তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ২৪

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৬, ২০২১

বিদ্রোহীরা যে যুদ্ধের জিগির তোলে তা হলো দীনের লড়াই। গৌতম ভদ্র স্পষ্টই সে কথা জানান। তিনি জানান, লক্ষণ বিচারে ইমানের ধারণা ও যুক্তির ধারণা পরস্পরের বিপরীত বিন্দুতে অবস্থিত। যুক্তিবাদী বুর্জোয়া রাষ্ট্র্রের সাধ আছে ধর্মনিরপেক্ষতার। কিন্তু তার বিপরীতে রয়েছে নিম্নবর্গের ‘ধার্মিক’ প্রতিবাদের ঐতিহ্য যার সঙ্গে যুক্ত ধর্মবোধের বর্ম। কিন্তু উচ্চকোটির বিরুদ্ধে নির্ধারিত তার মূল ঘৃণা শাসক কিংবা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ ঠিক তাই। কিছু মানুষ ধর্মকে আশ্রয় করে, ধর্মই সেখানে প্রধান আশ্রয়; মঠ মন্দির সেখানে প্রধান বিষয়; শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে নামে একদল সন্ন্যাসী জীবন বাজী রেখে। আধ্যাত্মিক মুক্তি বা ইমানের ধারণাই এই লড়বার শক্তি জোগায়। তিতুমীর নারকেল বেড়ে যে জঙ্গ আরম্ভ করে, সেখানে চির-অন্ত্যজ জোলারা হিদায়েত আর মুমিন বলে চরম আত্মবিশ্বাসে জমিদার, দারোগা, কুঠিয়াল, জেলা প্রশাসক সবার শক্তিকে তুচ্ছ করে। কিন্তু সকলেই জানে এই জোলারা হলো সমাজে তুচ্ছ, সমাজের অন্তেবাসী। তিতুমীর জোলাদের নিয়ে এমন এক নতুন সম্প্রদায় গড়েছেন; দাড়ি রাখা, তহবন্ত পরা, নিজের মসজিদে নামাজ পড়া আর সাম্প্রদায়িক ভোজে অংশ গ্রহণ করা তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব।

তিতুর বাণীর মধ্য দিয়ে যারা বিশ্বাস করে তাদের ধর্ম অত্যন্ত মূল্যবান; আর এই ধর্ম রক্ষা করতে হলে বিদেশী শাসন হটানো খুব জরুরি। বিদেশীদের শাসন হটানো মানেই তার কাছে আর এক অর্থে ধর্মরক্ষা। তালিবানদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একই রকম। ধর্মই তাকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রাণ দেবার ইমান তৈরি করে দেয়। ইমান দিয়েই সে তার বিজয়ের নিশান ওড়ায়। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা তখন তার কাছে গুরুত্ব পায় না। ইতিহাসের এই অধ্যায়কে মনে রেখেই বিচার করতে হবে তালিবানদের। ধর্মের দিক থেকে কট্টর হোক আর যাই হোক, তালিবানরা নিজ দেশের ভূখণ্ড শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করার জন্যই লড়াইয়ে নেমেছিল। কিছুই তাদের রুখতে পারেনি। কথা হলো, আফগানিস্তানে অন্য ধর্মের লোক ছিল না। যদি অন্য ধর্মের লোক থাকতো, তাহলে কী দাঁড়াতো? আসলে ধর্মের বাধাটা বড় হতো না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তখন সব ধর্মের মানুষরা এক হতো। ঠিক যেমন মুসলমান বাহাদুর শাহর নেতৃত্বে হিন্দু মুসলমানরা এক হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। ঠিক যেমন হিন্দু নানা সাহেবের পতাকার নীচেও এক হয়েছিল হিন্দু মুসলমানরা। কারণ লড়াইটা ছিল বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে। নিজেদের দীন রক্ষার নামে, নিজেদের সম্মান রক্ষার লড়াই ছিল তা।

তিতুমীরের বাহিনী সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছেন স্মিথ, ‘যারা আমাদের আক্রমণ করে তারা সবাই শক্ত সমর্থ ব্যক্তি। বোধহয় তাদের ধারণা হয়েছে তারা মন্ত্রপুত। তারা আমাদের বন্দুকের সামনে অত্যন্ত দৃঢ়তা আর সাহসের সঙ্গে দাঁড়ালো। আমাদের গুলি তাদের একটু বিরত করতে পারলো না।’ যাদের এসব ইতিহাস জানা নেই, তারা তালেবানদের লড়াইকে ব্যাখ্যাই করতে পারবে না। স্মিথ বুঝেছিলেন, এদের দমন করতে হলে সামরিক বাহিনী দরকার। পুলিশ ম্যাজিস্ট্র্রেট আর আর কেউ এদের দমন করতে পারবে না। মার্কিন শক্তি বুঝেছিল, তালিবানদের দমন করতে কতোটা শক্তি দরকার। বায়ান্নটা দেশকে সে নিজের পক্ষে নিয়ে যায়। মহাযুদ্ধে যা ব্যবহার করা হতে পারতো, তাই ব্যবহার করা হয়েছে আফগানিস্তানের তালিবানদের বিরুদ্ধে। বলতে গেলে আফগানিস্তানরা একা লড়ছে বায়ান্নটা শক্তির বিরুদ্ধে। বহুজন বলবেন, বায়ান্নটা শক্তি একটা কথার কথা। না, তা নয়। বিরাট বিরাট শক্তি সহ বায়ান্নটা শক্তির মানসিক সমর্থন ছিল যুক্তাষ্ট্রের পক্ষে। সেটা কম কথা নয়। ভিন্ন দিকে আফগানিস্তানের পক্ষে ছিল সত্যিকার অর্থে তালিবানরা একা। মানসিক দিক দিয়ে তো একাই। সেকারণেই তার লড়বার দৃঢ়তা সব সময়ে চাঙ্গা ছিল। জয়ী হবার পরেও সে একা এখন পর্যন্ত।

