ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

জ্ঞানের শহিদ ও বাংলার বুকে আল্লাহর রহমত

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : মে ১১, ২০২০

হাদিসশাস্ত্র বিষয়ে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বিস্তৃত কাজ যিনি করেছেন তার নাম ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর। তিনি সম্পাদনা ও ভাষ্য রচনা করেছেন বঙ্গভাষায় জাল হাদিস বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ আল্লামা আবু জাফর সিদ্দীক রচিত ‘আল মাওজুয়াত’ এর। তার গবেষণাগ্রন্থ ‘হাদিসের নামে জালিয়াতি’ বাংলা ভাষায় রচিত হাদিস বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বই। আমার ধারণা, আমাদের মতো সাধারণ পাঠক ছাড়াও বাংলাদেশের মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণ হওয়া তালেবে ইলম ও হাদিসশাস্ত্রে সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্তদের কাছেও বইটি অসামান্য বলেই মনে হবে। উদাহারণ দিয়ে দিয়ে হাদিস পর্যালোচনার পদ্ধতি, হাদিস বর্ণনায় সাহাবাদের সতর্কতা, হাদিস সংগ্রহে সর্বোচ্চ সচেতনতা, নবিজির কওলের হুবহু সংরক্ষণে সাহাবি আজমাইন, সালাফ ও খালাফদের সতর্কতা, হাদিসকে আমলের ভেতরে ধারণ করে প্রজম্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তিনি।

জাল হাদিস কেন জাল, তা নিয়েও জনবোধ্য ভাষায় অনন্য একাডেমিক আলোচনা রয়েছে তার। তার প্রতিটি বই রীতিনিষ্ঠ, একেবারে একাডেমিক ধাঁচে লেখা, পর্যাপ্ত রেফারেন্স সহকারে উদ্ধৃত। তিনি কোনও বিষয়ে কলম ধরলে সে বিষয়ে বিদ্যমান সম্ভাব্য সব ধরনের তথ্য ও মতকে একইসাথে বস্তুনিষ্ঠা ও দরদ দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করতেন। ফলাফল হিশেবে, ধারণা করি, প্রায় প্রতিটি টপিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি হক সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছেন। তবে রেওয়াত-দিরায়াত-জারাহ-তাদিলের পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ততার বিষয়টি তার বিশ্লেষণে তেমন না আসলেও এই বইটি এক বিরাট ইলমি খেদমত বাংলা ভাষায়। আরবিতে রচিত হাদিস বিষয়ক তার তত্ত্বীয় গ্রন্থটি বুহুছ ফী উলুমুল হাদিস নাকি আরো বেশি বিস্তৃত ও একাডেমিক বিশ্লেষণ ও আলোচনায় সমৃদ্ধ। তার সঙ্গীরা ও পরিচিত জনেরা জানেন কি অপূর্ব আখলাক ছিল তার। হিংসা ও ঈর্ষামুক্ত হৃদয় ছিল তার।

সবসময় অপরকে সামনে আনার চেষ্টা করতেন, নিজের চেয়ে অপরকে অগ্রাধিকার দিতেন। এত বড় পণ্ডিত ছিলেন তিনি, কিন্তু কখনো নিজেকে জাহির করতেন না। অপরের জন্যে কিছু একটা করবার আবেগে সবসময় আকুল থাকতেন। নিজ হাতে আপ্যায়ন করা, নিজের অসুবিধা সত্ত্বেও অপরের অসুবিধেকেই প্রাধান্য দেয়া, ছোটবড় সবাইকে সম্মান দেয়া ছিল তার বৈশিষ্ট্য। এক হোটেলে মাঝে মাঝে তিনি নাকি খেতেন। কেউ তাকে আগে সালাম দিতে পারতো না, সবার আগে সালাম দিতেন তিনি। তার ছাত্রের বয়সী যারা তাদেরকেও ‘শায়খ’ বলে সম্মান দিতেন। মাহফিলের তারিখ নির্ধারণে সবসময় আয়োজকদের সুবিধাকে প্রাধান্য দিতেন। একবার তার এক মাহফিলের তারিখ পড়েছিল তার তুরস্ক থেকে ফেরার দিন, তিনি তারিখ চেঞ্জ করতে বলেননি, আয়োজকদের কষ্ট হবে ভেবে। এরকম আরো অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী তার নিকটজনেরা, যারা তার সহবত পেয়েছেন তারাও।

