তিষ্যরক্ষিতা: প্রেম ও প্রতিহিংসার উপাখ্যান

দেবদুলাল মুন্না

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১

প্রায় দু’হাজার বছর আগের ঘটনা। সম্রাট অশোকের পাঁচজন বউ ছিলেন। প্রথমার নাম দেবী, দ্বিতীয়া ছিলেন কারুবাকি, তৃতীয়া পত্নীর নাম ছিল পদ্মাবতী, চতুর্থজন ছিলেন অসন্ধিমিত্রা এবং পঞ্চম পত্নীর নাম ছিল তিষ্যরক্ষিতা।

বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবংশ ও দিব্যাবদান অবশ্য অশোকের এই অন্তিম ‘অগ্রমহিষী’কে ‘তিষ্যরক্ষা’ বলে অভিহিত করেছে। পালি সাহিত্য এই তিষ্যরক্ষার কিংবদন্তিতে ভরা। কারণ তিষ্যরক্ষা/তিষ্যরক্ষিতা নাকি অতিশয় কামুক ছিলেন। সম্ভবত ইংরাজিতে ওনার বিশিষ্টতা বোঝাতে ‘নিম্ফোম্যানিয়াক’ শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ধৈর্য্য এবং সংযমের রূপককে সদাসর্বদা নিজ ঔচিত্য নির্বাহের জন্য ক্লেশ ও কষার দৃষ্টান্ত দিয়ে ঢেকে রাখা হয়, এখানেও তা-ই হয়েছিল।

তিষ্যরক্ষিতার সঙ্গে বয়সে সম্রাট অশোকের অনেক ব্যবধান ছিল। বাস্তবে নাকি তিষ্যরক্ষিতা, সম্রাটের চতুর্থ পত্নী অসন্ধিমিত্রার পরিচারিকা ছিলেন। ওনার রূপ–যৌবন দেখে অশোক ওনাকে নিজের রানিবাসে স্থান দেন। অশোকের সন্তান হিসাবে আমাদের কাছে প্রথমেই আসে মহেন্দ্র এবং সঙ্ঘমিত্রার নাম, যারা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘ধম্ম’ প্রচার করার জন্য সিংহলে যান। সম্রাটের আরও দুই পুত্র ছিলেন, তীবর এবং জলৌক। তবে সম্রাটের প্রসিদ্ধতম পুত্র ছিলেন কুণাল, তৃতীয়া রানি পদ্মাবতীর সন্তান কুণাল। সর্বাপেক্ষা মেধাবী এবং উজ্জ্বল সন্তান। শোনা যায়, সম্রাট নাকি মনে মনে কুণালকেই নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন।

কুণালের চোখ দুটো নাকি অপরূপ সুন্দর ছিল। বাস্তবেও ‘কুণাল’ শব্দের অর্থ সুন্দর নেত্রের ব্যক্তি। তিষ্যরক্ষিতা এবং কুণালের বয়স নাকি প্রায় একই ছিল। এক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক যে কামাতুরা তিষ্যরক্ষিতা কুণালের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু সম্রাট অশোকের পত্নী হবার ফলে কুণাল তাকে ‘মাতা’ সম্বোধন করতেন। কুণালের নিজপত্নী কাঞ্চনমালার সঙ্গেও কুণালের প্রেম ছিল প্রগাঢ়। কিংবদন্তি বলছে, তিষ্যরক্ষিতা নাকি কুণালের সমক্ষে প্রণয় প্রস্তাব রাখেন। কুণাল সেই প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করেন। আহত তিষ্যরক্ষিতা তখন রাজাদেশ জারি করালেন, কুণালের চক্ষু উৎপাটিত করা হোক। আদেশ পালিত হলো। সম্রাট অশোক প্রকৃত সত্য জানতে পারলে তিষ্যরক্ষিতাকে জীবিত জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। কালান্তরে কুণালের পুত্র সম্প্রতিকে পরবর্তী মৌর্য সম্রাট ঘোষণা করা হয়।

