তাজা মাছ ও সবজি

তৌফিকুল ইসলাম পিয়াস

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৫, ২০২০

আমি প্রচুর ভ্রমণ করতাম। বিশেষ করে বাংলাদেশটার এমাথা থেকে ওমাথা পুরোটাই অনেক অনেক বার ঘুরে ফিরেছি। মাঝে মধ্যে আমি এমন এমন সব জায়গায় যেতাম, যেখানে কেউ কোনোদিনও বিনা কাজে ভ্রমণে যাবে না। যেমন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা। কেউ যাবে ওখানে, শ্রেফ ভ্রমণ করতে? অথবা সাতক্ষীরার শ্যামনগর; বা আরও ভেতরে মুন্সিগঞ্জ, যেখান থেকে ছোট নদী পার হলেই সুন্দরবনের ঘন জঙ্গল। মাঝে মধ্যে নাকি ‘তিনি’ নদী পার হয়ে এপাড়েও চলে আসেন!

তো, এরকমই একবার গেলাম সেই জামালপুরের বকসীগঞ্জ উপজেলার কর্ণঝড়া। ইন্ডিয়ান বর্ডারের সঙ্গে। ছোট পাহাড়ি জঙ্গল। নয়নাভিরাম। সরকারি উদ্যোগে একটা রেস্ট হাউজ বোধ হয় আছে। ঘুরলাম। দেখলাম। ছবি তুললাম। প্রচণ্ড আনন্দ পেলাম। ওখান থেকে ফেরার পথে একেবারেই অজপাড়া গাঁ দেখলাম একটা। খুবই ছোট, শান্ত, টং রেস্টুরেন্ট। কাস্টমার নেই। আমি ঢুকলাম। জানতে চাইলাম কি কি আছে খাবার। জীর্ণ শরীরের রেস্টুরেন্ট মালিক বলল, স্যার, আপনি তো এসব খাবেন না, গরিবের খাবার।

আমি হেসে দিয়ে বললাম, আমি তো গরিবই, অবশ্যই খাব।
ছোট ছোট ট্যাংরা মাছ ডাটা-বেগুন-মুলা দিয়ে রান্না করেছিল। আমাকে খুব যত্ন করে, একটু বেশি পরিচ্ছন্নতায় সে খাবার পরিবেশন করলো। পাতলা ডালও ছিল। মাছগুলি একেবারেই তাজা। সবজিগুলিও মনে হচ্ছিল মাত্রই বাগান থেকে তুলে এনে রান্না করা। অপূর্ব তৃপ্তি নিয়ে সেদিনের সেই খাওয়া। এখনও মনে পড়লে ক্ষুধা লেগে ওঠে!

একদিন খেয়েছিলাম ময়মনসিংহ যাবার পথে ত্রিশাল পার হয়ে কী একটা ছোট বাজারের পাশে। গাড়ি থামিয়ে টং রেস্টুরেন্টটিতে ঢুকলাম। কি একটা শুটকি ভর্তা যেন ছিল। ওয়াও, অসাধারণ সেই দিনের খাবার, টাটকা কাচকি মাছ ছিল। পেট পুরে খেয়েছিলাম। শীতের দিনের সবজি, সত্যি ভোলা যায় না।

চাঁদপাড়ায় একটা কাজ ছিল। চাঁদপাড়া হলো, বেনাপোল বর্ডার পার হয়ে বনগাঁ থেকে শিয়ালদাহ’র উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের ঠিক পরের স্টেশন। আমি করলাম কি রিকশা নিলাম হরিদাশপুর থেকে চাঁদপাড়া। চাঁদপাড়া পৌঁছে যাবার মুহূর্তেই গ্রামের শেষ মাথায় একটা ভাঙাচোরা রেস্টুরেন্ট। অনেকেই খাচ্ছে। আমারও লোভ হলো। রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। প্রত্যেকটা মাছই ছিল এক্কেবারেই তাজা, সঙ্গে সবজিও। খেয়ে নিলাম। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাঙালি বাবুদের রান্না করা খাবার সম্ভবত পৃথিবীর সেরা বাঙালি খাবার। এরা তরকারিতে ঝোল একটু বেশি খায়। ঝোলটাও মজা।