ইসলামি আখলাকের এক অসাধারণ নজির ছিলেন তিনি। তার ওয়াজ, তার লেখাগুলো যদি নাও থাকতো শুধু তার আখলাকের কারণেও তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রিয় হতেন। অসাধারণ প্রতিভাধর ছাত্রও ছিলেন তিনি। রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন বাংলার গর্বও, সুবিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন তখন থেকেই। আরব বিশ্বের বহু বড় বড় আলেমের সহবত পেয়েছিলেন। অনেক তরুণ আলেম প্রভাবিতও হয়েছিলেন তার দ্বারা। বাংলার বুকে তিনি আল্লাহর রহমত। দিন দিন তিনি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছেন সাধারণ্যে, আরো হতে থাকবেন, ইনশাআল্লাহ। চারদিকের বিভক্তি আর ঈর্ষার মাঝে কথায় ও কাজে সত্যিকার উম্মাহদরদি এক প্রাণ ড.জাহাঙ্গীর। সৃষ্টিকে ভালবাসা ও সৃষ্টির খেদমতের কথা, বান্দার হকের আলাপ এই এক দেড় দশকে তার চেয়ে আর কে বেশী তুলেছে? তিনি বাস্তবে হানাফি মাজহাব অনুসরণ করলেও কোনও রকম মাজহাবি গোঁড়ামি তাকে সত্য অনুসন্ধানে ও প্রকাশে বিরত রাখেনি। তাই কট্টর আহলে হাদিসরাও তাকে অপছন্দ ও অগ্রাহ্য করতে পারতেন না।

আহলে হাদিসদের পুস্তকবিতানে ড. জাহানঙ্গীরের ‘হাদিসের নামে জালিয়াতি’ ছাড়াও তার ‘রাহে বেলায়াত’ ও ‘সহীহ মাসনুন ওজিফা’ বইগুলো শোভা পায়। হাদিস শাস্ত্রের বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ সংগ্রহ থেকে কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তার নমুনা আছে ঈদের নামাজের তাকবির সংখ্যা ও নামাজে হাত বাঁধার নিয়ম সংক্রান্ত তার হাদিসভিত্তিক আলোচনায়। কোনও নির্দিষ্ট স্কুল অব থটের পাবন্দি না করে ও নির্দিষ্ট মতের প্রতি পক্ষপাত না দেখিয়ে কীভাবে মতামত নির্মাণ করতে হয় তার এই গ্রন্থদ্বয় সেটির অসামান্য নজির। ইসলামে কোনও বিষয় নিয়ে চিন্তার পদ্ধতিগত দিক বুঝতেও তার এ ধরনের লেখাজোখা পাঠ থেকে ব্যাপক উপকৃত হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশে হাদিসের সনদ পরীক্ষায় সক্ষম বিরল সংখ্যক পরিশ্রমী স্কলারদের মধ্যে তার অবস্থান সর্বাগ্রে। আল্লামা রাহমাতুল্লাহ কিরনবি রচিত ‘ইজহারুল হক’ বইয়ের প্রতিটি হাদিসের সনদ তিনি পরীক্ষা করেছেন ও বইটির অনুবাদ করেছেন।