কুণাল ও তিষ্যরক্ষিতার এ কাহিনির অনেক সংস্করণ পাওয়া যায়। অনেক ইতিহাসবিদ এ ব্যাপারে একমত হন যে, সম্রাট অশোক কুণালকে তক্ষশীলার দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন। কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে যে, কুণাল কি কখনও মৌর্য সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন? মিথিলার কোশী নদীর তীরে কুণৌলি (পূর্ব নাম কুণাল গ্রাম) নামক গ্রাম আছে। গ্রামবাসীরা মনে করে, কুণাল নাকি একটি সমান্তরাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তিষ্যরক্ষিতার মৃত্যুর কারণ ও বিধি নিয়েও অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কিন্তু যেসব বিষয়বস্তুগুলি নির্বিবাদ তা হলো, তিষ্যরক্ষিতা ছিলেন সম্রাটের সবথেকে যুবা পত্নী। তিনি রাজপুত্র কুণালের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন এবং ওনার চাতুর্যের ফলেই কুণালের চোখ উপড়ে ফেলা হয়। ইতিহাস যাকে ‘তথ্য’ রূপে স্বীকৃতি দেয়, লোকাপবাদ যাকে ‘কলঙ্ক’ বলে দাগায়, সাহিত্য তাকেই সংবেদনশীলতা নিয়ে মূল্যাঙ্কিত করে।

রামকুমার বর্মার একাঙ্ক নাটক ‘চারুমিত্রা’, জয়শঙ্কর প্রসাদের কাহিনি ‘অশোক’ তিষ্যরক্ষিতাকেই মুখ্য চরিত্র হিসাবে তুলে ধরেছে। শ্রী নরেশ মেহতার একটি অদ্ভুত কাহিনি আছে, ‘তিষ্যরক্ষিতা কি ডায়েরি’। সেখানেও কিন্তু তিনি তিষ্যরক্ষিতার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। হিন্দি সাহিত্যে অদ্ভুত সহানুভূতি পেলেও বাংলায় সে সুযোগ তিষ্যরক্ষিতা পাননি। কৃষ্ণবিহারী সেনের ‘অশোক চরিত` নাটকে আবার তিষ্যরক্ষিতা ‘লক্ষ্মীছাড়ি’ অভিধা পেয়েছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর `কাঞ্চনমালা`তেও ওনার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলা হয়নি। অমিত মৈত্রর নাটক `ধর্মাশোক` এবং সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসিকা ‘শরণাগত’তে তিষ্যরক্ষিতাকে অদ্ভুত দোলাচলে এঁকেছেন। মাঝেমধ্যেই ভ্রম হয়, তিনি নায়িকা, পরক্ষণেই বুঝি খলনায়িকা। অন্তিমক্ষণও বড় মেদুর করে তুলেছেন। ফাঁসি দিয়ে গ্রীবা ভঙ্গ করার পর রাজকুমার কুণাল অন্তিম দৃশ্যে তিষ্যরক্ষিতার বুকে কান রেখে হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করছেন। সে কী তবে প্রেমই ছিল, দুই অভিমুখেরই প্রেম ছিল? অব্যক্ত প্রেম? কামনা ছিল অবদমিত?

মনোবিজ্ঞানগত দিক থেকে তিষ্যরক্ষিতার চরিত্রের তিনটি কথা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। প্রথমত, নিজের যৌন আকাঙ্ক্ষার অকুন্ঠ স্বীকৃতি। দ্বিতীয়ত, ঈর্ষা ও প্রতিশোধের সুতীব্র বাসনা। আর তৃতীয়ত, রাজক্ষমতার দহন করে নিজ স্বার্থ সিদ্ধি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, কুণালের প্রতি এই তীব্র আকর্ষণ মোটেও দোষের কিছু ছিল না। মুন্সী প্রেমচন্দের উপন্যাস ‘নির্মলা’ কিংবা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘নষ্ট নীড়’-র নায়িকারাও তো এমন পুরুষের প্রতিই আকৃষ্ট।

লেখক: কথাসাহিত্যিক