আরেকবার ব্যাংককে। চায়না টাউনের একটা হোটেলে উঠছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক খুঁজে পেলাম একটা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট। রাত তখন সাড়ে নয়টা। রেস্টুরেন্ট মালিক কিছুতেই দোকান খুলবে না। আমিও নাছোরবান্দা। জোর করে গেট খুলালাম। বলল, খাবার নেই। আমি বললাম, কিছুই নেই তলানিতে? দেখেন না রে ভাই। খুব ক্ষুধা লেগেছে তো; বেইজিং থেকে এসেছি। ছয়দিন ধরে ভাত খাই না। বেচারার মনে হয় মায়া হলো। বললেন, শুধু সামান্য একটু গুলশা মাছের ঝোল আছে একপিস মাছ আমার জন্য। রাতে খাব, তাই। আপনাকে দিলে আমি কি খাব?

আমি বললাম, চলেন দুইটা ডিম ভাজি করি। দুজন মিলেমিশে খেয়েনি। ভদ্রলোক অবশেষে রাজি হলেন। ডিম ভাজলেন। উনি জোর করে মাছটা আমাকেই দিলেন, অর্ধেকটাও নিলেন না। চায়না টাউনে নাকি তাজা গুলশা মাছও পাওয়া যায়। শুধু মুলা দিয়ে যে গুলশা মাছ এতটা মজা করে রান্না করা যায়, আমি সেটা সত্যিই জানতাম না। এখনও মুখে সেদিনের সেই স্বাদটা লেগে রয়েছে। এতক্ষণে বুঝেই ফেলেছেন যে, তাজা মাছ আর সবজির কতটা পাগল আমি।

ঢাকায় যখন থাকতাম, মাঝে মধ্যে চলে যেতাম মিরপুরের দিয়েবাড়ী দিয়ে পেছনের উত্তরাগামী রাস্তায়। বিকেলে ওখানে তাজা মাছ বিক্রি হতো। চায়নিজরা তাজা মাছ খায়। কোনো এক সকালে কুনমিংএ মর্নিং ওয়াকে বের হয়েছি। ওরা খুব মজা করে ব্যায়াম করে। একদল মানুষ হাই ভলিউমে স্পীকার বাজিয়ে তালে তালে ঘণ্টাখানেক ধরে ব্যায়াম করে। আমিও শরিক হলাম একদিন ওদের সঙ্গে। বেশ উপভোগ্য। ব্যায়াম শেষে হাঁটতে হাঁটাতে সামনে দেখলাম কাঁচা বাজার। ভেতরে ঢুকলাম। একদম বাংলাদেশের কাঁচা বাজারের মতোই। ভেতরে যেখানে মাছ বিক্রি হয় সেখানে কোনো মৃত মাছ নেই, সবই পানিতে ঝিইয়ে রাখা তাজা মাছ। আয়ের, মাগুর, বোয়াল, তেলাপিয়া, চিংড়ি— সবই দেখলাম। সঙ্গে কাঁকড়া ও ফটকাসহ নাম না-জানা আরও কিছু মাছ।

আরেকবার কুনমিংয়ে যাত্রা বিরতি। দুপুরে ঢাকার ফিরতি ফ্লাইট। তখন কুনমিংয়ে নতুন এয়ারপোর্টটি চালু হয়ে গেছে। গ্রামের ভেতরে আমার হোটেলটি। সকালে হাঁটতে বের হলাম। অনেকটা দূরে একটা বাজার দেখতে পেলাম। ভেতরে ঢুকলাম। কুনমিং চির শীতের শহর। তাজা তাজা ফুল কপি, শিম, ধইনা পাতা। আরও কত কি। এবং সেই তাজা মাছ। হঠাৎ মাথায় একটা পোকা ঢুকে বসলো। দুই ব্যাগ ভর্তি করে কাঁচা সবজি কিনে ফেললাম। মাছ কিনলাম না, গন্ধ হয়ে যাবে— তাছাড়া বহন করাটাও কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।

আমার লাগেজটা বড়ই ছিল। সেটার ভেতরে অনেক কষ্টে তাজা সবজিগুলি ঢুকালাম। আর ছোট একটা হ্যান্ডব্যাগের মতো করে তাতেও কিছু। চাইনিজ কাস্টমসের মেয়েরা স্ক্যানিং করতে গিয়ে দেখি মুচকি হাসছে। আমি ওদের সঙ্গে তাল হেসে দিলাম। বললাম, তোমরা তো দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবে না। তাই কিনে নিয়ে গেলাম। আর কি করবো, বলো?