তিনি ট্রেডিশনাল আলিম, এ কালের উত্তরাধুনিক বা উত্তর-ঔপিনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডীয় ভাষা তিনি ব্যবহার করেননি। ইসলামের নিজস্ব পরিভাষা ও প্রস্তাবনাকে তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে উপস্থাপন করেছেন। যদিও, যতদূর জানি, এ কালের জ্ঞান ও দর্শনের সাথে তার সম্পূর্ণ অপরিচয় ছিল না। কিন্তু ইসলামের শক্তি তার বক্তব্যের সহজতায়, তার ফিতরাতি সত্যের দ্যুতিতে। সেই সহজতা ও পরমের প্রতি মানুষের প্রিমরডিয়াল আকুলতার শক্তি লক্ষ্য করি আল্লামা জাহাঙ্গীরের ভাষায় ও ভাবে। প্রতিরোধী রাজনীতিতে তিনি সরাসরি কাজে লাগেন না বলে তার প্রতি অনেকের অনাগ্রহ থাকতে পারে, কিন্তু যে বিপুল অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি বাঙালি মুসলিম সমাজকে মুত্তাকি, অপরের প্রতি দয়ার্দ্র, হক্কুল ইবাদের চেতনায় উদ্দীপিত ও শুদ্ধ জীবনাচারে উদ্ভাসিত বানাতে চেয়েছিলেন তার পলিটিকাল গুরুত্বও অসামান্য। তার ‘ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ’ বইটিকে ‘মডারেট’ ও ‘লিবারেল’ হওয়ার অভিযোগ করে অনেকে। সন্ত্রাসের সংজ্ঞায়নে পশ্চিমা বয়ানের প্রভাব আছে এ বইয়ে ।

যাহোক, এটি নিয়ে যারা সত্যিকার এলেমদার তারা দলিলভিত্তিক একাডেমিক আলোচনা করবেন। তবে তার অন্বেষণের প্রক্রিয়া, সংগৃহীত উপাদান, কোরান-হাদিসের যে রস তিনি ব্যবহার করেছেন তার উপকার থেকে যেন আমরা মাহরুম না থাকি। ইংরেজিভাষী সাদা চামড়ার আলিমদের প্রতি ইলমি ও একই সাথে ঔপনিবেশিক মানসিকতাজাত বিহ্বলতা আমাদের নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান সাধকদের প্রতি বেখেয়াল রাখে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের ইসলামি গবেষণা উম্মাহর সম্পদ। কিন্তু,তা সত্ত্বেও, নিজ ভাষায় ও ভূখণ্ডে জ্ঞানচর্চার উৎসাহ ও জমিন তৈরি করতে স্বভাষী ও স্বভূমিজ আলিম লেখকদের সাথে দরকার ক্রিটিকাল ইনটিমেসি। আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরকে ওয়াজে যেমনটা চিনবেন, তার তত্ত্বীয় বইগুলোয় তাকে আরো বেশি চেনা যাবে, উপকৃতও হওয়া যাবে আরো বেশি। তার বই পড়ার পাশাপাশি তার ইলমি খেদমত নিয়ে লেখালেখিও দরকার। আর দরকার তার উত্তরাধিকারী, যারা দিলের দরদ দিয়ে উম্মাহকে একতাবদ্ধ রাখবার আকুলতায় নিমগ্ন থাকবে, জ্ঞানসাধনায় ও মানুষের ইলমি খেদমতে জীবনপাত করবে।

উল্লেখ্য, যখন তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তখন তার সাথে ছিল তার বাইবেল পর্যালোচনা নামক বইয়ের সুবৃহৎ পাণ্ডুলিপি, যার প্রায় প্রতিটি পাতা ড. জাহাঙ্গীরের ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্তে সিঞ্চিত হয়েছিল। উপমহাদেশের আলিমদের মধ্যে বাইবেল সম্পর্কে যাদের রয়েছে সুগভীর অধিকার, তাদের মধ্যে আল্লামা জাহাঙ্গীর অন্যতম। আল্লামা ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর আমাদের জ্ঞানের শহিদ। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক