ওয়েব সিরিজ ‘রিফিউজি’র দৃশ্য

ওয়েব সিরিজ ‘রিফিউজি’র দৃশ্য

‘ঢাকার মধ্যে ছোট্ট একটুকরো পাকিস্তান’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৪, ২০২৪

দেশভাগের সময় ভারত থেকে বিহারিরা এসে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিহারিরা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। এরপর পূর্ব পাকিস্তান নতুন দেশ হওয়ায় তারা বেশ বিপাকে পড়ে যায়, পাকিস্তানপ্রীতি অন্তরে লালন করে আটকে পড়ে যায় এই দেশের মাটিতে। তারা পাকিস্তানি নাগরিক। তাই তারা তখন পাকিস্তান চলে যেতে চেয়েছিল। পাকিস্তান সরকার কিছুসংখ্যক বিহারিদের নিলেও, একটা বড় অংশকে নিতে অস্বীকার করে। তাদের বেশিভাগই এরপর থেকে ঢাকা শহরের মোহাম্মদপুর এলাকায় জেনেভা ক্যাম্পে বসবাস করছে। জেনেভা ক্যাম্পের বিহারিদের জীবনযাপনের গল্প নিয়ে ২০২২ সালে তৈরি করা হয় ওয়েব সিরিজ ‘রিফিউজি’। পরিচালনা করেন ইমতিয়াজ হোসাইন। এই সিরিজটি নিয়ে এবং বিহারিদের বিষয়ে ছাড়পত্রর পক্ষ থেকে ইমতিয়াজ হোসাইনের সঙ্গে গপসপ করেছেন ফাইরুজ সাইয়ারা

ফাইরুজ: রিফিউজি নিয়ে কাজ করার ভাবনা কিভাবে এলো?

ইমতিয়াজ: রিফিউজি রচনা ও নির্দেশনা আমার হলেও, কাজটায় আমার সাথে আরও দুজন ক্রিয়েটর ছিলেন, আবদুল্লাহ মহাম্মদ সা’দ এবং আদনান হাবিব। আাইডিয়াটা প্রথমে সা`দ ভাইয়ের মাথা থেকেই আসে। আমার আগ্রহ দেখানোর কারণ হলো, আমি বড় হয়েছি বিহারিদের সাথে। ক্যাম্পে যারা থাকে ওদের সাথে না হলেও বিহারিদের সাথে আমার ছোটবেলা থেকে ওঠা-বসা। স্কুলে ক্লাসমেটদের বেশিরভাগই ছিল বিহারি।

এরা এমন একটা কম্যুনিটি যারা বাংলাদেশে থাকছে, কিন্তু তারা মনে করছে না তারা এই দেশের নাগরিক। নিজেদেরকে তারা ভাবছে পাকিস্তানি। তাদের বর্তমান প্রজন্মও কি পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায় নাকি তারাও নিজেদের বাংলাদেশি ভাবা শুরু করেছে? সে কৌতূহল থেকেই সিরিজ বানানোর কথা ভাবি।

ফাইরুজ: গল্পের সেটিং হিসেবে ২০০৭ সালের সময়টাকেই কেন বেছে নিলেন?

ইমতিয়াজ: এই সময়টাতেই আসলে ওদের ভোটার করার ব্যাপারটা শুরু হয়। হাইকোর্টের রায় আসে। ঠিক এর আগের সময়টা দেখাতে চেয়েছি।

ফাইরুজ: জেনেভা ক্যাম্প নিয়ে গবেষণা কিভাবে করলেন?

ইমতিয়াজ: আমাদের গল্পের প্রধান চরিত্র ছিল অপরাধ জগতের বাসিন্দা। জেনেভা ক্যাম্প নিয়ে আমাদের সাধারণ মানুষের অনেক ভীতি কাজ করে। অনেকে ভেতরে ঢুকতেও সাহস পায় না। আমরা প্রথমে অনেক খোঁজ নিয়ে এরকম একজনের সাথে দেখা করি। তার অ্যাপয়েনমেন্ট নিই। উনি আমাদের প্রায় দুই ঘণ্টা সময় দেন জেনেভা ক্যাম্পের বাইরে। উনি নিজেও ভয়ে ছিলেন আমরা ইনফর্মার বা পুলিশের লোক কিনা, তা নিয়ে। উনি উনাদের লাইফস্টাইল ও চিন্তাভাবনা নিয়ে আমাদের বিভিন্ন আইডিয়া দেন। যেমন ধরুন, উনার বয়স ৪৮। এর মধ্যেই উনার নাতি-নাতনি হয়ে গেছে। এখানে খুব অল্প বয়সে ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়।

অপরাধ জগতে কিভাবে জড়িয়ে পড়লেন, জিগেশ করে উনার কাছ থেকে আমি বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য পাই। যেমন, উনি আমাকে বলছিলেন যে, উনি পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান না। বেশি টাকা উপার্জন করতে পারলে ক্যাম্পের বাইরে একটা থাকার ব্যবস্থা করতে চান। আমাকে উনি তার একটা ইন্টারেস্টিং অপরাধ জগতের ঘটনা বলেছিলেন। যে ডিলটা হয়ে গেলে তার অনেক টাকা ইনকাম হতো। এরপর উনি বিহারি ক্যাম্প থেকে বের হতে পারতেন। কিন্তু ইন্ডিয়ান বর্ডারের কাছে তার চালানটা ধরা পড়ে।

উনার কাছ থেকে জেনেছিলাম যে, উনার বাবা-চাচারা পাকিস্তানে যেতে চান। তারা বিশ্বাস করেন, তারা ফিরে যাবেন। উনাদের একটা প্রচলিত কথা আছে, ‘পাকিস্তান কারতে কারতে কাবারস্থান চালা গায়া’। এই কথাটি আমি আমার সিরিজে ব্যবহার করেছি।

বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ জেনেভা ক্যাম্পের রাস্তা এড়িয়ে চলে। এমনকি সেদিক দিয়ে যদি শর্টকাটও হয়, এরপরও। তাদের কাছে যেন বিহারি ক্যাম্পের অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই। যদিও ক্যাম্প আসলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রেসিডেনশিয়াল এলাকার মাঝে পড়ে। অনেকে ভয় পায় ওই এলাকায় পা রাখতে।

পরে যখন আমি লোকেশন রেকি করছিলাম তখন আমাদের পুলিশ প্রোটেকশান ছিল। কিন্তু পুলিশরাও বলছিল, ক্যাম্পের ভেতরের সাপোর্ট লাগবে আমাদের। পরে ওখানকার এক স্কুল টিচার আমাদের অনেক সাহায্য করেন। আমাদের রিহার্সেলে সাহায্য করেন। তাদেরর ভাষা শিখিয়ে দেন। আমরা তখন নিয়মিত বিহারি ক্যাম্পে যাতায়াত করতাম। মানুষের সাথে মিশতাম। কথা বলতাম। মূল শ্যুটের বাইরেও আমি কিছু ইন্টারভিউ শ্যুট করি। তখন আসলে আমরা বিহারি ক্যাম্পের লাইফস্টাইল অনেকখানি সম্পর্কে জানতে পারি। তারা সবাই অনেক সহযোগিতামূলক আচরণ করে শুটিংয়ের সময়।

ফাইরুজ: আপনার গল্পে আমরা সেকেন্ড-জেনারেশন বিহারি ডায়াসপোরাদের মুখ্য চরিত্রে দেখতে পেয়েছি। তাদের সংকট ও সম্ভাবনা অন্য ডায়াসপোরা থেকে কতটুকু আলাদা?

ইমতিয়াজ: একটা কারণে ওদেরকে আমার ডিফারেন্ট লেগেছে। সেটা হচ্ছে, ওরা একটা দেশের একেবারে রাজধানীতে থেকে অন্য দেশের পতাকা তুলে রাখে। যখন বাংলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা চলে তখন ওরা অনেকেই পাকিস্তানকে সমর্থন করে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মধ্যে ওই এরিয়াটুকু হলো আসলে ছোট্ট একটুকরো পাকিস্তান। এইটা সম্ভবত অন্য ডায়াসপোরা কম্যুনিটি থেকে আলাদা।

২০০৮ সালের দিকে তারা ভোটার হয় বাংলাদেশের। ওদের ইন্টারভিউ করার সময় ওরা বলেছিল, ভোটার হলেও এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। ক্যাম্পের অ্যাড্রেসে এখনো পাসপোর্ট হয় না। ওদের ভোটার করার আগে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক কথা হয় এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। কারণটা হচ্ছে, তাদের সাথে আমাদের ইতিহাস জড়িত। আমি আমার বাবার কাছ থেকে এক ধরনের গল্প শুনেছি। এই এলাকার মানুষের কাছ থেকে আরেক ধরনের। যুদ্ধের সময় আমাদের অবস্থান ও তাদের অবস্থান কেমন ছিল, সেসব নিয়ে। সব শুনে আমি আমার গল্পে কিন্তু কোনো স্টেটমেন্ট দেয়ার চেষ্টা করিনি। আমি কেবল সেই পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

ফাইরুজ: বর্তমানে দাঁড়িয়ে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি বিহারিদের আপনি কোন পরিচয়ে স্বচ্ছন্দ হতে দেখেন?

ইমতিয়াজ: এ নিয়ে আসলে তাদের মাঝেও ভিন্নমত আছে। আমাদের সিরিজেও আমরা দেখিয়েছি দুজন বন্ধুকে। যাদের একজন পাকিস্তান যাওয়ার কথা চিন্তা করে। আরেকজন বাংলাদেশে থাকতে চায়। বিহারি ক্যাম্পেও তাই। কেউ পাকিস্তানে যেতে চায়। কেউ বাংলাদেশে থেকে যেতে চায়।

ফাইরুজ: বিহারিদের নিয়ে মূলধারার বাংলাদেশিরা যে ধারণা পোষণ করে, তার কতটুকু বাস্তবসম্মত?

ইমতিয়াজ: বিহারি ক্যাম্প নাম শুনলেই আমাদের মনে হয়, এখানে শুধু নানা অপরাধ হয়। তাদের কসাই বা ডোম শ্রেণির কথা আমাদের মাথায় আসে। হয়তো ওদের এলাকায় আমরা শুধু বোবার বিরিয়ানি খেতে যাই। আমরা তাদের নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমরা ইতস্তত করে ওদের বিষয়টা এড়িয়ে চলি। কারণ, তাদের বিষয়টা বেশ কন্ট্রোভারসাল বা অন্যকিছু, আমি ঠিক জানি না।

শহরের মাঝের একটা জায়গার চারপাশ দিয়ে চলাফেরা করলেও ভেতরে কী হয়, তা আমরা জানি না। আমরা বাংলাদেশিরা আদৌ তাদের সম্পর্কে জানতে পারছি কিনা, সে নিয়েও আমার সন্দেহ আছে।