ঢাকা এয়ারপোর্ট। ওরা কোনোদিনও আমার লাগেজ চেক করে না। ওদিন ভারি দেখে একজন অফিসার প্রশ্ন করলো, ভেতরে কি? আমি জবাব দিলাম, কাঁচা বাজার। ফুলকপি, বাঁধা কপি, শিম, টমেটো। স্ক্যানিংয়ে দেব?

বেচারা কী বুঝলো, কে জানে? দেখি, কোনো উত্তর না দিয়ে হা করে তাকিয়ে রয়েছে! আমি আমার ট্রলি নিয়ে বের হয়ে আসলাম। আমাকে কেউ আটকায় না। আমি তাজা মাছ এবং সবজির জন্য পাগল। দুই বেলা যদি তাজা মাছ আর টাটকা সবজি পাই, তাহলে আমার আর কোনো চাওয়া নেই। সেই আমি এখন নিউ ইয়র্কে। বাংলাদেশ থেকে শীপে করে ফ্রজেন কনটেইনার ভরে ভরে মাছ আসতে মাস দুয়েক লাগে। তারপর সেই বরফ থেকে মাছ বের করে রান্না করতে হয়। সেগুলি আর ততদিনে মাছ থাকে না।

ভাগ্যিস, করাচি থেকে কিছু দেশি মাছ ১৬ ঘণ্টার ডাইরেক্ট ফ্লাইটে জেএফকে চলে আসে। সেখান থেকে সরাসরি জ্যাকসন হাইটস-এ। প্রতি শুক্রবার। কেটে পেট ফেলে দেয়া আয়ের, বোয়াল, লক্ষা ইত্যাদি। গত পরশু বড় সাইজের মাগুর মাছও ছিল, কিনলাম তিনটা। বেশ ভালোই লাগলো খেতে। চাইনিজ কিছু লাইভ ফিস দোকান রয়েছে। হিলসাইডে সম্প্রতি একটা বাংলাদেশি লাইভ ফিসের দোকানও চালু হয়েছে। সেখান থেকে মাঝে মধ্যে তাজা ‘তেলাপিয়া’ আর ‘ক্যাট ফিস’ (মাগুর বা রিটা অথবা আয়ের গোত্রের) অথবা তাজা চিংড়ী মাছ নিয়ে আসি। ক্যাটফিসটা বেশ সুস্বাধু। আর বাদবাকি যে তাজা মাছগুলি দেখি, তাতে চেহারা দেখে মনে হয় না যে খেতে ভালো হবে।

একদিন আমেরিকান জনপ্রিয় মাছ ‘সলমন’ নিয়েছিলাম। পুরাই ফালতু একটা মাছ! ভালো যেন লাগে সেজন্য ‘ফার্ম রাইজ’টা না নিয়ে বেশি দাম দিয়ে ‘ওয়াইল্ড’ মাছটা নিয়েছিলাম। তাতে কি? কোনো মজাই নেই। এদেশের চিংড়ি মাছও খেতে কোনো মজা নেই। নিউ ইয়র্কে আট মাস শীত। সারাবছরই শীতের সবজি পাওয়া যায়। ফরমালিন ছাড়া। কিন্তু কোনো স্বাদ নেই। ধইনা পাতায় নেই কোনো গন্ধ। বোঝাই যায় যে, মাটি এবং পরিবেশের বাইরে গেলে আসল স্বাদটি আর মেলে না। নিউ ইয়র্কে যে লেবুটা পাওয়া যায়, তাতে প্রচুর টক জল থাকে। কিন্তু সেটাকে আমার লেবু মনে হয় না কোনোদিনও। আমার দেশের কাগজি লেবু! ওহ! সে কী স্বাদ!

অনেকেই আমাকে আমেরিকায় ফ্লাই করার আগে প্রশ্ন করে, আপনার জন্য বিশেষ কিছু আনতে হবে? লাগলে বলেন, কি আনবো? আমি বলতে চাই, চারটা ডিম পাড়া তেলঅলা দেশি মুরগি, তাজা ‘বাইল্যার ঘুগরী’ (ছোট মাছ), আর দু’হালি তাজা দেখে কাগজি লেবু। সঙ্গে পঞ্চাশ টাকার ধইন্যা পাতা। আর পারলে কিছু তাজা ট্যাংরা মাছ।

পারবে কেউ আনতে?