কারণ কেউ তাকে স্বীকৃতি দেয়নি এখনো। এই অবস্থায় সে যে দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছে সেটা বিরাট মানসিক শক্তির পরিচয়। মানসিক দৃঢ়তাই শুধু নয়, যুদ্ধ শেষে একটা রাজধানী একটা দেশে সেরকম কোনো অঘটনই ঘটেনি। পৃথিবীর সকল যুদ্ধে বা যুদ্ধ শেষে নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ কতো কিছুই ঘটে। কিন্তু তালিবানদের হাতে তা ঘটেনি। যারা পালাতে চাইছিল বিমানবন্দরে, চাইলেই সেই সব শত্রু পক্ষকে তালেবানরা নিশ্চিহ্ন করতে পারতো। কিন্তু সেরকম করার পরিকল্পনাই তাদের ছিল না। কিন্তু তবুও তারা সন্ত্রাসী। তালিবানদের বিরুদ্ধে কখনো ধর্ষণের অভিযোগ নেই। বরং সেরকম চেষ্টা করেছে যারা, তাদের প্রাণদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের বিজয়টা পর্যন্ত মেনে নিতে রাজি নয় ভদ্রলোকরা। বলছে এটা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাতানো খেলা, সমঝোতা বা চুক্তির মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে গেছে। সমঝোতা বা চুক্তি কখন করে সাম্রাজ্যবাদ? ভারতে সমঝোতা করেই চলে গিয়েছিল ব্রিটিশ শক্তি কিন্তু কখন? যখন দেখেছে সে আর টিকতে পারবে না। দেখতে পাচ্ছিলো জনগণের মধ্যে প্রবল প্রতিবাদ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে ভারতীয়দের নৌবিদ্রোহে ইংরেজরা বুঝতে পারে, যে ভারতীয় সৈন্যদের উপর নির্ভর করতো, তারাই এখন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে।

ব্রিটিশরা তখন কম রক্তপাত ঘটিয়ে পালাবার পথ খোঁজে, ফলে চুক্তির ভিতর দিয়ে সরে দাঁড়ায় নিজেদের দুর্বলতার জন্যই। মার্কিনরা নিজেদের দুর্বলতা আবিষ্কার করে দুভাবে। প্রথমত তালিবানদের মরণপণ জেহাদের সামনে টিকতে পারছিল না, দ্বিতীয় দেখছিল এই যুদ্ধ বা দখলদারী চালাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে। সেই দুই যুগে চীন যুদ্ধ না করে বিরাট অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত। মার্কিন বাহিনীর টনক নড়লো এই ঘটনায়। ক্ষমতায় এলো তালিবানরা। ক্ষমতা এখন তালিবানদের হাতে মানে, এটাই ইতিহাসের শেষ কথা নয়। তার মানে এ নয় যে তারাই টিকে থাকবে, ইতিহাস জানে এর পরে কী ঘটবে। কিন্তু আফগানিস্তানের ইতিহাসে এ কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখতে হবে, তালিবানরাই আফগানিস্তানকে শত্রু মুক্ত করেছিল। নিজেদের জানপ্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করেছে বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে। নিজেরা নানারকম কষ্টের ভিতরেও কখনো আত্মসমর্পণ করার কথা ভাবেনি। সারা পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্র, বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশ যখন তার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তখন সেই একা দৃঢ়তার সঙ্গে লড়ে গেছে এবং দীর্ঘ সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র নিয়ে ইতিহাসে এরপর বহুকাল ঘৃণা প্রকাশ করা হবে। যখন তালিবান শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পিএইচডি বা এইসব শিক্ষার দরকার নেই, তখন ভুল কী বলেছেন?

ইংরেজদের প্রবর্তিত ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন গান্ধী, তিনি বলতেন এসব হচ্ছে বুদ্ধির লাম্পট্য। মিথ্যা বলেছিলেন কী? ইংরেজ শিক্ষায় শিক্ষিতরা বর্তমানে কী দিচ্ছে জনগণকে? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবদান কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয় শতাংশ ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তার পঁচাশি শতাংশ ছিলেন নিরক্ষর বা সামান্য শিক্ষিত কামার, কুমার জেলে; নিম্নকোটির মানুষ। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সুরে কথা বলেছেন তালিবান শিক্ষামন্ত্রী। পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষায় শিক্ষিতরা ভদ্রলোকরা নিজেদের শুধু বিকিয়ে দেয়। বাংলাদেশে কি ঠিক তাই ঘটছে না? ফরাসী বিপ্লবের পর জ্যঁ-জাক রুশো কৃষকদের মুখপাত্র হয়ে লিখেছিলেন, ‘দরিদ্রদের শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। তার সামাজিক অবস্থানের জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন তা এমনিতেই তার ওপর বলপূর্বক চাপানো রয়েছে।..প্রকৃতির কাছে শিক্ষালাভ করলে মানুষ যে কোনো কর্মে দক্ষ হতে পারে। চলবে