপানে এক্ষণে পাঠাই প্রাচীন ব্যাধজাতি কিরাতগণের অব্যর্থ অস্ত্রের ন্যায় লক্ষ্যনির্দিষ্ট শব্দসকল;
যাহা আমারচিত আর সুন্দর!

আর, আমি তাহাদিগকে পাঠাই তোমাদিগের আর তোমাদিগের পালয়িতার বক্ষপিঞ্জরের নিশানায়!
তোমাদিগের আর তোমাদিগের পালয়িতার পৃষ্ঠদেশের দিকে

চরম রূঢ়তায়,
আর,
পরম অনুরাগের সহিত!

তুমি আমার শত্রু; তথাপি আমি পরমাত্মীয় তোমার।...

অতএব, আমি
গরলেরে অমৃত করি, আর অমৃতেরে গরল।
ইত্যবসরে মৎরচিত শব্দসকলকে পাঠাই তোমাসকাশে, তোমার বক্ষের নিশানায়!
পরম যত্ন আর অনুরাগের সহিত!
...কিরাতগণের বাঁকনলের ন্যায়!

জানিও, রণদামামার ভিতর মুহূর্মুহূ যে জাগিয়া ওঠে
সে অন্য কেহ নহে, আমি।

জানিও, যখন রণলিপ্ত তখন স্বজনহন্তা আমি;
—কেননা ইহাই কর্তব্য আমার!কেননা ক্ষত্রিয় আমি!

প্রেমাস্পদ আমি হননের।
লোহার বাসরঘরে কালিদহে, সাঁতালি পর্বতে দ্বিভাঁজ জিহ্বা লইয়া গোপন ছিদ্রপথে যে আসে, সে আমি!

আর জানিও, রণবাদ্যের ভিতরেও যে ফুল্ল আর অনির্বচনীয়— সে আমি;

আর, অসিসঞ্চালন-মুহূর্তেও কপালে শিশুর চুম্বনের স্মৃতি আর বিষাদ লইয়া যে— সে আমি!

আর, আমার অভিন্ন আনন তোমাদের সকলের আনন লইয়া বহুরূপে ঘুরিতেছে— শোভাদারুণ বহু-বহু রূপে:

আর, ভীষ্ম— যে ছিল অভেদ্য— শরশয্যায় সে এখন নিথর— আর, পরমাত্মীয় সে আমার;

তথাপি ইহাই আমার কর্তব্য যে, তাহাকে বধ করি— পরম আদরের সহিত— আর সহস্তে!

কিন্তু কেন এমত হইল যে, সহসা চক্ষু জ্বালা করিয়া উঠিল, আর আমি অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইলাম?
এক নিমেষমাত্র! বৈকল্য হইল। কিন্তু পরক্ষণেই আমাতে ফিরিয়া আসি আমি;

আর ফিরি আমার রণ-কর্তব্যের প্রহরায়!

কেননা ক্ষত্রিয় আমি! কেননা পাষাণে রচিত আর শীতল আমি। আর, আমার সুদৃঢ় সুপ্রাচীন বক্ষপিঞ্জর চিরঅভেদ্য; আর, তাহাতে সুরক্ষিত যে-হৃদয় তাহা, কে না জানে, গ্রানিটে নির্মিত!
তথাপি, ক্ষণকালের তরে, কেন কাঁপিয়া-নড়িয়া উঠিল সে
কলিঙ্গের রণময়দানে রাজা অশোকের ন্যায়?

অতঃপর আমি তাহাকে— আমার সহসা-অবাধ্য হৃদয়কে থামাই— যে ভুবনাধিপতি সেকান্দরের পিতা, মাকিদোনিয়ার রাজা ফিলিপের তেজি অশ্ব বুকিফেলাসের মতো অবাধ্য।—আমার ক্ষণবিচলিত হৃদয়কে!

কেননা, ইহা আমায় সাজে না। কেননা ক্ষত্রিয় আমি!

অতএব প্রেম নহে, হাস্য, করুণা কিংবা অশ্রু নহে; আমার রহিয়াছে কেবল কর্তব্য আর ক্ষাত্রতেজ!

ইত্যবসরে দিবস আইসে আর দিবস চলিয়া যায় আর আইসে আর চলিয়া যায়;
আমার রণবাদ্য সদা বাজিয়া চলে! অজস্র মেঘবাহিনীর ন্যায়!

আর বিলক্ষণ জানিও,
একদা সকল মরালগ্রীবা, সকল প্রশস্ত আর উঁচু স্কন্ধের গরিমা আমার বাণে বিদ্ধ হইবে!
আর লুটাইয়া পড়িবে
হেক্তরের ন্যায়
ধূলিতে!

হেকুবার আর্তনাদের মতো অফুরান দিবস আর রাত্রি!

আর, তোমাদিগের হৃতযৌবন জনয়িতাকে, দ্যাখো,
পরাজয়ে নতদৃষ্টি আর ভূপাতিত;
ধূলিলাঞ্ছিত আর করুণ,
জরদ্গব তোমাদের পালয়িতাকে দ্যাখো:
—উল্টাইয়া পড়া কিস্তিসহ! ...তীরে!

ইহাই ঘটিবে,
আমি বলিতেছি,
ইহা অবধারিত,
আর ইহা সত্য!

আমি ছিন্নবস্ত্র,
তথাপি সরোবরে দীর্ঘগ্রীব মরালের ন্যায় ক্রম-উজল হে!

আমি শাহান শাহের শাহান শাহ!
সদানিবিষ্ট আর স্থিরদৃষ্টি
ক্রমধাবনশীল আপন লক্ষের প্রতি
আর তোমাদিগের জনয়িতা আমার সদালক্ষ্য, ...আমার নির্মম নখরবর্তী— সদা।

ষণ্ডের চোখের মণি যথা! যাহাকে নিশানা করিয়াছিল অর্জুন
সেই ষণ্ডের ডাগর চোখের মণির প্রতি যথা।

সদা রিরংসু আর হননেচ্ছু অমি!
তোমাদের জনয়িতা একমেবাদ্বিতীয়ম নিশানা আমার;
আর ভক্ষ্য আমার অসীম ক্ষুধার!

আর, আমি তাহার দুশমন;
আর, সখাও আমি তাহারই!

আর জানিবে উভয়ের ক্ষেত্র একই— তাহার আর আমার—

তথাপি,
উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন রণ-অভিজ্ঞতা হইতে আসি